মাস খানেক আগে নতুন একটি টেলিভিশনে কর্মরত এক সহকর্মীকে জিঙ্গেস করলাম, কেমন চলছে? সে বললো গতানুগতিক। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জানতে চইলাম তাদের হাউসে কাজের চাপ কেমন, কতজন সাংবাদিক? উত্তর শুনে একটু থমকে গেলাম, জানতে চাইলাম নারী সাংবাদিক কয়জন? আবারও একটা ধাক্কা খেলাম, কারণ বিশাল এক সাংবাদিকবাহিনিতে দুই একজন শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক ছাড়া, নারীর প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে।
গতবছর নারী সাংবাদিকতা বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় তথ্যমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, সরকার যেন নতুন একটা আইন করে যাতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক নারী সাংবাদিক নিয়োগ দিতে বাধ্য থাকে। কারণ আমাদের দেশে নতুন কিংবা পুরোনো অনেক টেলিভিশন চ্যানেলেই নারী সাংবাদিক নিয়োগ করার বিষয়ে একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে, যে কারণে আপনি হয়ত সেসব চ্যানেলে কখনো কোনো নারী সাংবাদিকের প্রতিবেদন দেখতে পাবেন না। চ্যানেলগুলো আন্তর্জাতিক মানের হতে চায়, কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ‘ইকুয়েল অপরচুনিটি এমপ্লয়ার’ কথাটি প্রায়ই উল্লেখ করা। এর অর্থ হয়তো আমাদের চ্যানেলগুলোর কর্তাব্যক্তিরা বোঝেন না। এখন মূল প্রসঙ্গে আসি, টেলিভিশনে নারীকে কিভাবে পণ্য বানানো হচ্ছে? যেসব চ্যানেলে নারী সাংবাদিক নেই বলে আমি হাহাকার করছিলাম, সেসব চ্যানেলেই আবার নারী উপস্থাপকের সংখ্যা দেখলেই আপনি ভিমড়ি খেয়ে যাবেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নারী উপস্থাপকরা খবর পরিবেশন করছেন; তাদের সাথে কখনও পুরুষ উপস্থাপক থাকছে, কখনও আবার থাকছে না। শুধু একজন পুরুষ উপস্থাপক খবর পড়ছেন, সেই চিত্র খুবই কম দেখতে পাবেন। আমার প্রায়ই মনে হয় ছেলেদের বোধহয় উপস্থাপক হবার যোগ্যতা কম, সেজন্য টিভিতে নারী উপস্থাপকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি যোগ্যতার বিচারে নারীদের উপস্থাপক বানানো হচ্ছে। যদি তাই হবে, তাহলে গ্রাজুয়েশনও শেষ করেনি এমন মেয়েদের অন্তত দেখা যেত না টেলিভিশনের পর্দায় খবর পড়তে। আবার একজন সাংবাদিক নিয়োগের সময় দেখা যায় কয়েক ধাপে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার বিচারে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সুন্দর একটা চেহারা থাকলেই যে কাউকে উপস্থাপকের চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হয়। সে যে খবর পড়ছে, তা সে আদৌ বোঝে কি না, বা সংবাদটি সম্পর্কে, দেশ, রাজনীতি নিয়ে আদৌ কোনো ধারণা তার আছে কি না এসব বিষয় খুব কমই বিচার করা হয়।
এইসব নারী উপস্থাপকদের আদৌ একজন পেশাজীবী হিসেবে বিচার করা হয় কি না, সে প্রসঙ্গে আসা যাক। আমার জানা মতে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে উপস্থাপকদের দুইভাবে বেতন দেয়া হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে প্রতিটা বুলেটিনের জন্য আলাদা সম্মানী দেয়া হয়, তাদের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের অভাবটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। এখন অবশ্য অনেক চ্যানেলই অন্যান্য কর্মীদের মতো মাস শেষে উপস্থাপকদের বেতন দেয়। এইসব ক্ষেত্রে আবার উপস্থাপকদের বেতন চোখ কপালে তোলার মতো। হয়তো দেখা যায় একজন সাংবাদিক দিনে আট-নয় ঘণ্টা কাজ করে যে বেতন পাচ্ছে, একজন উপস্থাপক মাত্র একঘণ্টার একটা বুলেটিন পড়েই তার চেয়ে তিন-চার গুন বেতন পাচ্ছে। আবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যাক্তিরাও যেখানে দিনে অন্তত দশ বারো ঘণ্টা কাজ না করে অফিস থেকে বিদায় নিতে পারেন না, সেখানে উপস্থাপক হওয়া এতই আরামদায়ক একটা পেশা যে কেবল এক ঘণ্টার একটা বুলেটিনে খবর পড়েই মাসে সত্তর-আশি হাজার টাকা বেতন কামিয়ে নিচ্ছেন উপস্থাপকরা।
মানব সম্পদের এই যে বিশাল অপচয়, তা রোধ করার চিন্তা কখনও চ্যানেলগুলোর কর্তা ব্যক্তিদের মাথায় আসে কি না তা আমার জানা নেই। অথচ প্রায়ই শোনা যায় অর্থাভাবে অনেক টেলিভিশন সময় মতো কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না। অন্যদিকে, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রোডাকশন বিভাগের কর্মীগণ অনেক বেশি অবহেলিত। বছরের পর বছর তারা টেলিভিশনে কাজ করছেন, কিন্তু যথেষ্ট সুন্দর চেহারা, সাবলীল বাচনভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও এদের টেলিভিশনের পর্দায় আসার কোনো সুযোগ নেই। অথচ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রোডিউসাররা খবর পড়ছে, প্রোডিউসাররা সাংবাদ সংগ্রহ করছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে সাংবাদিক, উপস্থাপক এবং প্রোডিউসারের কাজ অভিন্ন কিছু নয় এবং এরা সব কাজ করারই যোগ্যতা রাখেন। যেসব টেলিভিশন ঠিকমতো কর্মীদের বেতন দিতে পারেন না, তাদের কি একবারও মাথায় আসে না যে, উপস্থাপকদের দিয়ে যদি সাংবাদিকতা করানো না-ই যায়, তবে তাদেরকে দিয়ে অন্তত প্রোডাকশনের কাজগুলো করিয়ে নেয়া যায়। তাতে করে অন্তত তাদের যে বেতন দেয়া হয়, তার সদ্ব্যবহার করা সম্ভব এবং টেলিভিশনের ব্যয় কমানো সম্ভব। যে মানুষ একটি মাত্র বুলেটিনে খবর পড়ে বাসায় চলে যাচ্ছে, তাকে দিয়ে অনায়াসে কয়েকটি বুলেটিন প্রোডিউস করানো সম্ভব। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে বাইরে থেকে কয়েকজন গৃহিণী বা অন্য পেশার লোক দিয়ে সংবাদ না পড়িয়ে অনায়াসে প্রোডিসার বা রিপোর্টার দিয়ে উপস্থাপনার কাজ করানো সম্ভব। যারা সারাদিন ধরে সংবাদটি সংগ্রহ করছে বা বুলেটিন প্রোডিউস করছে, সেই সংবাদ উপস্থাপনের জন্য তো দু-চারজন গৃহিণী বা অন্য পেশার কাউকে ধরে আনার তো কোনো কারণ দেখি না। বরং এই চর্চা গণমাধ্যমের অপেশাদারিত্বকেই শক্তিশালী করে।
....................................................
অনেকেই মনে করেন নারীরাই পণ্য হতে বেশি আগ্রহী, কারণ তাদের তো জোড় করে কেউ পণ্য বানাচ্ছে না। কিন্তু আমি তাদের সাথে একমত নই। কারণ, এত অল্প পরিশ্রমে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন যোগ্যতায় যদি কাউকে এত বেশি বেতন দেয়া হয়, তবে যে কেউই সেই পেশা গ্রহণ করতে চাইবে। তাছাড়া সবাই তো আর টেলিভিশনে নিজের চেহারা দেখানোর লোভ সামলাতে পারে না। যেসব টেলিভিশনে নারী সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া হয় না, সেখানে যদি পুরুষদের দিয়েই উপস্থাপনা করিয়ে দর্শক ধরে রাখা যেত, তবে তারা কখনই উপস্থাপক হিসেবে নারীদের নিয়োগ দিত না। এসব ক্ষেত্রে নারীর রূপকে পুঁজি করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্যবসা টিকিয়ে রাখা বা সম্প্রসারণ করার নীতি বা কৌশলটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আর এ কারণেই পুরুষতান্ত্রিক গণমাধ্যম নারীকে পণ্য বানিয়েছে।
....................................................
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই চর্চাই বাংলাদেশের বেশিভাগ টেলিভিশন চ্যানেলে চলছে। একজন সাংবাদিক আট-নয় ঘণ্টা কাজ না করে অফিস থেকে বিদায় নিতে পারেন না, অথচ কয়েকগুণ বেশি বেতন পেয়েও উপস্থাপকদের কর্মঘণ্টার হিসেব রাখেন না কেউ। ফলে একদিকে যেমন একই প্রতিষ্ঠানেরই কর্মীদের মধ্যে কর্মঘণ্টার বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি মানবসম্পদের একটা বিশাল অপচয় করা হচ্ছে। কর্মঘণ্টার বিচারে উপস্থাপকদের তুলনায় টেলিভিশনের অন্য কর্মীদের সাথে অবিচারও করা হচ্ছে। এত উচ্চমূল্যের বেতনে তারা যে আহামরি কোনো কাজ করছে, তাও তো নয়। উপস্থাপকরা দেখা যায় খবর শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে এসে মেক আপ নিয়েই খবরটা পড়তে বসে যান। একারণেই হয়তো অনেক ক্ষেত্রে অটোকিউ কাজ না করলে, উপস্থাপকের মুখ থেকে দুই/চারটা লাইন বের করারও কোনো উপায় থাকে না, স্ক্রীনে ফ্রীজ হয়ে থাকেন; যে কাজটি একজন সাংবাদিক অনায়াসে করতে পারেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কেন টেলিভিশনে উপস্থাপক—বিশেষ করে নারী উপস্থাকদের দিয়ে এভাবে কাজ করানো হচ্ছে। এর একটাই উত্তর হতে পারে, যেহেতু তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রূপ ও সৌন্দর্য্যই প্রধানতম যোগ্যতা, অতএব টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দর্শকদের টানতেই সুন্দরী উপস্থাপকদের ব্যবহার করছে। ফলে টেলিভিশনে সুন্দরী নারী উপস্থাপকদের পণ্য ছাড়া আর কিছুই ভাবার উপায় নেই। কারণ কিছু টেলিভিশন তো আবার নারী সাংবাদিক নিয়োগ করতে আগ্রহী নয়, অন্যদিকে চেহারা দেখানোর জন্য তারা ঠিকই নারী উপস্থাপকের বিকল্প ভাবতেই পারেন না। বিবিসি, সিএনএন-এ প্রায়ই দেখা যায়; অনেক বয়স্ক, মোটা, কালো আফ্রিকানদের দিয়ে খবর পড়ানো হচ্ছে আর বাংলাদেশের টিভি দেখলে মনে হয় সুন্দরী, কচিকাচা উপস্থাপিকার মেলা।
গণমাধ্যমে নারীরা নিজেই পণ্য হচ্ছে নাকি নারীদের পণ্য বানানো হচ্ছে তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেকেই মনে করেন নারীরাই পণ্য হতে বেশি আগ্রহী, কারণ তাদের তো জোড় করে কেউ পণ্য বানাচ্ছে না। কিন্তু আমি তাদের সাথে একমত নই। কারণ, এত অল্প পরিশ্রমে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন যোগ্যতায় যদি কাউকে এত বেশি বেতন দেয়া হয়, তবে যে কেউই সেই পেশা গ্রহণ করতে চাইবে। তাছাড়া সবাই তো আর টেলিভিশনে নিজের চেহারা দেখানোর লোভ সামলাতে পারে না। যেসব টেলিভিশনে নারী সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া হয় না, সেখানে যদি পুরুষদের দিয়েই উপস্থাপনা করিয়ে দর্শক ধরে রাখা যেত, তবে তারা কখনই উপস্থাপক হিসেবে নারীদের নিয়োগ দিত না। এসব ক্ষেত্রে নারীর রূপকে পুঁজি করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্যবসা টিকিয়ে রাখা বা সম্প্রসারণ করার নীতি বা কৌশলটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আর এ কারণেই পুরুষতান্ত্রিক গণমাধ্যম নারীকে পণ্য বানিয়েছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী। বর্তমানে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে কর্মরত।