১। যেভাবে আমি নেশামুক্ত হলাম...
মিথ্যে বলব না, বাংলাদেশে যখন ছিলাম আমিও হিন্দি ছিঃরিয়ালে (সিরিয়াল) আসক্ত ছিলাম।
ফাইনাল একজামের মাঝে যে গ্যাপ থাকত সে সময়টা হিন্দি সিনেমা যে দু’একটা দেখতাম না, তা নয়। ধামাকা মুভি, নাচ-গানে ভরপুর। ফুল এন্টারটেইনমেন্ট। ব্যাস পরের পরীক্ষার জন্য পরদিন থেকে প্রস্তুতি। হিন্দি চ্যানেলের দৌরাত্ম এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।
মানুষ যেমন কুসংসর্গে মিশে নেশায় আসক্ত হয়, আমিও তেমনি হিন্দি সিরিয়ালে আসক্ত হয়েছিলাম আমার শ্বাশুড়ির সংসর্গে এসে। বিয়ের পর যখন ছুটিতে বাসায় যেতাম, অলস দুপুরটায় শ্বাশুড়ির সাথে বসে সিরিয়াল দেখা ছাড়া তেমন কিছুই করার ছিল না। মহা উত্সাহে আমার শ্বাশুড়ি আমাকে কোন সিরিয়ালে কে কি রকম, আগে কি হয়েছিল এসব বলে যেতেন। আমিও মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনে যেতাম এবং তার সাথে বসেই দেখতাম বউ-শ্বাশুড়ির দ্রিমদ্রিম যুদ্ধ।
ছুটি শেষে আমার ইউনিভার্সিটির ছোট্ট ফ্ল্যাটে ফিরে আমিও দেখা শুরু করলাম কড়া মেকাপে গায়ে পাথর, চুমকি বসানো দশমনি শাড়ি-গয়নায় মোড়ানো নায়িকার ঘুমাতে যাওয়া, কিভাবে সারাক্ষণ সংসারে অন্য মানুষের শান্তি হারাম করার ফন্দি ফিকির করতে হয়, কিভাবে সম্পত্তি দখল করতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় কুট কৌশল মার্কা সিরিয়াল।
স্কলারশিপ নিয়ে যখন দেশের বাইরে পড়তে গেলাম, তখনও এই নেশা আমার পিছু ছাড়েনি। উইকেন্ডে ইউটিউবে এক সপ্তাহের সিরিয়াল একটার পর একটা দেখতেই উইকেন্ড শেষ। জাহিদের বিরক্তি, উপহাস উপেক্ষা করেও সিরিয়ালে বুদ হয়ে যেতাম। লজ্জা যে পেতাম না, তা নয়। কিন্তু নেশাখোরের কি লজ্জা পেলে চলে!
একদিন আমার সহপাঠী কলকাতার বন্ধু স্মিতা চ্যাটার্জি জানালো যে, ওরা বাংলাদেশের চ্যানেল দেখে না। দেখার সুযোগ নেই, আর সুযোগ থাকলেও দেখতো কি না সন্দেহ আছে! এমনকি ওরা হিন্দি চ্যানেলও দেখে না। ওরা কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত বাংলা চ্যানেলগুলোই শুধু দেখে। ওরা হিন্দিতে পারতপক্ষে অন্য প্রদেশের কারো সঙ্গে দেখা হলেও কথা বলে না। ওরা ইংরেজিতেই অন্য প্রদেশের কারো সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
স্মিতা জানালো, কলকাতায় থাকার সময়ই বাংলাদেশের মানুষের হিন্দি সিরিয়াল আর হিন্দি সিনেমা প্রীতি সে জেনে এসেছে। ভৎসনা করেই বলল, তোমাদের হিন্দিপ্রীতি আমাদের কলকাতাবাসীকেও হার মানিয়েছে! তোমাদের যা অবস্থা, হিন্দি চ্যানেল দেখতে না পেলে তোমরা তো বাঁচবেই না।
শুনে এমন মেজাজ খারাপ হলো, ভাবলাম সত্যিই তো বলেছে। যেখানে ওরা নিজেদের দেশের হিন্দি সিরিয়াল দেখে না, আর আমি কি না ওদের সিরিয়ালে আসক্ত? এই বস্তাপঁচা জিনিস দেখে আমি আমার সময় নষ্ট করছি? নিজের ওপর এমন বিরক্ত হলাম যে, প্রতিজ্ঞা করলাম আর নয়।
ঝাকুনিটা এমন খেয়েছিলাম যে, সম্পূর্ণ নেশামুক্ত হয়েছি একদিনেই। হিন্দি সিরিয়াল, হিন্দি মুভি, হিন্দি গানকে চিরতরে গুডবাই জানিয়েছি।
বিশ্বাস করুন, এই নেশামুক্তিতে আমি শুধুই উপকৃত হয়েছি। মানসিক বৈকল্যের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। সুস্থ চিন্তা করার শক্তি ফিরে পেয়েছি। আমার অমূল্য সময়কে আমি সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারছি। এক্সারসাইজ করার জন্য সময় বের করে আনতে পেরেছি। ক্ষতিকর নেশা ত্যাগ করে বই পড়ার পুরনো নেশায় আবার ফিরে গিয়েছি।
সিদ্ধান্ত নিন, সস্তা বিনোদনের জন্য হিন্দি সিরিয়ালের নেশায় বুদ হয়ে জীবনের অমূল্য সময় ব্যয় করবেন কি? আপনার ছোট্ট সোনামনিকে হিন্দি সিরিয়ালের আদর্শে বড় করবেন কি? জীবনটা তো আপনার। সবার আগে পরিবর্তন আনুন নিজের মধ্যে। সিরিয়ালের নেশা থেকে মুক্ত হয়ে শ্বাস নিন, দেখবেন জীবনে কত কিছুই না করার আছে।
২। হিন্দির নেশায় পুরো জাতিকে আসক্ত করার দায় কার?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনে কোনো খারাপ কাজ যদি আপনি করেন, তার দায় শুধুই আপনার। হিন্দি চ্যানেলের মতো খারাপ আসক্তির দায় অবশ্যই শুধুই আপনার, দর্শকের। আমাদের দেশের মানুষকে এই নোংরা সিরিয়ালের নেশায় বুদ করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুটে নিচ্ছে ভারত। আর আমরা কি করছি? যান্ত্রিক জীবনে বিনোদনের আশায়, পরিবারের ছোট্ট শিশুটিসহ সবাই এই নেশায় আসক্ত হচ্ছি।
ভয়ঙ্কর এই নেশার আসক্তিতে প্রভাবক হিসেবে সবার আগে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে সংস্কৃতিমন্ত্রীকে। ফ্রিতে আলকাতরা পেলেও মানুষ খায়। আর সেখানে ফ্রিতে সমগ্র জাতিকে নেশা ধরিয়ে দিয়ে মানসিকভাবে বিকল করে দেওয়ার জন্য জনাব মন্ত্রীকে সবার আগে দায়ী করতে হয়।
লোভ, নাকি অজ্ঞতা, নাকি পরিবারসহ নিজেও হিন্দি চ্যানেলের নেশায় বুদ, জানি না। তবে মন্ত্রীর চেয়ারে যিনিই বসুন না কেন তার চৈতন্য না ফিরলে জাতির ভবিষ্যত যে অন্ধকার তা বুঝতে বেশি সময় লাগবে না।
এরপর দায় পড়ে দেশের চ্যানেল মালিকদের ওপর। ডজনে ডজনে বাংলা চ্যানেল চালু করছে। অথচ কোনো চ্যানেলে দেখার মতো ভালো কোনো অনুষ্ঠান নেই। যাও বা দু’একটা অনুষ্ঠান আগ্রহ নিয়ে দেখতে বসবেন, বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে সেই অনুষ্ঠান দেখার রুচি নষ্ট হয়ে যাবে।
দু’মিনিটের নাটক দেখতে গুনে গুনে ৫০টা বিজ্ঞাপন বাধ্য হয়ে দেখতে হবে আপনাকে। বিজ্ঞাপন শুরুর সময় আপনি রান্না-বান্না শেষ করে এসেও দেখতে পারবেন যে, বিজ্ঞাপন তখনও চলছে। একটু পর পর এই সংবাদ, সেই সংবাদের অত্যাচার তো আছেই।
মানুষের ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে। সারাদিন কাজ শেষ করে এসে টিভিতে যদি বেশিরভাগ সময় বিজ্ঞাপনই দেখতে হয়, তবে অনুষ্ঠান দেখবেন কখন? রিমোটের হালকা ছোঁয়াতেই যদি ভিনদেশি চ্যানেলে বিনোদন পান, তবে মানুষ দেখবে না কেন? আর সেই দেখাতেই ধীরে ধীরে বাড়ছে আসক্তি। আমাদের চ্যানেলগুলো এই আসক্তির জন্য ১০০ ভাগ দায়ী।
এরপর দায়ী করতে পারি নির্মাতা ও পরিচালকদের। ফারুকী সাহেব আর তার ভাই-ব্রাদারেরা যতই এদেশে ভারতীয় চ্যানেলকে পর্ণ নায়িকার মতো খোলা বলুক না কেন, ফারুকী সাহেবরাই বা এই অবস্থা বদলের জন্য কি করেছেন? হিন্দি সিরিয়ালের আদলে অদ্ভূতসব নোংরামি, বিকৃত যৌনতা, ভাষা বিকৃতি ইত্যাদির দৌরাত্ম তো তাদের নাটকের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। বিজ্ঞাপনহীন ভালো কনসেপ্টের নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠান কি তারা বানাতে পারতেন না? চ্যানেল মালিকদের কি অল্প বিজ্ঞাপন বেশি দামে প্রচার করতে বাধ্য করতে পারতেন না?
হিন্দি চ্যানেল আসক্তির দায় যেমন দর্শকের, তেমনি মন্ত্রী, চ্যানেল মালিক, নির্মাতাসহ সবার। এই হিন্দি চ্যানেলের নেশা থেকে নারী-পুরুষ-শিশু সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। নেশার ঘোরে থাকলে আপনি হয়ত আমার এই লেখাটিকে ফুত্কারে উড়িয়ে সমালোচনায় মগ্ন হবেন। কারণ, নেশাখোরদের নেশার বিরুদ্ধে কোনো কথাই কানে যায় না।
তবে ইচ্ছে থাকলেই এই নেশা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব। দরকার বিজ্ঞাপনহীন ভালো ভালো অনুষ্ঠানের। শিশুসহ সব বয়সী দর্শকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্লটে মান সম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করুন। দেখবেন হিন্দি চ্যানেল দেখার সুযোগ থাকলেও রিমোট আর ভারতের দিকে নয়, বাংলাদেশের দিকেই হাত বাড়িয়ে দেবে।
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৪