অষ্টাদশী এক সাহসী তরুণীর কাছে রয়েছে সব সমস্যার সমাধান। পারিবারিক, সামাজিক এমনকী রাজনৈতিক।
ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী মেগা সিরিয়ালে কী নেই! রোমান্স, বিনোদন, হিংসা, পরপ্রেম, একাধিক বিয়ের মতো সুযোগ, কখনো রূপকথার আমেজ। আর বউয়ের সঙ্গে ননদ-শাশুড়ির ‘নান্দনিক’ দ্বৈরথ তো দেখার মতো, শেখার আছে এতে অনেককিছু! বিশেষ করে নারীদের বিপথে চলার মতো সব ধরনের উপকরণে ঠাঁসা এই ‘মেগা সিরিয়াল’ আসলে ‘মেগা সমস্যা’।
আমাদের দেশের নারীরা তাদের প্রধান বিনোদন হিসেবে যে ভারতীয় সিরিয়ালে মগ্ন সেই সিরিয়ালই কিন্তু ঐশীর মেতা ঘাতক কিংবা মিল্কী হত্যা ঘটনার আইডিয়াদাতা! দেশের অধিকাংশ ঘরোয়া নারীর বিনোদনের পুরোটা জুড়েই থাকছে এসব ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিরিয়াল।
প্রথমেই আসা যাক এসব সিরিয়ালের বিস্তারিত ‘গুণ’র কথায়। গুণ শুনলেই আপনার বুঝতে দেরি হবে না যে নারী, তরুণী, পৌড়া সবাই কেন এসব মেগা সিরিয়ালে আসক্ত। স্বল্প বিরতি সম্পন্ন এসব সিরিয়ালে চ্যানেলান্তরী হওয়ার সুযোগ নেই, একটি নাটক শেষ হতে না হতেই আরেকটি শুরু। নাটকগুলোতে থাকে নারী ও তরুণীদের আকর্ষণ করার মতো সাজসজ্জা ও ফ্যাশন। এসব ডেইলি সোপের আসক্তি এমনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে যে, বিউটি পার্লারে গিয়ে অমুক নাটকের তমুক নায়িকার মতো চুলের সাজটা করে দেন- বললেই যথা সময়ে সাজটা হয়ে যায়। বুঝতে সুবিধা হয় বিউটিশিয়ানদের।
নাটকের সংসার কে তো নিজের সংসার বানিয়ে ফেলেছেন অনেকে। কীভাবে? জানতে চান? ছোট বাচ্চাটিকে স্কুলে দিয়ে স্কুলের আঙিনায় দাঁড়িয়ে যখন অন্য পরিচিতাদের সঙ্গে গল্প করছেন তখন বলছেন, ‘ভাবি দেখেছেন, ঝিলমিল কি কাজটাই না করল। ও যদি আমার ছেলের বউ হতো তাহলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম। ’
আর আমার পরিচিত ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধার কথা বলছি, তিনি এসব সিরিয়াল দেখার জন্য মাগরিবের নামাজ আদায় করার একটু পরেই এশার আযান হওয়ার আগেই এশার নামাজ আদায় করেন। কারণ এশার নামাযের সময় তার প্রিয় সিরিয়ালটি প্রচার হয়।
এসব মেগা সিরিয়ালের প্রসারণ ক্ষমতা যেকোনো উন্নতমানের রাবারের ফিতার চেয়ে কয়েক লক্ষাধিক! কবির ভাষায় নাটকগুলোও যেন ‘অনন্ত যৌবনা’। ধরুন, আপনি তরুণী বয়সে একটি সিরিয়াল দেখা শুরু করলেন, আপনার ছেলের ঘরের নাতনিও দুনিয়াতে এসে ওই সিরিয়াল দেখে বলতে পরবে, এই নাটকটা আমার আব্বুর দাদিমার খুব প্রিয় ছিল। আবার সাপ্তাহের সবগুলো পর্ব একত্রিত করে রিভিশন পর্ব দেখানো হয়।
শুধু তাই নয়, কোমলমতি শিশুদের আকর্ষণ করতে দিনজুড়ে আলাদা চ্যানেলে ভূত-প্রেত সম্পর্কিত সিরিয়াল দেখানো হচ্ছে। ছোট কিন্তু কৌতূহলী হওয়ায় বাচ্চারাও ঝুঁকে পড়ছে এসব সিরিয়ালে। পরবর্তীতে বাসা কিংবা স্কুলে অহেতুক ভয়ের শিকার হচ্ছে যা সোনামণিদের মানসিক বিকাশের জন্য হুমকি। এছাড়া কিছু সিরিয়ালে শিশুদের দিয়ে এমন কিছু কাজ করানো হয় বা তাদের চরিত্র এমন নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করা হয় যা সচারাচার একটি শিশু করে না। বরং এসব সিরিয়াল দেখে তারা শিখছে। মাতৃভাষার পর সব বাবা-মাই চান তার সন্তানটি ইংরেজিতে কথা বলতে শিখুক। কিন্তু এসব সিরিয়ালের আগ্রাসী ভূমিকায় ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে পৌড়ের কাছেও হিন্দি দ্বিতীয় ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে!
আজকাল ফেসবুক থেকে শুরু করে সব যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের দেশের তরুন-তরুণীদের বাংলার চেয়ে অধিক হিন্দির ব্যবহার লক্ষণীয়। এমনকি মহান মাতৃভাষা দিবসে এক তরুণী সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমার ভাই এর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। তোমহারি পাস লাখো নামাস্তে। ’
ক্যানসারের মতো দ্রুত বিস্তারলাভকারী এসব মেগা সিরিয়াল এখন থেকেই বর্জন করতে হবে। নতুবা গৃহিণীরা আর সংসার করবেন না, বসে থাকবেন ‘পটের বিবি’ সেজে, শাশুড়ির সঙ্গে কোনোদিনও ভালো হবে না বউয়ের সম্পর্ক, আর ‘সংসার’র অর্থ হয়ে উঠতে পারে ‘পরকীয়া’!
যে দেশের মানুষ লাখো কণ্ঠে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গেয়ে ভারতের রের্কড ভাঙতে পারে, সে দেশের মানুষ চাইলেই আজ থেকে এসব সিরিয়াল দেখা অবশ্যই বয়কট করতে পারবে বলেই আমাদের আশা।
আহসানুল হাবিব, প্রাক্তন ছাত্র, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , ময়মনসিংহ।
বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৪