এক. কম্পিউটার বিজ্ঞানে অস্ট্রিচ এলগরিদম নামে একটি বিখ্যাত এলগরিদম রয়েছে। এই এলগরিদমটি এসেছে অস্ট্রিচ বা উট পাখির একটি বিচিত্র অভ্যাস সম্পর্কে সাধারণ একটি ভুল ধারণা থেকে।
মূলত উটপাখী সংক্রান্ত এই ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করেই অস্ট্রিচ এলগরিদম নামটি এসেছে।
অস্ট্রিচ এলগরিদমের কাজ কি? এর কাজ হল সমস্যাকে সমাধান না করে তাকে উপেক্ষা করা, অস্বীকার করা।
কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি মূল ভিত্তি হল যুক্তি। তাই এই শাস্ত্রে কোনো সমস্যাকে অবজ্ঞা বা অস্বীকার করা হবে এটা মেনে নেয়া মুশকিল।
তাহলে আসল ঘটনাটা কি? আসলে, কম্পিউটার বিজ্ঞানে এই এলগরিদমের ব্যবহারের পিছনে বিজ্ঞানের থেকে বেশী কাজ করেছে প্রকৌশল শাস্ত্র। প্রকৌশল বিদ্যার একটি মূলনীতি হল এই যে, আপনাকে কোনো সমস্যার সমাধানের সময় অর্থনৈতিক এবং প্রায়োগিক বিষয়গুলিও বিবেচনাতে আনতে হবে।
এই প্রসঙ্গে একটি বহুল ব্যবহৃত গল্পও আছে। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও সেটি আগে বলে নেই।
গল্পটি একজন গণিতবিদ এবং একজন প্রকৌশলীর পার্থক্যকে নিয়ে। একজন গণিতবিদকে পাই এর মান জিজ্ঞেস করলে তিনি দশমিকের পরে বলতেই থাকবেন; থামতে পারবেন না। আর একজন প্রকৌশলী প্রথমে হয় জিজ্ঞেস করবেন অথবা নিজেই নির্ধারণ করে নিবেন যে আলোচ্য কাজের জন্য দশমিকের পর কতঘর পর্যন্ত পাই এর মান জানা দরকার।
যাক আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বলছিলাম যে অস্ট্রিচ এলগরিদমটি যে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয় তার পিছনে আসলে রয়েছে প্রকৌশল শাস্ত্র।
ধরা যাক আপনি একটি কম্পিউটিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করছেন। আপনি জানেন যে, এই সিস্টেমটি চলার সময়, এমন একটি সমস্যা আসতে পারে যার সমাধানের ব্যবস্থা রাখতে গেলে অনেক কম্পিউটিং রিসোর্স খরচ হবে। কিন্তু এই সমস্যাটি আসার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়।
এখন আপনি কি করবেন? সমস্যাটি সমাধানের ব্যবস্থা রাখবেন (এবং অনেক কম্পিউটিং রিসোর্স খরচ করবেন), নাকি, যেহেতু সমস্যাটি আসার সম্ভাবনা একদমই নেই বললেই চলে, সেহেতু সমস্যাটি আসবে না ধরে নেবেন?
এই ধরণের বিশেষ ক্ষেত্রেই আসলে অস্ট্রিচ এলগরিদমের ধারণা কাজে লাগে।
দুই: প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা নিয়ে আমরা অস্ট্রিচ এলগরিদম এর ধারণা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে প্রয়োগ করে চলেছি। ব্যাপারটা যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে প্রায় সবক’টি পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। এতে এতো সমস্যা হবে যে তার থেকে বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে অবজ্ঞা করা অনেক ভাল। তাছাড়া পিএসসি এবং জেসসিতেও এই এলগরিদম প্রয়োগ করে ভাল ফল পাওয়া গেছে। কেউ খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেনি। সবার ফলাফল বেশ ভাল হয়েছে। মাধ্যমিকও পার হয়ে গেল। এখন উচ্চমাধ্যমিকে এসে একটা ছোটখাট ঝামেলা হয়ে গেছে। ঝামেলার শুরু করেছেন আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যার। তিনি যেই মুহূর্তে নিজে প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পেয়েছেন সে মুহুর্ত থেকে এই বিষয়টির পিছনে উঠে পড়ে লেগেছেন। মনে হচ্ছে যেন প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তিনি একাই একটা যুদ্ধ শুরু করেছেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিন: আমাদের এখন সকলের দায়িত্ব হল স্যারকে এই যুদ্ধে সংগ দেয়া। আমাদের বুঝতে হবে যে, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের মত বিষয়ে প্রকৌশলী (বা কৌশলী) হলে চলবে না। এখানে আমাদের গণিতবিদই হতে হবে। যারা সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা মনে করে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন না দেখে পরীক্ষা দিয়েছে, তারা খারাপ ফলাফল করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভাল সুযোগ হারাবে আর যারা সহজ পথটি নিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে প্রস্তুতি নিয়েছে তারা পরীক্ষায় ভাল করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভাল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে এটি আমরা কিভাবে মেনে নিতে পারি?
আমরা তাহলে আমাদের উত্তরসূরীদের কি নৈতিক শিক্ষা দিচ্ছি? এটি হতে পারে না। জাফর স্যার চেষ্টা করছেন। আসুন আমরা তাকে সমর্থন দেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সম্মানিত শিক্ষকশিক্ষিকাগণকে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। যেভাবেই হোক আমাদের কোনো একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থানে আসতে হবে।
আমার তো মনেহয় এই বার আমাদের উচিৎ হবে উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার ফলাফলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় একদমই ব্যবহার না করা। নিশ্চিতভাবেই এতে অনেক ঝামেলা হবে, যে সমস্যাগুলি আসবে তার সমধান যে কি হবে, তা এই মুহূর্তে আমার মাথায় নেই। কিন্তু তাই বলে এটুকু নিশ্চিত যে এক্ষেত্রে অস্ট্রিচ এলগরিদম চালানো যাবে না।
[আর ভবিষ্যতে যাতে প্রশ্ন ফাঁস না হয়য় সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থাও নিতে হবে। এই বিষয়ে আমার শ্রদ্ধেয় কায়কোবাদ স্যারের প্রদত্ত সমাধান গ্রহণ করা যেতে পারে। ]
বাংলাদেশ সময় ০৯৫৫ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৪