এই নিয়ে পরপর তিনবার আমি একই বিষয় নিয়ে লিখছি। বিষয়টি হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস।
আমার ধারণাটা ভুল ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু করেনি। আমি দ্বিতীয়বার তাই একটু বড় করে লিখেছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সরাসরি কয়েকটা প্রশ্ন করেছি। তারা আমাকেই তার উত্তর দেবে, আমি সেটা কখনো ভাবিনি। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সেটা অন্তত মেনে নেবে, এরকম আশা ছিল। আমার আশা পূরণ হয়নি, হয়তো লেখাটা তাদের চোখে পড়েনি।
এবারে তাই লেখার শিরোনামে ‘শিক্ষামন্ত্রী’ কথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছি, এবারে নিশ্চয়ই কারো চোখে পড়বে। আমার অবশ্যি আরো একটা উদ্দেশ্য আছে। এই দেশের যে অসংখ্য ছেলে-মেয়ে, এই মুহূর্তে এইচএসসি পরীক্ষা নামে প্রহসনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, আমি তাদেরকে জানাতে চাই, সেই প্রহসনের জন্যে আমাদের কারো বুকের মাঝে আত্মতৃপ্তি নেই। তারা যেরকম হতাশা, ক্ষোভ আর যন্ত্রণায় ছটফট করছে, আমরাও ঠিক একই ভাবে হতাশা, ক্ষোভ আর যন্ত্রণায় ছটফট করছি।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নিয়ে আমি প্রথমে যে লেখাটা লিখেছিলাম, তখন আমার হাতে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্নগুলো ছিল। এখন রসায়নের প্রশ্ন আছে। এগুলোও আমি পত্র-পত্রিকায় দিতে পারতাম। কিন্তু কোনো লাভ হবে না বলে নোংরা ঘাটাঘাটি করতে ইচ্ছে করছে না। সবচেয়ে বড় কথা, ফেসবুক থেকে যখন যার প্রয়োজন এগুলো নামিয়ে নিতে পারবে, তখন আমার দেওয়া না দেওয়ায় কিছু আসে যায় না।
একটা বিষয় আমার কাছে এখনো রহস্যের মতো মনে হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি খুবই ভয়ানক একটা ব্যাপার। আমি ভেবেছিলাম, এটা নিয়ে বুঝি সারা দেশে তুলকালাম ঘটে যাবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, কিছুই ঘটেনি। পত্র-পত্রিকা বা মিডিয়ার যেসব মানুষকে আমি চিনি, তাদের ফোন করে ব্যাপারটা জানতে চাইলাম। তারাও ব্যাপারটা আমাকে বোঝাতে পারলেন না। আবছা আবছা ভাবে মনে হল, সবাই ধরেই নিয়েছেন, এরকমই ঘটতে থাকবে এবং যেহেতু চেচামেচি করে কিছুই হবে না, তাহলে খামোখা চেচামেচি করে কি হবে?
কী সর্বনাশা কথা! আমিও ব্যাপারটা খানিকটা অনুমান করতে পারি। যে দেশে সরকারের ৠাব বাহিনী সরকারের পুরো প্রশাসনকে ব্যবহার করে এক দুইজন নয়, সাত সাতজন নিরপরাধ মানুষকে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় সবার সামনে ধরে নিয়ে খুন করে নদীর তলায় ডুবিয়ে রাখতে হাত লাগায়, সেই দেশে কী এখন ‘তুচ্ছ’ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে বিচলিত হবার সময় আছে?
তারপরও আমার মনে হয়, আমাদের বিচলিত হতে হবে। তার কারণ, একজন তরুণ কিংবা তরুণী তার স্বপ্ন দেখার বয়সটিতেই আশাহত হয়, হতাশাগ্রস্ত হয়, অপমানিত হয়, ক্ষুব্ধ হয়, কোনো কারণ ছাড়াই তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে থাকে, তাহলে সে কেমন করে বেঁচে থাকবে?
এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে শুরু হওয়ার পর অসংখ্য ছেলে-মেয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তাদের ক্ষোভ অভিযোগ ও হতাশা আমাকে জানিয়েছে। আমি এর আগে সব সময়ই সবাইকে আশার কথা শুনিয়ে এসেছি। এই প্রথমবার আমি পরিস্কার করে কিছু বলতে পারছি না।
আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন ই-মেইল পাঠিয়েছে একজন ছাত্রী। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পরও সে নিজের সততার কাছে মাথা উঁচু করে থেকেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সে দেখেনি, নিজের মতো করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা দেওয়ার পর জানতে পেরেছে, তার চারপাশের সবাই ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। সবার পরীক্ষা ‘ভালো’ হয়েছে শুধু তার পরীক্ষা ‘ভালো’ হয়নি। প্রশ্নপত্র কঠিন ছিল, ভালো হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
মেয়েটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে জানার পরও পরীক্ষা বাতিল হয়নি, বাতিল হবে সে রকম কোনো আলোচনাও নেই। তার অর্থ, সবাই পার হয়ে যাবে শুধু সে পার হবে না। সততার জন্য সে খুব বড় একটা মূল্য দেবে, ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাবে না, জীবনের স্বপ্নটি শুরু হওয়ার আগেই ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে।
আমি তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবো? তাকে বলবো, বাংলাদেশে এটাই নিয়ম? এই দেশে আমরা আমাদের সৎ মানুষের জীবনটা ইচ্ছে করে ছারখার করে দিই। আমি তাকে বলবো যে, তোমার অসৎ হওয়া উচিত ছিল, তুমি নির্বোধের মত সৎ থেকেছ, এখন তার মূল্য দাও?
কেউ একজন আমাকে কী বলবেন, আমরা কী আনুষ্ঠানিকভাবে একটা জাতিকে অসৎ বানিয়ে দেওয়ার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি? আমরা কী অন্যায়কে অন্যায়ও বলতে পারবো না?
সম্ভবত অন্য সবার মতো আমরাও এ বিষয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া উচিৎ ছিল। বলা উচিৎ ছিল, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কখনই স্বীকার করেনি যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, উল্টো সবাইকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে গুজবে কান না দিতে। যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদেরকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে (সেই হিসেবে আমি হয়তো রাষ্ট্রের চোখে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করার দোষে দোষী একজন মানুষ)। আমার হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডিজিটাল বাংলাদেশ জাতীয় বড় বড় কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো উচিৎ ছিল।
যতোবার আমি এই দেশের ছেলে-মেয়েদের কথা ভাবি- যারা অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে সত্যিকার ছাত্র বা ছাত্রীর মতো লেখাপড়া করে নিজের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করেছে, ততোবার আমার মনে হয়, কিছুতেই এ বিষয়টাকে ভুলে যেতে দেওয়া যাবে না। আমাকে চেষ্টা করতে হবে, যেন কর্তৃপক্ষ আগে হোক আর পরে হোক এ বিষয়টার দিকে নজর দেয়। এটি মোটেও এমন একটি বিষয় নয় যে, অল্প কিছু দুর্নীতিবাজ তাদের অল্প কয়েকজন দুর্নীতিবাজ ছেলে-মেয়েদেরকে একটা সুযোগ করে দিয়েছে।
লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর তুলনায় তাদের সংখ্যা এতো কম যে, এ বিষয়টা উপেক্ষা করলেও সত্যিকার অর্থে দেশের এমন কিছু ক্ষতি হবে না, এটি মোটেও তা নয়। আজকাল বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-ছাত্রীদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। তারা তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে চোখের পলকে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র নামিয়ে আনছে। নামিয়ে আনার পরে একে অন্যকে পৌঁছে দিয়েছে। যাদের কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেই তাদের ফ্যাক্স ফটোকপি আছে- কাজেই লাখ লাখ ছেলে-মেয়ের হাতে এগুলো পৌঁছে গেছে। এটি উপেক্ষা করা যায়, সে রকম একটা সমস্য নয়। এটি এই দেশের লাখ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে সে রকম একটা সমস্য।
আমি এই লেখাটি লিখছি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে। আমাদের দেশে যে কয়েকজন মন্ত্রী সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তিনি তাদের একজন। জনপ্রিয় মন্ত্রীদের নিয়ে যখনই জরিপ করা হয়, তিনি তখন সবার ওপরে থাকেন। তার কারণও আছে, স্কুল কলেজের লেখাপড়া নিয়ে তার আগ্রহ আছে। বছরের প্রথম দিন তার কারণে বাংলাদেশের সব ছেলে-মেয়ে হাতে নতুন বই পেয়ে যায়। শুধুমাত্র বইয়ের সংখ্যা দেখলে পৃথিবীর যেকোনো মানুষের মাথা ঘুরে যাবে। বইগুলো একটার পর আরেকটা রাখা হলে সারা পৃথিবী দুইবার ঘুরে আসবে।
বাচ্চাদের অনুপ্রাণিত করার জন্যে আমি সুযোগ পেলেই তাদের এই কথাটা বলে অবাক করে দিয়েছি। আমি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কলেজ উদ্বোধন করতে গিয়েছি। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমি তার পাশে বসে ছাত্র-ছাত্রীদের ডিগ্রি পেতে দেখেছি। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও তার কথা শুনে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। কাজেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারটা তার নজরে আনা হলে তিনি কিছু একটা করবেন না, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। তাই আমি অনেক আশা করে এই লেখাটি লিখছি। আমি আশা করছি, তিনি কষ্ট করে হলেও এই লেখাটুকু পড়েন।
আমি তার কাছে বেশি কিছু চাই না, ছোট্ট একটা বিষয় চাই। তিনি শুধুমাত্র একটা সত্যি কথা বলবেন, জাতিকে জানাবেন, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। আমি চাই, এই দেশের ছেলে-মেয়েরা অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে জানতে শিখুক, অপরাধকে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করে নিতে শিখুক। তার বেশি কিছু নয়। একটা দেশের পুরো প্রজন্মকে যদি আমরা অনৈতিক হিসেবে গড়ে তুলি, তাহলে সেই দেশকে নিয়ে আমরা কী করবো?
যদি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাবার ঘটনাটি মেনে নেন, তাহলে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে তাদেরকে ধরার চেষ্টা করা যাবে। আমি এই দেশের একটা সত্যি কথা জানি, যদি কোনো অপরাধীকে ধরার ইচ্ছে থাকে, তাহলে তাদের ধরা যায়। যেসব অপরাধীদের ধরা যায় না, তাদেরকে আসলে ধরার চেষ্টা করা হয় না। আমরা আশা করবো, এই ঘটনার তদন্ত হবে, অপরাধীদের ধরা হবে, তাদের শাস্তি হবে। ভবিষ্যতে যেন আর কখনো এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেটি নিশ্চিত করা হবে। আমি জানি, এটি করা সম্ভব।
এমনটি কী হতে পারে যে, এই লেখাটি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর চোখে পড়ল না? কিংবা তার চেয়েও দুঃখজনক একটা ব্যাপার ঘটল। লেখাটি তার চোখে পড়ল, কিন্তু তারপরেও তিনি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটা স্বীকার করলেন না। তাহলে আমরা কী করবো?
অন্যেরা কী করবেন জানি না। কিন্তু আমি কি করবো মনে মনে ঠিক করে রেখেছি। তাহলে আমি শহীদ মিনারে কিংবা এরকম কোনো একটা জায়গায় খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে থাকবো। হাতে একটা প্ল্যাকার্ড রাখবো, সেখানে লিখবো, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস মানি না, মানবো না। আমাদের ছেলে-মেয়েদের অসৎ হতে দেবো না’।
তাতে কী কোনো লাভ হবে? সম্ভবত হবে না। যখন এই দেশের ছেলে-মেয়েরা ক্ষুব্ধ চোখে আমাকে বলবে, ‘স্যার, আমরা এ কেমন দেশে বাস করছি? কেন এতো বড় অন্যায় আমাদের মেনে নিতে হবে?’
আমি তখন অন্তত তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলবো, ‘তোমরা আমাকে ক্ষমা করো, আমি কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম’।
বাংলাদেশ সময়: ০০০২ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৪