ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা প্রিয়ম্বদা গোপাল। তিনি লিটেরারি রেডিক্যালিজম ইন ইন্ডিয়াঃ জেন্ডার, নেশন এন্ড দ্য ট্রাঞ্জিশন টু ইন্ডিপেন্ডেন্স (২০০৫) এবং দি ইন্ডিয়ান নভেল ইন ইংলিশ (২০০৯) নামের দুটি বই লিখেছেন।
"ওয়েস্ট'স প্রব্লেম্যাটিক এম্ব্রেইস অব মোদী" নামের প্রবন্ধটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন এস এম মনিরুজ্জামান
নিজেদের তালে তাল না মেলালে মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যম অপশ্চিমা রাজনৈতিকদের জুলুমকারী একনায়ক স্বৈরাচারী বলে গাল পাড়তে কসুর করে না, কিন্তু হাতে-ধরিয়ে-দেয়া পশ্চিমা পুঁজিপতি বেনিয়াবান্ধব স্তুতিগানের স্বরলিপি ধরে গুণ গাইলে ওরা সবচে প্রশ্নবিদ্ধ অতীতওয়ালা রাজনীতিকদের দৃষ্টিকটু ত্রুটিও চোখে দেখে না।
ভারতে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতারোহণ পশ্চিমা গণমাধ্যমে সমালোচনার ধার ধারলো না একদমই, বরং বলা যায় নির্ধার করে দিল। পত্রিকার সম্পাদকীয়গুলো ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টির এই নির্বাচনী বিজয়কে মোলায়েমভাবে নিরপেক্ষতার সাথে গ্রহণ করেছে নতুবা আগ্রহভরে বাহবা দিয়েছে। অন্য কোনো উগ্র ধর্মভিত্তিক দলের ক্ষেত্রে এই ধরনের পশ্চিমা সম্বর্ধনা কল্পনাও করা কঠিন, আর নরেন্দ্র মোদীর মত সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডে মদদদাতার ক্ষেত্রে তো নয়ই।
ক্ষমতা হারানো ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালাইয়েন্স (উপিএ)-এর শাসন নিয়ে জনতার মনে যে ক্ষোভ ছিল তার ওপর ভর করেই মূলত মোদী জাতীয় নির্বাচনে জিতে গেল। তো এই নির্বাচনের হপ্তাকয়েক আগেও রক্ষণশীল দি ইকোনমিস্ট মোদীকে সমর্থন দিতে নারাজ ছিল এবং তাকে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার সাথে জড়িত একজন মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছিল।
মোদীর বিজয়মাল্য পরার পরপরই ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকাগুলোর সম্পাদকীয়তে মোদীর ২০০২-এর গুজরাটের হত্যাকাণ্ড (যা মোলায়েমভাবে ওরা দাঙ্গা নামে অভিহিত করে) অনেকাংশে দুর্ঘটনাবৎ পাদটিকা হিসেবে হাজির হয়েছে, যেন এর উল্লেখ করলে বা না করলে তেমন কিছু যায়-আসে না। অথচ ব্যবসাবাণিজ্যে বিবিধ শিল্পখাতে কত লভ্যাংশ বেড়েছে তাতে তাদের আগ্রহের কমতি নাই।
যাই হোক, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের এই ফলাফলকে (যে ফলাফলে দেখা যায় ৭০ শতাংশ ভোটার বিজেপিকে ভোট দেয়নি) পশ্চিমা গণমাধ্যম এমনভাবে সমর্থন যোগাবে তা প্রত্যাশিত ছিল। সমস্যা হল মোদীর এই বিজয়কে চূড়ান্ত নিরোপনিবেশায়ন বা ঔপনিবেশিকতামোচনের মুহূর্ত হিসেবে উল্লেখ করাটা; এক ব্রিটিশ পত্রিকার সম্পাদকীয় মতে তো মোদীর বিজয়ের এই দিনেই ব্রিটেন চূড়ান্তভাবে ভারত ছেড়ে গেল।
উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতি
বস্তুত মোদীর এই নির্বাচনী বিজয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের ঔপনিবেশিকতামোচনের শ্লথ ও জটিল প্রক্রিয়া আগেভাগেই আটকে গেল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকাঠামোর গণ্ডির মধ্যেই এই ঔপনিবেশিক জাতির চিরদিনের মত রয়ে যাবার বন্দোবস্ত হয়ে গেল।
সামষ্টিক কল্যাণের নতুন কোন ধারণা দেওয়া তো দূরে থাক, মোদির ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মূলত ভারতে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত সাম্রাজ্যবাদী ভাবাদর্শ প্রচার করছে এবং তা ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া সেই কদর্য সভ্যতাসম্পর্কিত ধ্যানধারণা এবং দমনপ্রবণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সফলতা জন্য আক্ষরিকভাবে নির্ভর করে। এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে পড়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধচারীদের আইন করে অপরাধী ঘোষণা দিতে পারার আইনসমূহ, সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আইনসমূহ, যেসব এই উগ্র হিন্দু ডানপন্থীরা সাগ্রহে অবলম্বন করছে; সর্বোপরি মোদি নতুন কোনো অর্থনীতি উপহার দেয়নি, সে পশ্চিমাদের দেওয়া মাপকাঠিতে উন্নতি মাপে এবং তার বৈধতার জন্যে পশ্চিমাদের দিকে চেয়ে থাকে।
হিন্দুত্বের এই ভাবাদর্শ বস্তুত এ-দাবি করে যে, বহুধর্মের ও বহুজাতিগোষ্ঠীর ভারতরাষ্ট্র মূলত একটি হিন্দু রাষ্ট্র, যে ধারণা প্রথমত জেগেছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে; কারণ ব্রিটিশরা তাদের জাতিগত ও সভ্যতাগত শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়ে তাদের উপনিবেশায়নের বৈধতা দিতে চেয়েছিল। ঔপনিবেশিক আমলে জাতিগত এই আধিপত্য-পরম্পরার উর্ধ্বে ছিল ব্রিটেন; যার দোহাই পেরে তারা অন্য নানান কিসিমের জাতিগোষ্ঠীকে শাসন ও সভ্য করার প্রকল্পকে বৈধতা দিতে পেরেছিল।
হিন্দুপুনর্জাগরণের এই বিবিধ ধারাগুলো (যে ধারাগুলো আজকের উগ্র হিন্দুবাদীদের বীজবপন করেছিল) উপনিবেশায়নের ক্ষতকে উপশম করতে চেয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের আর্শিতে নিজেদের পেশীবহুল, আগ্রাসী,পৌরুষদীপ্ত, উৎকৃষ্ট ও অপরাজেয় মূর্তি দেখার মধ্য দিয়ে।
গান্ধীর বহুত্ববাদ
হিন্দু ও মুসলমানদের জাতিসত্তা এতটাই আলাদা যে তাদের একীভূত করা সম্ভব না, এই উপনিবেশী ধারণাপুষ্টরা আজও মুসলমানদের দোষারোপ করে যে, তাদের কারণে আজ হিন্দুসমাজ দুর্বল ও পরাধীন এবং তাদের উপস্থিতির সুযোগে ব্রিটিশরা ভারতে উপনিবেশ গড়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু হিন্দুবাদের এই ধারাটা উপনিবেশামলে তেমন প্রতিরোধ গড়তে পারেনি; প্রতিরোধ গড়েছে গান্ধীর জাতিগত, ধর্মগত বহুত্ববাদ।
কিন্তু পৌরুষ ও সভ্যতাগত ঔৎকর্ষের ভিক্টোরীয় আকারের আদলে তৈয়ার এই আগ্রাসী এবং প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বীজ অবশ্য তখনই বোনা হয়ে গেছে। আজ এই অনুকারীর দলই ক্ষমতারোহী, যারা ঔপনিবেশিক রেটোরিকের পুনর্জাগরণ ঘটাচ্ছে। যে রেটোরিক অনুসারে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু--- ‘ঊন-প্রজাতি’দের স্ব-স্ব জায়গায় আবদ্ধ করে বহাল রাখা উচিত এবং সরকারের কর্তৃত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এমন যেকোনো উপজাতীয় প্রতিরোধ বা জাতীয় আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করা উচিত। উপনিবেশী রাষ্ট্রব্যবস্থার আকার বদলানো দূরে থাক, মোদীর শাসন সে ব্যবস্থার কদর্য দিকগুলোর তীব্রতা আরো বাড়াতে পারে, যেমন ক্রমবর্ধমান সমরায়ন।
একটি প্রভুত্বপরায়ণ রাষ্ট্র এবং একজন সর্বজ্ঞ নেতার শাসন শুধু অতীতের ঐতিহাসিক সংগঠন নয়। এখন তা ভারত ও অন্যত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যে উত্তরাধিকার আছে তার স্বার্থে ব্যবহৃত হতে বাধ্য হবে। এটাকে বলা যায় বহুজাতিক কর্পোরেশন (নিক রবিন্স দেখিয়েছেন যে, এই ধরনের কর্পোরেশনের একটি প্রথম দিককার উদাহরণ হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) ও কোটিপতি বেনিয়াদের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার।
আসলে এটা পরিষ্কার নয় যে কিভাবে বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বঙ্কিম পথে ভারতের এই ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ ও একত্রীভবন, যা মোদির স্বপ্ন, ঔপনিবেশিক যুগের সমাপ্তিতে অবদান রাখবে। আসলে মোদীর এই ক্ষমতাগ্রহণ উপনিবেশবাদবিরোধী লেখক ফ্রাঙ্ক ফাঁনো-কথিত সাদা পুঁজিপতির স্থলে বাদামি পুঁজিপতিকে অভিষিক্ত করার চেয়ে আদৌ বেশি কি আর অবদান রাখবে?
যাই হোক, শোষণের এই রঙচঙে ছবির প্রান্তে তারা কিন্তু থেকেই যাবে যারা থেকে গিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকাঠামোর প্রান্তে---খনি ব্যবসায়ীদের জায়গা ছেড়ে দিতে নিজের বসতবাড়ি-ভিটেমাটিহারা আদিবাসীরা; রপ্তানিযোগ্য সস্তা দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করতে ঘামঝরানো শ্রমিকরা; প্রান্তিক কৃষকরা যারা মধ্যস্বত্বভোগীর দাপটে ও ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা বইতে না পেরে আত্মহত্যা করে এবং লক্ষ লক্ষ শহুরে বস্তিবাসী যারা দুঃস্থ জীবন যাপন করছে অবস্থাপন্ন বৈশ্বিক মধ্যবিত্তদের সেবা করতে গিয়ে।
সত্যিকার ঔপনিবেশিকতামোচন
পশ্চিমা সাংবাদিকরা মোদীর বিজয়মুহূর্তকে যখন সারাবিশ্বের হতভাগ্যদের মুক্তির মুহূর্ত হিসেবে উদযাপন করে এই ভেবে যে আজকের পরে তারা তাদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভকে ভাষা দিতে পারবে, তখন তা অর্থহীন হাস্য সঞ্চার করে, আরও অর্থহীন মনে হয় মোদীর বিজয়-মুহূর্তকে সাম্রাজ্যবাদের নিশানা নিশ্চিহ্ন করার মুহূর্ত হিসেবে উদযাপন করলে; কারণ এই উদযাপন পষ্টতই স্বার্থসঞ্জাত এবং ভাবাদর্শিকভাবে বঙ্কিলতা ও ক্রূরতার পরিচায়ক।
সবচে জঘন্য ব্যাপার হলো, তাদের এই পিঠ চাপড়ানোটা (এ অভ্যাসটাও তারা সাম্রাজ্যবাদী অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে; পশ্চিমা গণমাধ্যমের একাংশ যা আজও ছাড়তে পারে নাই) বোঝায় যে, মোদীর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন এবং তাঁর হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্বের রেটোরিক (যা তাঁর অনুসারীরা সহিংসতার সাথে চর্চা করে) ততটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবাবার নয়, বরং গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে যে মোদীর রাজনীতি বড় বেনিয়াদের ব্যবসাবান্ধব এবং সে গরিবদের সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থানের জন্য অর্থের যোগান দিতে রাজি নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে উদারনৈতিক ও মূলধারার রক্ষণশীল উভয়েই দূর ডানপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো যথা চা-চক্র আন্দোলন ও ইউনাইটেড কিংডম ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টিকে যে আতঙ্কের সাথে স্বাগত জানালো তা তাদের ফ্যাসিবাদী ভাবাদর্শ ও জাতিবিদ্বেষী সংগঠনের পরিচয় বহন করে । তাই যতই তারা লোকরঞ্জনবাদী হোক, শেষতক পশ্চিমা গণতন্ত্রের ভাবাদর্শ-পরিপন্থী।
উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত কি তার নৈতিক ও রাজনৈতিক মানদণ্ড খাটো করবে? যদি করে তা কি তা অপশ্চিমা বলে, নাকি ব্যবসাবাণিজ্যে লাভের লোভের আশায়? যতদিন এই কদর্য আপেক্ষিকতা এবং হীন প্রয়োগবাদিতা বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করবে ততদিন বিশ্বের কোথাও, বিশেষ করে ভারতে, সত্যিকারের উপনিবেশায়নমোচন কাঙ্ক্ষিত হলেও দূরাশাই রয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময় ১৮০৫ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৪