ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নীল সাগরের অর্থনীতির স্বপ্ন

মোহাম্মদ আরজু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৮ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৪
নীল সাগরের অর্থনীতির স্বপ্ন

ভোলা জেলার 'সংস্কৃতিমনা' লোকেরা নিজেদের দ্বীপকে নানা উপলক্ষে 'সাগরকন্যা' নামে ডাকে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলে, কলেজে কিম্বা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নানা অনুষ্ঠানে তা-ই শুনেছি।

বলা হতো এভাবে, ‘তেতুলিয়া-মেঘনার মোহনা বিধৌত দ্বীপজেলা সাগরকন্যা ভোলা’ ইত্যাদি। তবে জননী সমুদ্রের সঙ্গে দ্বীপবাসীর খুব যে মমতার সম্পর্ক দেখে তা মনে পড়ে না, বরং কিছুটা সংস্কার, কিছুটা ভয় ও শঙ্কার সম্পর্কই।

হাইস্কুলে উঠলে সমুদ্র মানে মেঘনা-মোহনা দর্শনের সুযোগ মিলতো। শীত মৌসুমে স্কুল থেকে বনভোজনে যাওয়া হত জেলার যথাসম্ভব দক্ষিণে সমুদ্রের কাছাকাছি। অনেক বাবা-মাই বাচ্চাদের অনুমতি দিত না। সমুদ্রপাড়ের ভয়।

তেঁতুলিয়া নদীর খুব কাছেই আমাদের বাড়ি ছিল। উঠানের চল্লিশগজ পেরোলেই টইটুম্বুর খাল। খালপাড়ের রাস্তা ধরে মিনিট দশেক হাঁটলে তেঁতুলিয়া। সারা বছর খালে বাঁধা থাকতো সমুদ্রগামী মাছ ধরা ইয়াব্বড়ো ট্রলার। কেউ দুই খ্যাপের মাঝখানে বিরতিতে আছে, কেউ বা সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জেলে, সুকানি, ইঞ্জিন মিস্ত্রি, রাঁধুনি, মজুর সবমিলে পনের ষোলোজনের মাস খানেকের বা তারও বেশি সময়ের রসদপাতি নিয়ে যাত্রা।

জেলেদের মুখে শুনতাম আরো দক্ষিণে নানা ঘাটে নিয়মিত বিরতিতে ফিরতো তারা সমুদ্র থেকে। সেখানেই মাছের বিক্রি বাট্টা। তাদের পরিবার পরিজন বরাবরই উৎকন্ঠায় থাকতো। তাদের স্মৃতিতে তো ছিল, কত নিকটজন সাগরে ঝড়ে-ঝঞ্চায় হারিয়েছে। আবহাওয়ার খবর পেতে সামান্য ট্রানজিস্টর রেডিওটুকুও অনেকের ছিল না।

উপকূলীয় আর্থ-সামাজিক অবস্থার মধ্যে সাগরের প্রত্যক্ষ সম্পর্কের এই ন্যূনতম অবস্থার অভিজ্ঞতা নিয়েই উপকূল ছাড়ি। পরে সুন্দরবন থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত এলাকাগুলোতে যত গিয়েছি। উপকূলীয় অর্থনীতির মন্দাবস্থা ও নেতিবাচক রূপান্তরই চোখে পড়েছে।

বঙ্গোপসাগরে সার্বভৌম সমুদ্র সীমানার বাইরে বাংলাদেশের এ যাবৎ মীমাংসিত বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা রয়েছে এক লাখ ছিষট্টি হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায়।

সে তুলনায় সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহার আমাদের দেশে বেপরোয়া-নির্বিচার ও পরিবেশ বিধ্বংসী হলেও টেকসই নয়। সমুদ্র থেকে যে সামান্য সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে, তাও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে দীর্ঘমেয়াদে সামুদ্রিক পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে।

যথাশীঘ্র এখানে বেশ কিছু সুরক্ষিত জলাঞ্চল (মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া) ঘোষণা ও কার্যকর করা দরকার। এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য জলের তলে অভিযান-অনুসন্ধান ও জরিপ চালাত হবে। প্রবাল ছাড়াও অন্যান্য ধরনের জলজ বসতি নিশ্চিতভাবেই রয়েছে।

সমুদ্রের গভীরতা, তাপমাত্রা, জলের রাসায়নিক উপাদানের ধরন, বিদ্যমান জৈব উপাদান, খাদ্যানু্ ও স্রোতের বিভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে সাগরে নানা ধরনের প্রাণের বসতি তৈরি হয়। যেমন, বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণের নজিরের ওপর ভর করে বলা চলে, এখানে নানা অঞ্চলে অক্টোপাস, হাঙ্গরের পাশাপাশি নানা ধরনের স্নাপার ও গ্রুপার প্রজাতির মাছ, বিশেষত টুনা, সোর্ড ও ম্যাকারেলের বসতি রয়েছে। কিন্তু স্থান, মৌসুম ও প্রজাতির বিবেচনা না করে অপরিকল্পিত, নিয়ণ্ত্রণহীন ও নির্বিচার মাছ শিকারের কারণে বঙ্গোপসাগরে বিদ্যমান চারটি মৎস্যক্ষেত্রে এখন আর আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। জেলেরাই এখন এটা বলছে।

এমন মাছ ও প্রবালসহ নানা প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এলাকাগুলোকে সুরক্ষিত রাখা গেলেই পরে সামুদ্রিক অর্থনীতির সম্ভাবনার শুরু হবে। সুরক্ষিত জলাঞ্চলের একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা গেলে প্রথমত মৎস্য সম্পদ আহরণে পরিমাণ ও মান বাড়বে; যা এখন আমাদের ক্রমশ কমছে। ২০১১-১২ সালে মোট সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন ছিল মাত্র পাঁচ লাখ আটাত্তর হাজার টন। একই সময়ে অভ্যন্তরীণ চাষ করা মাছের উৎপাদন ছিল সতের লাখ ছাব্বিশ হাজার টন। দ্বিতীয়ত, ৫৭৪ কিলোমিটার উপকূল রেখার পেছনেই দেশের নীচু এলাকায় যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাস, সেই ঘনবসতিপূর্ণ উপকূলীয় অর্থনীতির হারানো প্রাণ ফিরবে এতে। স্নরকেলিং, স্কুবা ডাইভিং, সেইলিং ও ফিশিং ছাড়াও নানা ধরনের সামুদ্রিক পর্যটনের কর্মকাণ্ডে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। এই সামুদ্রিক পর্যটন থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তো আসবে। তৃতীয়ত, দেশে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হবে। নানা ধরনের খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য খাদ্য প্রোটিনের অভাব পূরণ করবে। যেমন, ধরা যাক আয়োডিনের কথাই, সামুদ্রিক মাছে মানুষ অভ্যস্ত হলে বাংলাদেশে আয়োডিনজনিত স্বাস্থ্যসংকট তৈরি হবার কথা নয়। চতুর্থত, উপকূলের কাছাকাছি সুরক্ষিত জলাঞ্চলগুলো কেন্দ্র করে সমুদ্রকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। সমুদ্রে বায়ুবিদ্যুৎতের মতো পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদনের কাজে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশই সক্ষম হয়েছে।

লেখক: সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণবাদী উদ্যোগ 'সেভ আওয়ার সি'র সমন্বয়ক

বাংলাদেশ সময়ঃ ১২০৭ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৪



বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।