ঢাকা: অবশেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বরাতে একথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে সংগঠন হিসেবে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকারের কোনো ইচ্ছা নেই।
২৯ মে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে তিনি এই বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন।
যে ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় চারপাশে শোনা যাচ্ছিল, গত কয়েক মাসের বিভিন্ন লক্ষণে যে কালো ছায়ার অস্তিত্বকে ধারণা করা যাচ্ছিল, গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে যেভাবে আদাজল খেয়ে বিভিন্ন পক্ষ আর বিভাজন তৈরির নোংরা খেলা শুরু হয়েছিল তার কারণ এখন স্পষ্ট হচ্ছে।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে সে কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক কোনো দেনদরবার হয়তো পর্দার আড়ালে সম্পন্ন হয়েছে। এই ধরনের শংকা সবাইকে উদ্বিগ্ন করার জন্য যথেষ্ট।
আমরা সকলেই জানি, জামায়াত-শিবিরকে রক্ষার উদ্দেশ্যে আইনমন্ত্রী মোড়ক হিসেবে যে বক্তব্য প্রচার করেছেন তার সারবত্তা নেই। আইনমন্ত্রী জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে ৩টি প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রথমটি হচ্ছে,"আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এ সংগঠনের শাস্তির বিধান নেই। " আমাদের সতীর্থ আইনবিদ অ্যাক্টিভিস্টরা এই ধরনের কথায় বিস্মিত।
প্রথম কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ এর ৩(১) ধারাটিতে " individual or group of individuals" কথাটি ছিল। এখানে গ্রুপ অব ইন্ডিভিজ্যুয়ালস কথাটির পরে ২০১৩ সালে যখন গণআন্দোলনের সময় আইনটির সংশোধন করা হয়, যা ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে প্রযোজ্য হবে, তখন "or organisation," কথাটি যুক্ত করে আরো পরিষ্কারভাবে সংগঠনকে ট্রাইব্যুনালের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। এবং ট্রাইব্যুনাল যদি বিচার করতে পারেন, তাহলে তারা শাস্তিও দিতে পারেন, এই সহজ বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। একই ধারায় এরপরে যেসব অপরাধের বিচারের কথা ট্রাইব্যুনালের আওতাধীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে সংগঠন হিসেবে দায় নেয়াকে বিবেচনা না করার কোনো তর্কের অবকাশ নেই। এখন আইনমন্ত্রী যেভাবে বলছেন যে, একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে রায় কী হবে সেটি উল্লেখ নেই, সেখানে আইনের ২০(২) ধারায় বলা আছে যে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের বিবেচনায় যে কোনো উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করতে পারেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই আইনে মৃত্যুদণ্ডের কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হলেও আজীবন কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা অন্য কোনো কারাদণ্ডের মেয়াদ উল্লেখ নেই। অথচ আমরা দেখেছি বিভিন্ন অপরাধীদের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল তাদের সুবিবেচনা প্রয়োগ করে এ রকম শাস্তি দিয়েছেন। সেটা যেভাবে আইনের ব্যত্যয় ঘটায় না, একইভাবে সংগঠনের শাস্তির ব্যাপারটিও বিজ্ঞ ট্রাইব্যুনালের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিতে হবে।
আইনমন্ত্রী দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে বলেছেন, জামায়াতের নিবন্ধনের ব্যাপারে একটি মামলা ইতোমধ্যে আপিল বিভাগে থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের আইনে কোনো অভিযোগ আনা হলে ওই মামলায় কোনো প্রভাব পড়বে কি না, সেটা দেখতে হবে।
একজন সুবিজ্ঞ আইনবিদের মুখে এরকম যুক্তি শোনামাত্রই বুঝা যায় যে আসলেই জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে কোনো মামলা পরিচালনা করার কোনো ইচ্ছাই সরকারের নেই।
জামায়াতের নিবন্ধনের মামলা আর ট্রাইব্যুনালের মামলা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কারো বিরুদ্ধে একটা চুরির মামলা আছে বলে তার নামে আরেকটা হত্যা মামলা কি দায়ের করা যায় না? আইনমন্ত্রী কি তখন বলবেন যে অন্য একটি মামলায় প্রভাব পড়বে বলে গুরুতর অপরাধের জন্যও এখন মামলা করা যাবে না? এরকম অসার যুক্তি একমাত্র রাজনৈতিক ধোঁয়াশা সৃষ্টির জন্যই বলা সম্ভব। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের মামলার সঙ্গে অপরাধী সংগঠন জামায়াতের মামলার কোনো সংশ্রব নেই। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলেও তারা অনিবন্ধিত দল হিসেবে রাজনীতি করতে পারবে এবং এমনকি জোটভুক্ত অন্য মার্কা নিয়ে নির্বাচনও করতে পারবে। নিবন্ধন বাতিলের মামলা রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনকানুন মানায় জামায়াতের বর্তমান অবজ্ঞাকে অপরাধ বিবেচনার মামলা, এর সঙ্গে তাদের সাবেক কৃত পাপের কোনো সম্পর্ক নেই।
জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন যারা সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষণা দিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, তার শাস্তি তাদেরকে পেতেই হবে-অন্য ছোটখাটো মামলার অজুহাতে তাদেরকে পার পেতে দেয়া যাবে না।
আইনমন্ত্রী তৃতীয় যে যুক্তিটি তুলে ধরেছেন সেখানে তিনি বলছেন, জামায়াতের তৎকালীন নেতারা যেহেতু বিচারের আওতায় এসেছেন সেক্ষেত্রে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার হয়ে শাস্তি হলে সেই নেতাদের একাধিকবার শাস্তি পেতে হলে সেটি বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কী না সেটা বিবেচনা করতে হবে।
এটাও ধামাচাপা দেয়া একটা যুক্তি। তিনি কোম্পানি আইনের যে উদাহরণ টেনেছেন সেই একই যুক্তিতে বলা যায় যে কোম্পানি কিন্তু একটি আলাদা অস্তিত্ব, কোম্পানি দেউলিয়া হলে তার কর্মকর্তা-কর্মচারী দেউলিয়া ঘোষিত হন না। তাই কর্মকর্তা-কর্মচারী-মালিকের দায় এবং কোম্পানির অস্তিত্বকে আলাদা বিবেচনা করতে হয়।
যাই হোক, এই লেখার উদ্দেশ্য আসলে আইনমন্ত্রীর কথার বাক্য ধরে ধরে পাল্টা যুক্তি দেয়া নয়। আমি আইনবিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চে আমাদের অনেক তরুণ আইনবিদ বন্ধুরাও আইনের এই অপব্যাখ্যায় হতাশ। আর আমরা বাকিরা হতাশ আসলে এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে।
আজকে আইনমন্ত্রী যে আইনটিকে অসম্পূর্ণতার দোহাই দিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা করতে অস্বীকার করছেন, সেই আইনটি তাদের সরকারের ক্ষমতাসীন সময়েই সংশোধন করা হয়েছে। সংসদে অনেক বিজ্ঞ আইনপ্রণেতার চুলচেরা বিশ্লেষণের সামনে দিয়ে আইনটি পাশ হয়েছে। এর পরে দীর্ঘদিন ধরে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের আরো দক্ষ আইনজীবীরা এই আইনটিকে বিবেচনা করেই অভিযোগপত্র তৈরি করেছেন। কোথাও কখনোই এটা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেনি। এখন আইনমন্ত্রী যখন সমস্যার কথা বলছেন, সেটির পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কতটুকু আর ভ্রান্তি কতটুকু সেটি বিবেচনার ভার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছেই থাকুক।
আমি শুধু একটি কথা দিয়েই শেষ করতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করার জন্য রায় দিয়েছে। এই বিচার সম্পূর্ণভাবে শেষ হতে হবে, কোনো খণ্ডিত বিচার জনমতের প্রতি অবজ্ঞা আর রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু হবে না। সম্পূর্ণ বিচার তাকেই বলবে যখন যুদ্ধাপরাধীদের ব্যক্তির, সংগঠনের, সহযোগী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোরও বিচার শেষ হবে। নইলে আগা কেটে গোড়ায় জল ঢালা হলে এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠনটি সবসময়ই বাংলাদেশ নামের শহীদের রক্তস্নাত দেশের বিরুদ্ধে, পতাকার বিরুদ্ধে তাদের নিরন্তর অপতৎপরতা চালিয়ে যাবে।
আইনমন্ত্রী বলেছেন যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করার সময় এখন নয়। আমরা জানতে চাই, তাহলে সময়টা কখন? এই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব না দিতে পারলে শহীদদের আত্মার অভিশাপ থেকে কেউই রেহাই পাবেন না।
লেখক: মুখপাত্র, গণজাগরন মঞ্চ
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৪