ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস

দ্বীপে জ্বলুক আশার দীপ ।। মুকিত মজুমদার বাবু

. | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫১ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৪
দ্বীপে জ্বলুক আশার দীপ ।। মুকিত মজুমদার বাবু

সবুজ দ্বীপের বুক চিরে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে স্রোতোস্বিনী খাল ও নদী। গলা ভরা জল নিয়ে ছলছল শব্দ করে মিশছে লোনাজলের নীল সাগরে।

দু’পাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাইন, গেওয়া, কেওড়া ও কাঁকড়া গাছের সুবিশাল সবুজের ক্যানভাস। সাগরের শরীর ফুঁড়ে জেগে ওঠা নিঝুম দ্বীপের প্রকৃতি রিমঝিম বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে হয়ে উঠেছে আরও সবুজ, আরও স্নিগ্ধ, আরও প্রাণবন্ত। বয়েচলা খালের কাব্যিক ছন্দ প্রকৃতিকে করে তুলেছে আরও উজ্জ্বীবিত। সেই খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে মনের পর্দায় ভেসে উঠল হরিণছানা আর বেলালের মুখোচ্ছবি—

কৌতূহলী চোখ আর দুরন্তপনা নিয়ে বৃষ্টির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে বেলাল নামের একটি ছেলে। হঠাৎ করেই বেলালের চোখ চলে যায় স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতারকাটা একটি হরিণছানার দিকে। ক্লান্ত, অবসন্ন তার দেহ। বাঁচার আশা অলিক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে নিজের ভালো-মন্দ না ভেবে হরিণছানাটিকে বাঁচাতে ঝাঁপ দেয় বেলাল। শুরু হয় হরিণছানা আর নিজের বাঁচার লড়াই। বয়ে চলে সময়। তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে উভয়ের বাঁচার চেষ্টা। অবশেষে বয়েচলা স্রোতোকে পিছু ঠেলে সাঁতার কেটে হরিণছানাটিকে নিয়ে ঠিকই তীরে উঠে আসে বেলাল। মাটিতে নামিয়ে দেয় ছানাটিকে। যেন যুদ্ধ ফেরত জয়ী সৈনিকের মতো। দুজনেরই পাঁজর দ্রুত উঠা-নামা করছে। ততক্ষণে সৌখিন আলোকচিত্রী হাসিবুল ওয়াহাবের ক্যামেরায় বন্দি হয়ে গেছে বেলাল আর হরিণছানা বাঁচানোর দৃশ্য। এর বেশ কিছুদিন পর হাসিবুল ওয়াহাব ছবিগুলো পাঠিয়ে দেন ব্রিটেনের ডেইলি মেইল পত্রিকায়। গুরুত্বের সাথে ছবিগুলো ছাপা হয় অনলাইন সংস্করণে। শুধু ব্রিটেন নয়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হরিণছানাকে বাঁচানোর ঘটনাটি আলোচিত হয়ে ওঠে সারা বিশ্বে। আলোচিত হয় বাংলাদেশ। আলোচনায় আসে নিঝুম দ্বীপ। আলোচিত হয় বেলাল। ভালোলাগায় ভরে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মন। গর্ব হয় বেলালের জন্য। বেলাল প্রকৃতি সংরক্ষণে অনেক উপরে তুলে ধরেছে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে।

এই নিঝুম দ্বীপেই প্রকৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি ঘটছে ধ্বংসের ঘটনা। স্বচ্ছ জলের খাল, বাইন, গেওয়া, কেওড়া ও কাঁকড়া গাছের বন, সবুজ শাড়ি পরা খোলা মাঠ, ঝাঁক ঝাঁক হরিণের কৌতূহলী চোখ, হরেক প্রজাতির পাখি কলকাকলি.... সবই ঠিক আছে। কিন্তু এবার আর বেলালের কর্মকাণ্ডে গর্বিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। একেবারেই তার বিপরীত লজ্জাকর ঘটনা। এক কানি (১২০ শতাংশ) জমির বন কেটে কৃষি জমি বানাতে পারলে এই দ্বীপেই দেয়া হয় ২০ হাজার টাকা পুরস্কার। আর পুরস্কারদাতারা হলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বনদস্যুরা। পুরস্কারের লোভে দ্বীপের গরিব মানুষগুলো প্রতিনিয়ত বনাঞ্চল উজাড় করে চলেছে। যে দ্বীপে একটি হরিণছানাকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছিল বেলাল সেই দ্বীপেই অবাধে চলছে বৃক্ষনিধন, হরিণ শিকারের মতো নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ।



কতটা নিরাপত্তাহীনতায় আছে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য! শুধু নিঝুম দ্বীপই নয়, সেন্টমার্টিন, দক্ষিণ তালপট্টি, হাতিয়া, চান্দনন্দি, ঢাল চর, চর পিয়াল, মনপুরা, চর নিজাম, চর আলেকজান্ডার, চর কুকরী মুকরী, সন্দ্বীপ, দমার চর, সোনার চর, চর শাহজালাল, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপসহ বাংলাদেশের অন্যান্য দ্বীপেরও একই অবস্থা। পাখি শুমারীতে গিয়ে উপকূলীয় বিভিন্ন চরে ঘুরে ঘুরে দেখেছি নিষ্ঠুর বাস্তবের বিপন্নতা। চরগুলোতে মহিষ, গরু চরানো হয়, তাদের চলাফেরায় নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার পাখির বিচরণ ক্ষেত্র। ব্যাহত হচ্ছে পাখির প্রজনন ক্রিয়া। চরগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখির দল। এছাড়া অর্থলিপ্সু শিকারির ফাঁদে হাজার হাজার পাখিনিধন হচ্ছে।

পৃথিবী সৃষ্টি থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মেই বদলাচ্ছে প্রকৃতি। আর এটাই চিরন্তন সত্য। এই পরিবর্তনটাকে সুস্থ সুন্দর পৃথিবীর জন্য আমাদের রোধ করতে হবে। কিন্তু আমরা তা না করে এই পরিবর্তনটাকে আরও ত্বরান্বিত করছি। ফলাফলে প্রকৃতি হয়ে উঠছে অশান্ত, অস্থির, বিধ্বংসী। পেছনের কয়েক বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৈরী জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, টর্নেডো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি, ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা, ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী-নালা-খাল-বিল ও ছোট-বড় জলাশয়, নিচে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর, বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। সাতক্ষীরা, সুন্দরবন, বরিশাল, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, বাগেরহাটসহ সিডরের আক্রান্ত উপকূলের স্বজনহারা, ঘরভাঙা নিঃস্ব মানুষগুলো আজও ঘর বাঁধতে পারেনি। আজও তাদের খাবার জোটে না, সুপেয় পানি পায় না, লবণাক্ততার গ্রাসে প্রকৃতির এক বিধ্বংসী চিত্র চিত্রিত হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে। দুর্যোগপূর্ণ দেশ হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। দুর্যোগের ঘনঘটা শুধু বাংলাদেশকেন্দ্রিক আবর্তিত হচ্ছে তা কিন্তু নয়, পৃথিবী জুড়েই চলছে বৈরী জলবায়ুর দানবীয় নৃত্য। আর এই রাহুগ্রাসের বড় শিকার পৃথিবীর বিভিন্ন দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চল।

পৃথিবীর দ্বীপগুলো জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। তাই প্রায় ৬০ কোটি মানুষ বাস করে এইসব দ্বীপগুলোতে। তারা দ্বীপে থাকছে, মাছ ধরছে, অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ করছে, সমুদ্রকে কেন্দ্র করে নির্বাহ করছে তাদের জীবন-জীবিকা। অধিকাংশ দেশেই দ্বীপকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে পর্যটন ব্যবস্থা। এছাড়া একটা উদাহরণেই স্পষ্ট হবে জীববৈচিত্র্য আমাদের বাঁচা-মরার সাথে কতখানি জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর কোরালসমৃদ্ধ দ্বীপসমূহ প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনীতিতে, জীবন-জীবিকায়, উৎপাদন ব্যবস্থায়, ইকোসিস্টেমে আর্থিকভাবে জোগান দিচ্ছে ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার। এমন প্রত্যেকটি দ্বীপই আমাদের জীবন-জীবিকার সাথে জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে।

আমাদের দেশে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ বাস করে উপকূলীয় চরাঞ্চলে। কোনো কারণে যদি দ্বীপাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ওপর নেমে  আসবে চরম বিপর্যয়। বাধ্য হয়ে তাদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? এত বড় একটা জনগোষ্ঠীকে স্থান দেয়া মোটেও সহসাধ্য কাজ নয়। তাই দ্বীপাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য আমাদের সংরক্ষণে মনোযোগী হতে হবে। বর্তমানে বৈরী জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে আছে দ্বীপ, দ্বীপের মানুষ ও দ্বীপের জীববৈচিত্র্য। এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তুলতেই এবছর বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে দ্বীপাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। ১৯৯২ সাল থেকে এ দিবসটি সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে।



জীববৈচিত্র্য মানে প্রাণের বৈচিত্র্য বা প্রাণবৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য বলতে সাধারণত উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা, প্রজাতিভেদ এবং বৈসাদৃশ্যকে বুঝানো হয়। তবে ব্যাপক অর্থে পৃথিবীতে জীবনের উপস্থিতিই জীববৈচিত্র্য। এক প্রাণগোষ্ঠী জীবনের তাগিদে অন্য কোনো প্রাণগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র ও ঔষধ এই প্রধান তিনটি প্রয়োজনীয় উপাদান জীববৈচিত্র্য থেকেই আসে। মানুষের জীবনে যত উপকরণ ও উপাদান প্রয়োজন, তার সবই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে।

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) ও জীববৈচিত্র্য সনদের পক্ষ থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন (Biodiversity, Development and Poverty Alleviation: Recognising the Role of Biodiversity for Human Well-being) এ বলা হয়েছে— গত ৫০ বছরে ৬০ শতাংশ প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়েছে এবং গত ১০ বছরে শুধু জমিতেই জীববৈচিত্র্য ধ্বংস রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ক্ষতি হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৭০ শতাংশ গ্রামের মানুষ সরাসরি জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল, শহরের মানুষও কোনো না কোনোভাবে জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। গত শতকে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ প্যারাবন, ৪০ শতাংশ বন ও ৫০ শতাংশ জলাশয় হারিয়ে গেছে। এ কথাও প্রমাণিত হয়েছে, মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্য জীববৈচিত্র্য ধ্বংস প্রাকৃতিক কারণের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি হয়।
অর্থনৈতিকভাবে জীববৈচিত্র্য কত গুরুত্বপূর্ণ, তার কিছু পরিসংখ্যান উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনটিতে— ঔষধ কোম্পানিগুলো বছরে যে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে, তার ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কাঁচামাল আসে গাছগাছালি থেকে। বন থেকে ঔষুধের গাছ অসংখ্য মানুষ সংগ্রহ করে চিকিৎসা করে, যার মূল্য হচ্ছে এক বিলিয়ন ডলার। জনগণের ছয় ভাগের এক ভাগ জীবন-জীবিকার জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গাছগাছালির ঔষধের ওপর নির্ভর করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসব গাছগাছালি হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর ১১০ কোটি গরিব মানুষ তাদের ৯০ শতাংশ চাহিদা, যেমন— খাদ্য, জ্বালানি, ঔষধ, বাড়িঘর ও যানবাহনের ব্যবস্থা তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকেই মেটায়।

বিশ্বে ৩০০ কোটি মানুষ সমুদ্র ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে। ১০০ কোটি মানুষ সরাসরি একমাত্র মাছ ধরার কাজে জড়িত। সামুদ্রিক মাছ থেকে ১৬ শতাংশ প্রোটিন সরবরাহ করা হয়। মাছ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তেমনি নদী ও জলাশয় থেকে পাওয়া মিঠা পানির মাছের অর্থনৈতিক মূল্য বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার।

মানুষ প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রকৃতির কোলেই আমরা প্রতিপালিত হই। জ্ঞানের দিক দিয়ে মানুষের সমকক্ষ কেউ নেই। তাই আমরা বুঝেও না বুঝার ভান করে পৃথিবীর মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছি। অথচ প্রকৃতির যা কিছু সম্পদ, সবকিছুর সঙ্গে আমাদের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। জীববৈচিত্র্য না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব কল্পনাই করাই যায় না। আজ আমাদের কাছে যে উদ্ভিদ কিংবা প্রাণী অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে সেই উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীটিই আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।



সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, পৃথিবীর সব সৃষ্টির পেছনে কোনো না কোনো কারণ রয়েছে। অহেতুক কোনোকিছু সৃষ্টি করা হয়নি। সকল ধর্ম আর মানুষের গবেষণালব্ধ বিজ্ঞানের কথা এখানে এসে এক হয়ে গেছে। জীববিজ্ঞানের ভাষায়— পৃথিবীর জীবজগত একটি শৃঙ্খলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শেকলের মতো এক একটি প্রজাতির সাথে অন্য প্রজাতিগুলোর রয়েছে নিবিড় বন্ধন। কিন্তু মানুষ যদি সেই শৃঙ্খল ভাঙে তাহলে সেটা প্রকৃতি জোড়া দিতে পারে না। এই ভাঙন যদি ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, তাহলে গোটা প্রাণ-শৃঙ্খলই একদিন বিপর্যস্ত হবে এবং মানুষও বিপন্ন হবে অস্তিত্ব রক্ষায়।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আমরা জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে চলেছি। ক্ষমতা সীমিত থাকার কারণে শুরুতে এটা ছিল খুবই কম। ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা এখন আগের তুলনায় কয়েক হাজার গুণ বেশি।

পৃথিবীর জীবপ্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৮.০৭ মিলিয়ন। কিন্তু এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে আরও অনেক প্রজাতি।

আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ছোট হলেও জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে অনেক সমৃদ্ধ। আমাদের হাওর-বাঁওড়, নদ-নদী, খাল-বিল, বিভিন্ন চরাঞ্চল, পাহাড়, সাগর, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনসহ পুরো দেশটাই জীববৈচিত্র্যের আধার। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে যদিও কৃষি জমি, বনাঞ্চল, পাহাড়, ছোট-বড় জলাশয় ভরাট হচ্ছে তারপরও জীববৈচিত্র্যের একটা ভালো পর্যায়ে রয়েছে। একটা দেশের যা থাকা দরকার বাংলাদেশে তার সবই আছে। এতো কিছু থাকার পরও আমরা কী করছি? এই আমরাই প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি। তবে ধ্বংসকারীদের চেয়ে সংরক্ষণকারীদের সংখ্যা অনেক অনেক কম। তাই দ্রুত ত্বরান্বিত হচ্ছে ধ্বংসের দানবীয় ত্রাস। আমরা কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছি বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যকে? আর এ কথা যদি এখনই না ভাবি, সচেতন না হই তাহলে যা আছে তা হারিয়ে যাবে। আর এই হারিয়ে যাওয়ার দায় আমরা কোনোভাবে পাশ কাটিয়ে যেতে পারব না।

জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখতে আমাদের সবচেয়ে বড় দরকার হলো সচেতনতা। আমাদের দেশে শিক্ষার অভাব আছে। আর শিক্ষার অভাব আছে বলেই আছে অসচেতনতা। তাই শিক্ষা আর সচেতনতাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি প্রচার প্রচারণার ব্যাপারে হতে হবে বিশেষভাবে উদ্যোগী। এ ক্ষেত্রে যেমন সরকারের দায়িত্ব আছে তেমনি দায়িত্ব আছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে চলবে না। হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ রেখে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। এক্ষেত্রে অনলাইন মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। পাশাপাশি প্রকৃতিবিষয়ক কাজের সাথে যারা জড়িত তাদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে প্রকৃতি সংরক্ষণে। দ্বীপগুলোর উপকারিতা যাতে চলমান থাকে তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর তাহলেই আমরা বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস পালনের সুফল পাব।




লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।