ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আমাদের অর্থনীতি ও বাজেট ২০১৪ ।। ইনাম আহমেদ চৌধুরী

. | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৩ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১৪
আমাদের অর্থনীতি ও বাজেট ২০১৪ ।। ইনাম আহমেদ চৌধুরী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এবার অত্যন্ত বড় রকমের বাজেট হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, ননরেভিনিউ এক্সেপেন্ডিচার এতো স্ফীত করা হয়েছে বা হচ্ছে যা দেখে মনে হচ্ছে এ সম্পর্কে সরকার সিরিয়াস নয়।

যেসব নাম্বার অফ প্রোডাক্টস এবং প্রোগ্রামস রাখা হয়েছে এডিপিতে, সেসব কিছুই রাখা হয়নি। তাছাড়া আমাদের রিসোর্সেস কোত্থেকে আসবে এ সম্পর্কেও স্পষ্ট কোনো হদিস নেই। বলা হচ্ছে যে, সব কিছু নির্ভর করবে আমাদের নিজস্ব সম্পদের উপর। আমার নিজস্ব সম্পদ কী? আমাদের নিজস্ব সম্পদ হচ্ছে করারোপ, কিন্তু তার অবস্থা এতো ভালো নয়। দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে বড় ইনফর্ম ব্যাংক। তৃতীয় উৎস হচ্ছে আন্তর্জাতিক বড় বড় ব্যাংকগুলো, যেমন— বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ইত্যাদি। এগুলো থেকে আমার যে লোন পেতাম তা এখন কম পাচ্ছি। বড় একটা প্রকল্পে তো বিশ্বব্যাংকের কোনো লোনই পেলাম না। আমরা যেসব লোন পেয়েছি সেগুলোরও সদ্ব্যাবহার করতে পারছি না এবং আমাদের এখনও ছাড় হয়নি এমন বহু তহবিল (fund) রয়ে গেছে।

বিদেশি ঋণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে যে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছি। কোথায় দাঁড়াচ্ছি, কীভাবে দাঁড়াচ্ছি তার কোনো উত্তর নেই। যত বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে, ততই আমাদের জন্য ভালো। কারণ বিদেশি ঋণ বলতেই অর্থ সাশ্রয় হওয়ার বিষয় আছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পর্যবেক্ষণ থাকে এবং কিছু তদারকিরও বিষয় আছে। যেমন— আমরা যখন যমুনা সেতু করি, তখন তারা এটার দেখভাল করেছিল। কারণ যারা ঋণ দিবে, অর্থাৎ বিনিয়োগ করবে তারা অবশ্যই প্রকল্পটির দেখাশোনা করবে। কেননা প্রকল্পটির সাফল্য-ব্যর্থতার উপর তাদের বিনিয়োগ দ্রুত ফেরত আসার বিষয়টি জড়িত। এখন তারা যদি এই সেতু নির্মাণে তদারকি না করতো, তবে সেই কাজটা করতো কে? আমাদের তো সে রকম এজেন্সি বা প্রতিষ্ঠান নেই। তারা তদারকি না করলে আমাদের নিজেদের তা করতে হবে। এখন তদারকির কাজটা যদি আমরা করতাম তাহলে প্রচুর দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা থাকতো, কাজের মানও অত্যন্ত খারাপ হওয়ার ব্যাপার ছিল। এ কাজের ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা দরকার সেটা তো আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিত করতে পারত না।

Farmer_smআমি দেশি বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক, দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করেছি। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে বলব, আমরা যদি বিদেশি ঋণের সদ্ব্যবহার করতে না পারি এবং আরো বেশি ঋণ আনতে না পারি তবে আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।

নির্বাচিত সরকার, গণতন্ত্র এবং সকল দল ও জনগণের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে না। এটা ছাড়া আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিও সম্ভব নয়। যত দিন যাচ্ছে ততই কিন্তু আমাদের উন্নয়ন তৎপরতা মন্থর হয়ে যাচ্ছে।

ব্যক্তিমালিকানাধীন বা অসরকারি যে সব প্রতিষ্ঠান, বিভাগ (sector) রয়েছে, সেগুলো ভালো করার চেষ্টা করে। অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই মূলত আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রবাসীদের প্রেষণ (remittance) বলি, প্রাইভেট সেক্টর, এনজি, ব্যক্তিগত পর্যায়ের উদ্যোক্ত বলি, এঁরাই কিন্তু আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশে এ খাতে প্রচুর অনুদান আসছে। কিন্তু কত টাকা কী বাবদ খরচ হচ্ছে, আমরা কী তার কিছুই জানি? সম্প্রতি আমরা দেখেছি যে, পাট ও টেক্সটাইলস মন্ত্রণালয় কতগুলো বিল এমনিতেই বিহিত করে দিয়েছে। অথচ এই অধিকার তাদের নেই। ওই কারখানায় অনেক সেফগার্ড মেশিন আছে। ওগুলো যাচ্ছেতাই দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম যে, মন্ত্রী বলেছে যে চট্টগ্রাম আমার শ্বশুর বাড়ির জায়গা, আমি ওখানকার দুহিতাকে বিয়ে করেছি, তাই আমি এটা দিয়ে দিচ্ছি। টেন্ডারের আর দরকার নেই, একে দেওয়া দরকার, দিয়ে দাও। এসব খামখেয়ালিপনা চলছে।

আমরা জানি না, কতটুকু কাজ পাবলিক সেক্টরকে দিতে হবে, কতটুকু প্রাইভেট সেক্টরকে দিতে হবে, কতটুকু কাজ পিপিতে (public procurement) হবে। সব বাজেটে আমরা শুনেছি পিপিকে বড় সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে পিপিতে একটা কাজও হয়নি। পিপি করার জন্য তো লোকের আত্মবিশ্বাস আসতে হবে। দুর্নীতির ভিতর দিয়ে তো আত্মবিশ্বাস অর্জন সম্ভব নয়। যে রকম বড় বড় দুর্নীতি চারদিকে হচ্ছে, এটা তো হয় না। আমাদের সামনে বিবেকের কথা আসছে, আইনের শাসনের কথা আসছে।

অবচয় ও দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য যেসব পেপারস ওয়ার্ক করা দরকার, নীতিমালা প্রণয়ন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেগুলো করা হচ্ছে না। ফলে এই বাজেটে আমি তেমন কোনো ভরসার জায়গা দেখছি না। এই বাজেট অর্থনীতি এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের অগ্রগতি আনবে বলে মনে হয় না। সব সময় বাজেটে যেসব কাজ করা হয় যেমন, গাড়ির দাম কমাবে অথবা বাড়াবে, কিছু ত্রাণ হবে কিংবা হবে না, বাহ্যিক কিছু প্রচেষ্টা করা হবে। আবার ভালো কিছু হতেও পারে। কিন্তু বিদ্যমান সমস্ত পরিস্থিতি উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্তরায়।

market_smআমাদের কেবিনেটে বলে দেয়া হলো যে, প্রবৃদ্ধি ৬.২। হয়ত তারা একটা পরিসংখ্যানও দিয়ে দিল। কিন্তু আগে এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক পরিসংখ্যান করে দেখেছে যে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬-এরও নিচে, ৫.৭ কিংবা ৫.৮%।

আমাদের দেশে কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই, এটা বড় এক সমস্যা। প্রধানমন্ত্রী মোদির শপথ অনুষ্ঠানে না গিয়ে জাপানে গিয়েছেন, আমি মনে করি এটা তাঁর অত্যন্ত ভালো সিদ্ধান্ত। ৫-৭ দিন আগেও জাপান বলেছে যে, দেশে একটা নির্বাচিত সরকার থাকুক; তারা কিছু সাহায্য দিবে। আমি জাইকার কথাই বলি না কেন। তারা বলছে যে, গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে, এবং অবশ্যই একটা স্থিতিশীল পরিবেশ থাকতে হবে। কেননা হয়ত কিছুদিন পরেই আবার আন্দোলন শুরু হবে, হরতাল-ধর্মঘট হবে, ভাংচুর, সহিংসতা হবে। বিএনপির চেয়ারপারসন তো বলেছেনই যে, আমাদের কথা বলার পরিবেশ যদি দেওয়া না হয় তবে আন্দোলন করা হবে। আর আন্দোলন শুরু হলে আমরা কেউই জানি না এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে। এই যে এখন একটা অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে, মানুষজন কিছুই বলছে না, এ অবস্থা তো আর বেশি দিন থাকবে না। মানুষ হতচকিত হয়ে কিছু দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। যে কোনো মুহূর্তে এই মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে।

বর্তমানে সমাজজীবনে যে অস্থিতিশীলতা চলছে, পাচঁ টাকার জন্য মানুষের পাঁচটা খুন করতেও বিবেকে বাঁধছে না, এসব পরিস্থিতির প্রভাব তো অর্থনীতিতেও পড়বে। এসব অনিশ্চিত এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে তো মানুষ বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছে না। ফলে এর প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামগ্রিক অর্থনীতি পড়ছে। এখন কিন্তু রফতানি কমেছে, আরএমজিও (readymade garments) কমেছে। গার্মেন্টস শিল্পও বিপর্যয়ের মুখে।  

আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বর্তমানে সবচেয়ে কম। এ বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৬.৫%, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর পরিমাণ প্রায় ২৫.২%। কম্বোডিয়ায়, ভিয়েতনামে যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি, ভারতে এর পরিমাণ হচ্ছে ১২.২%, এমনকি পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় ১১.৪%।

এখন পাঠকই বলুন, আমরা কোন অবস্থায় আছি। আমাদের অবকাঠামো (infrastructure) নেই, আমাদের আইনের সুশাসন নেই। এসবের ফলে তো বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে যায়। এরকম একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে কারো যদি ৫ কোটি টাকা থাকে, তাহলে সে কি পুরো টাকা বিনিয়োগ করবেন? আমাদের দেশের লোকই এখন বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না, বিদেশি লোক তো দূরঅস্ত।

এসব পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা চাই আগামী বাজেটে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প আরো বেশি হউক। সরকারের প্রচেষ্টারও সর্বোত্তম ব্যবহার হোক। তাছাড়া সব রাজনৈতিক দল মিলেমিশে করলে অনেক ভালো হতো। গণতন্ত্র মানেই কিন্তু সবার সমান অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা। মিলেমিশে না থাকলে, জাতীয় ঐক্য, একাত্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি কখনো এগুতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।

Inam_ahmed_01

 

 

 লেখক : সাবেক সচিব, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা

 

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।