১.
ব্রাজিলের নাকি এখনও বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শতভাগ সম্পন্ন হয়নি! কোন্ মাঠে বৃষ্টির পানি জমছে, কোন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে চেয়ারের রঙ দু’দিন না যেতেই উঠে পড়ছে, কতগুলো হোটেল-মোটেল এখনও পর্যটকদের থাকার মতো পুরোপুরি উপযোগী হয়ে ওঠেনি— এরকম ছোট-বড় অসংখ্যা ঘাটতি মেটাতে এখনও হিমসিম খাচ্ছেন ব্রাজিলিয়ানরা।
আমাদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে কিন্তু মোটেও ঘাটতি নেই।
শুধু পতাকা নয়, আমাদের পোশাক-প্রস্তুতিও কমপ্লিট বেশ আগেভাগেই। যে যার পছন্দ আর সাধ্য মিলিয়ে প্রিয় দলের জার্সি কিনেছেন বাজার থেকে। গুলশান মার্কেটে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানি বিভিন্ন দেশের জার্সি হাজার টাকারও বেশি দামে কিনে গায়ে দিয়ে যারা বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন, কাওরান বাজার কিংবা ফার্মগেট অথবা গুলিস্তানের বঙ্গবাজার থেকে দেড়শ’-দু’শ টাকার জার্সি গায়ে চড়ানোদের বুক কিন্তু তাদের চেয়ে মোটেও কম ফোলা নয়! ভক্তের কাছে যে প্রেমটাই বড়, দামটা সেখানে কিচ্ছু না। আর সে কারণেই তেজগাঁও’র ভ্যানচালক সোহাগ মিয়াকে দেখা গেল গাঁয়ে থাকা ছোট ছেলেটার জন্য ফার্মগেট ঘুরে-ঘুরে আর্জেন্টিনার পুরো জার্সি-সেট খুঁজে বেড়াচ্ছেন, শুধু গেঞ্জিতে হবে না, সঙ্গে শটসটাও যে চাই (হাফ-প্যান্ট) তার। “আমি নাইলে লুংগি দিয়া আর্জেন্টিনার গেঞ্জি পইরা ভ্যান চালামু, আমার পোলা তো এইডা গায়ে দিয়া ফুটবল খেলবো, হের পুরা সেট লাগবো না? নাইলে কেমন লাগবো দেখতে?” –এই বলে আবার ঘামতে-ঘামতে খোঁজা শুরু, একপর্যায়ে সেট মিলে যাওয়ায় দু’তিন দিনের পুরো আয়টুকু দিয়ে তা কিনে হাসিমুখে সোহাগ মিয়ার ঘরে ফেরা— এই যে অসাধারণ বিশ্বকাপ প্রস্তুতি, তা ব্রাজিলিয়ানরা দেখলও না, জানলও না; দেখলে-জানলে লজ্জাই পেতো বোধহয়।
বিশ্বকাপ হচ্ছে ব্রাজিলে, খেলাগুলো সব যখন চলবে বাংলাদেশে তখন গভীর রাত। প্রস্তুতি তো লাগবেই কিছু, তাই না? নো টেনশন, সব প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে। বাবা অনেকগুলো প্যাকেট এনেছেন খাবারের— চানাচুর, বিস্কুট, চিপস, সসেজ, নাগেটস, কত্ত কি আরও! মা কি তবে ওগুলো বসে বসে শুধু খাওয়ার মতলবে আছেন? উহুঁ, একমদ ভুল। মা ওসব প্যাকেট খাওয়া বাচ্চাদের খাওয়াবেনই না ঠিক করেছেন, ওগুলো বাবাকে একা একাই খেতে হবে। মা সবাইকে রান্না করা সব মজার খাওয়া করে দেবেন। মায়ের ভান্ডারে তাই এরই মধ্যে অনেকগুলো প্যাকেট- নুডুলস, ম্যাকারনি, ফ্রিজ ভর্তি চিকেন, গরুর কিমা, আইসক্রিম, কাসটার্ডের মাল-মশলা, অনেক রকমের ফল...। মা-বাবা’র এই বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে আমরা বাচ্চারা সব ধন্য; আমরা শুধু খেলা দেখবো, খাবো, আর গোওওওওওওল-গোওওওওওওল চিৎকারে পুরো পাড়া মাথায় তুলে ফেলবো। এই এক মাস আমরা পুরো রাত জাগবো, আর নাইটগার্ড পুরো রাত ঘুমোবেন— তাই কি? এমনটা মনেই হয়, আসলে কিন্তু একদম ভুল। নাইটগার্ডও নাকি এরই মধ্যে মোড়ের গ্যারেজে সিট বুকিং দিয়েছেন, তিনিও খেলা দেখবেন। একেই বলে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি; আমরা জাতিগতভাবে প্রস্তুত; কামঅন ব্রাজিল... লেটস্ প্লে...
২.
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বিশ্বকাপ নিয়ে চলছে রীতিমতো রৈ-রৈ কাণ্ড। প্রতিটি হলের টিভি রুম রঙ করা হয়েছে, কয়েকটিতে নতুন টিভিও এসেছে, বিশাল-বিশাল স্ক্রিনের। হলের ক্যান্টিন সারা রাত খোলা থাকবে, ক্যান্টিনে থাকবে চা-নাস্তার বন্দোবস্ত। এই একটা ইভেন্টে কোন ছাত্রদল-ছাত্রলীগ ভাগাভাগি নেই। বিশ্বকাপের সময়টুকুতে পুরো বিশ্বের মতো ছাত্রদল-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও ‘বিশ্ব-নাগরিক’ হয়ে ওঠেন, এবারও উঠেছেন। আর তাই শোনা গেল, কোনো এক হলের টিভি রুমে ছাত্রলীগের ছেলেপেলেরা বড় এক নেতার কাছ থেকে বিশাল স্ত্রিনের নতুন টিভি আদায় করেছেন, আর ছাত্রদলও তাদের আরেক নেতার কাছ থেকে আদায় করেছেন হোম থিয়েটার সাউন্ড সিস্টেম। দল-লীগ মিলেমিশে এবার স্টেডিয়াম ফ্লেভারে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখবে। তবে কপাল খোলেনি অন্য ছাত্র-সংগঠনগুলোর; ইউনিয়ন-মৈত্রী যথারীতি অন্য সব ইভেন্টের মতো এখানেও দর্শকের ভূমিকায়, আর ছাত্র-শিবির যথারীতি খোলসবন্দী।
৩.
কাওরান বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জয়নাল, রাতে কিছু সবজি কিনে ভোর থেকে সেগুলো সামনে নিয়ে বসে থাকা তার নিত্যচিত্র। গত বিশ্বকাপে অন্য অনেকের মতো জয়নালও খেলা দেখতে-দেখতে বাজি ধরেছিলো, কখনও হেরেছিলো, কখনও জিতেছিলো। ঢাকার অভিজাত ক্লাবগুলোর মতো লাখ-লাখ টাকার বাজি না হলেও, ক্ষুদ্র-আয়ের মানুষগুলোর ক্ষেত্রে এরকম বড় খেলায় হাজার টাকার বাজি উপ-খেলার মতো সবসময়ই চলে, কখনও মূল খেলার থেকেও এই উপ-খেলা জমজমাট হয়ে ওঠে।
গত বিশ্বকাপের ফাইনালে জয়নাল বাজি ধরেছিলো সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা, আরও অনেকেই ছিলো সেই বাজিতে, সেদিন মোট সাড়ে তের লাখ টাকার বাজি উঠেছিলো ওই আড্ডায়। দুঃখের বিষয় হলো, খেলা শেষ হবার আগেই বাজির পুরো টাকা নিয়ে সেদিন উধাও হয়ে গিয়েছিলো ‘বাজিকরের’ দল; ফলে জয়-পরাজয়ের লাভ-ক্ষতি আর হিসেবই করা হয়নি জয়নালদের কারোরই।
জয়নাল এবারও খেলা দেখবে। তার মূল দল জার্মানি, তবে বাজির হিসেব আলাদা, সেখানে প্রত্যেক খেলায় দুই দলের একটির পক্ষ নিয়ে বাজি ধরতে হয়। গেলবার ফাইনালে বাজিতে ধরা খেয়ে জয়নাল আর বাজি-টাজিতে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলেও, বিশ্বকাপ কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার সেই ‘না’ ক্রমেই ‘হ্যাঁ’-তে রূপ নিচ্ছে। আর সেই ‘হ্যাঁ’ এতোটাই শক্ত হয়ে উঠেছে যে, ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটিতেই সে ব্রাজিলের হয়ে দু’হাজার টাকা বাজি লড়বে বলে এরই মধ্যে ‘বাজিকর’কে নিশ্চিত করে দিয়েছিল। জয়নাল এবার খেলা দেখবে শুঁটকিপট্টিতে, সেখানে ‘বাজিকর’ হলেন জনৈক শুঁটকি আড়তদার সোলায়মান। জয়নালের বিশ্বাস— সোলায়মান সৎ লোক, বাজির টাকা নিয়ে এবার আর কোন নয়-ছয় হবে না।
৪.
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু থেকে ভোর পাঁচটার বাসে চড়ে হারুন তার মা-কে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন; হারুন একটা সিকিউরিটি কোম্পানিতে গার্ডের চাকরি করেন, মা থাকেন গাঁয়ে। হারুনের মায়ের এই প্রথম ঢাকায় আসা; শখে নয়, চিকিৎসার জন্য। ঢাকামূখী বাসটি তখন সাভার ছাড়িয়ে আমিন বাজার পার হচ্ছে। হঠাৎ হারুনের মা’র চোখ আটকে গেল আমিন বাজার ব্রিজের ঠিক আগে একতলা-দো’তলা-তিনতলা অসংখ্যা ঘিঞ্জি সারি-সারি বাড়ির ঘণবসতিপূর্ণ গ্রাম বরদেশি’র দিকে। লাখে-লাখে পতাকা উড়ছে পুরো গ্রামজুড়ে, এক-একটা ছাদে অগণিত রঙবেরঙের পতাকা। বিস্মিত হারুনের মা পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘ও হারুন, এইখানে কি হয় রে?’ ঘুম-ঘুম চোখে হারুনের দায়সারা উত্তর—‘ওই যে মা, বিশ্বকাপ। ’ যতক্ষণ দেখা যায় সেদিকেই তাকিয়ে থাকলেন হারুনের মা। তার মনে পড়লো গ্রামের মুদি দোকানে সদাই আনতে গিয়ে বিশ্বকাপ শব্দটা বেশ ক’বার তার কানে এসেছিলো, অনেক দেশ ফুটবল খেলে সেখানে— এমনটাও শুনেছিলেন কারও মুখে তিনি। বিস্ময়ের ঘোরে হারুনের মা আনমনেই বলে ওঠেন, ‘ও... এইখানেই তাইলে বিশ্বকাপ খেলাটা চলে!’
লেখক : সাংবাদিক