ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এমন মানুষ কমই জন্মায় ।। সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৫ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৪
এমন মানুষ কমই জন্মায় ।। সেলিনা হোসেন সরদার ফললুল করিম

সরদার ফললুল করিমের নাম আমি প্রথম শুনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়। আমার শিক্ষকদের কেউ কেউ তাঁর কথা বলতেন।

তিনি একজন আদর্শবান মানুষ ছিলেন। রাজনৈতিক দর্শন ছিল তাঁর কাছে একটি কঠিন প্রজ্ঞার মতো। তিনি রাজনীতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নাম উচ্চারিত হতো অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে। পরে তার সঙ্গে আমার দেখা হয় ১৯৭০ সালে। আমি তখন বাংলা একাডেমিতে যোগদান করি । সে সময় তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ।

তাঁর টেবিলে বসেই আমার অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। যেমন— সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তসহ আরও অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবী, যারা সেই সময় বাংলা একাডেমিতে যাতায়াত করতেন। তাঁর টেবিলে বসে নানা ধরনের কথাবার্তা হতো। আমার যেটুকু মনে আছে, তিনি খুব সম্ভবত সেই সময়টায় ‘প্লেটোর সংলাপ’ বইটি বাংলায় অনুবাদ করছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তাঁর কথা প্রথম শুনি, তখন থেকে লক্ষ্য করতাম, তার নাম বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করা হতো। শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করার কারণও ছিল। রাজনীতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ছেড়ে চলে আসা, রাজনীতিকে জীবনের সঙ্গে এক করে দেখা— এসব ছিল তাঁর বড় দিক। এই বড় দিকগুলোকে তিনি সারা জীবন অক্ষুন্ন রেখেছেন।

আমরা যখন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করি, তখন তাঁ‍র সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এই বিশ্বাস নিয়ে তাঁর সামনে গেছি যে, একজন আদর্শ মানুষের সামনে দাঁড়াতে পেরেছি। যাঁকে অবলম্বন করে, যাঁর চিন্তা-চেতনাকে অবলম্বন করে একটা জগৎ তৈরি করার সুযোগ পাব।

তিনি বাংল‍া একাডেমিতে ১৯৬০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছিলেন। আমরা জানি, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার, বঙ্গবন্ধু নিজেই আগ্রহ প্রকাশ করেন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন। আমার এখনও মনে আছে, ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য এসেছিলেন, সে সময়টার কথা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, বাকী কিছুটা দিন সেই শূন্য চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখন আমাকে গভীরভাবে ভাবাত।

এ ঘটনার পর বাকী কয়েক মাস তিনি জেলেই কাটান। বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সংগঠিত ঘটনার পর থেকে মনে হতো, তিনি জেলে থাকায় ভালই হয়েছে, এর ফলে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। বাইরে থাকলে হয়তো তাঁকে আমরা এভাবে আর পেতাম না। পরবর্তী সময়ে তিনি অনেক সৃষ্টিশীল কাজ করেছেন। আমার কাছে অনেকগুলো বই আছে, বিশেষ করে ‘প্লেটোর বিপাবলিক’, যা আমি অনেকবারই পড়েছি। তিনি এরিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর অনুব‍াদও করেন। এছাড়া ‘নূহের কিশতি’, জাহানারা ইমাম আপাকে নিয়ে ‘রুমির আম্মা’ নামে একটি বই লিখেন। ১৯৭৬ সালে পান বাংলা একাডেমী পুরস্কার।

সবকিছু মিলিয়ে একজন কাছের মানুষ হিসেবে তাঁর লেখালেখির জগৎ, ব্যক্তি মানুষটাকে দেখা হয়েছে। আমি যখন দুই নাম্বার গলিতে থাকি। তিনিও শ্যামলীর এই গলিতে বাসা নিয়েছিলেন এবং দুই-তিন বছর এ বাসাতে ছিলেন। তখনও তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। তিনি শুধু আমার কাছে একজন বিশেষ মানুষ নন। তিনি আমার পরিচিত, যাঁর লেখা আমার ভাল লেগেছে। তিনি আমার কাছে আরও একটু বেশি মানুষ, তাঁর দর্শন, তাঁর চিন্তা, তার বোধ নিয়ে তাঁকে মনে হয়েছে যে, এমন মানুষ খুব কমই জন্মায়, যাঁরা অন্য মানুষের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকেন।



লেখক : কথাসাহিত্যিক



বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, ১৬ জুন ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।