ঢাকা: ফেব্রুয়ারি মাসে রাত আটটার দিকে অফিসে ঢুকতেন কিশোর দা। দ্রুত ডেস্কের সামনে বসে লিখতেন বই মেলার সংবাদ।
সত্যি বিশ্বাস হয় না, কিশোর দা’র সঙ্গে আর দেখা হবে না।
২০০৯ সালের শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকর মারা যাওয়ার পর ভোরের কাগজের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক জহিরুল ইসলাম টিপু ভাই বলেছিলেন, ‘কাঁদতে কাঁদতে লেখবা’। এরপরের বছরই চলে যান টিপু ভাই না ফেরার দেশে।
বকরের মৃত্যুর ঘটনায় কাঁদতে কাঁদতে লেখা হয়নি। এবারে কিন্তু লেখা সত্যিই বেশ কষ্টের হয়ে উঠছে।
ভোরের কাগজ অফিসে শেষ দিকে আমি বসতাম আঙ্গুর নাহার মন্টি আপার চেয়ারে। এটা তৎকালীন চিফ রিপোর্টার রাশেদ ভাইয়ের টেবিলের পাশে। আমার ডেস্কের ঠিক ওপারের ডেস্কেই বসতেন কিশোর কুমার।
আমার কিছুদিন পরেই ভোরের কাগজে যোগ দেন কিশোর কুমার। একদিন মিটিংয়ে সম্পাদক শ্যামল দত্ত দা বললেন, ‘কিশোর এখন থেকে শিল্প-সংস্কৃতি বিট করবে’। কিশোর দা শুধু সংস্কৃতি নিয়ে লিখতেন যে তা নয়, এ বিষয়ে তিনি পড়াশোনাও করতেন। শিল্প সাহিত্যে তার জ্ঞান ছিল সত্যিই ঈর্ষণীয়।
এতো চুপচাপ আর শান্ত স্বভাবের ছিলেন কিশোর দা, আমার মাঝে মধ্যে তাকে দেখে মনে হতো, রিপোর্টিং তার জন্যে নয়। ভোরের কাগজে মিটিংয়ে খুব কম সময়ই কথা বলতেন তিনি। সকলের আড্ডায় অংশ নিতেন, তবে কথা থাকতো সীমিত।
ভোরের কাগজের রিপোটিং রুমে আড্ডা, নিচের হোটেলে চা-পুরি খাওয়া…। সত্যি বলেছিলেন টিপু ভাই, কাঁদতে কাঁদতে লেখা যায়!
২০১১ সালের জুনে চলে আসি বাংলানিউজে। এরপর মাঝে মধ্যে দেখা হতো।
২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত মারা গেলে সেটি কাভার করি আমরা একসঙ্গে। সুভাষ দত্তের বাসা, এফডিসি সবখানেই একসঙ্গে ঘুরি। তারপর জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে একসঙ্গে কাভার করি আব্দুর রহমান বয়াতির প্রয়াণের সংবাদ।
গত একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখা হয়েছিল। স্বভাবসুলভ জিজ্ঞাসা, ‘কিরে কেমন আছিস?’ তারপর মেলা নিয়ে অনেক গল্প আর আড্ডা। গত ৫ বছরের প্রতিটি বইমেলায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। ঘোরা, আড্ডার সঙ্গে সঙ্গে অনেক লেখক আর কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে নিয়মিত আড্ডা ছিল দাদার। অন্য শিল্প-সংস্কৃতি বিটের রিপোর্টার দীপন দা আর মনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গেই বেশি দেখতাম তাকে।
ডিআরইউ’র ক্যান্টিনে তারা সংস্কৃতি বিটের কয়েকজন রিপোর্টাররা একসঙ্গে খেতেন। ফাঁকা চেয়ার থাকলে আমিও বসতাম সেখানে।
ডিআরইউ’তে আমার বিচরণ কম। তবে এখন ডিআরইউ’র কথা মনে করতেই ভাসছে কিশোর কুমারের চেহারাও। বাগানে বসে চা খাচ্ছেন। গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় আমার সঙ্গে হাত মেলানো। তারপর সেই প্রশ্ন, ‘কিরে কেমন আছিস?’
শুনেছিলাম তিনি অসুস্থ। তবে না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার কথা জানতে পারি সোমবার সকালে। সহকর্মী স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ ভাই ফেসবুক খুলে বললেন, ‘নয়ন, কিশোর দা তো মারা গেছেন। ’ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সত্যি তাই হলো। কিশোর দা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
এরই মধ্যে সংবাদ মাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হলো, ‘সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী কিশোর কুমার আর নেই। তিনি রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৩৯ বছর। সোমবার রাতে ভোলার বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ভাওয়ালবাড়ীর শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তিনি শোকাহত মা, স্ত্রী, দুই ভাই, এক বোনসহ অসংখ্য আত্নীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
সারাদিনে ভোরের কাগজের কোনো সাবেক সহকর্মীকে ফোন দেইনি আর। কি বলবো? কি জানতে চাইবো?
কিশোর দা যে নেই, এটাইতো বিশ্বাস হয় না!
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৪