ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কাগজ নিয়ে কারসাজি আর জালিয়াতির মহোৎসব

মির্জা মেহেদী তমাল ও রুহুল আমিন রাসেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৯ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৪
কাগজ নিয়ে কারসাজি আর জালিয়াতির মহোৎসব

দেশে যে পরিমাণ কাগজের চাহিদা রয়েছে, এর কয়েক গুণ বেশি উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে দেশিয় কাগজ মিলগুলোর। উৎপাদিত কাগজ বিশ্বমানের হওয়ায় রফতানিও হচ্ছে।

তবু আমদানি করা হচ্ছে, বিপুল পরিমাণ কাগজ।

অন্যদিকে, নিম্নমানের বিদেশি কাগজের কাছে দেশেই বাজার হারাচ্ছে দেশিয় কাগজ।

দেশিয় কাগজ মিলগুলো নিজেদের প্রচেষ্টায় যখন উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে রফতানি করছে, তখনই বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার নামে দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহায়তায় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কাগজ আমদানি করছে একাধিক ব্যবসায়ী চক্র।

সব মিলিয়ে দেশে এখন কাগজ নিয়ে কারসাজি আর জালিয়াতির মহোৎসব- এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সব জেনেশুনেও অর্থের রফা-দফায় ম্যানেজ হয়ে গেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্তাব্যক্তিও।

ফলে, দেশিয় উদ্যোক্তাদের অর্থ-শ্রম-ঘাম আর কষ্টে গড়া কাগজশিল্প এখন ধ্বংসের মুখোমুখি। ফলে, শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সরকার যতই চেষ্টা করছে, তাতেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার। তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও মুঠোফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে যে পরিমাণ কাগজের চাহিদা রয়েছে, এর কয়েক গুণ বেশি উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে দেশিয় কাগজ মিলগুলোর। উৎপাদিত কাগজ বিশ্বমানের হওয়ায় রফতানিও হচ্ছে। তবু আমদানি করা হচ্ছে, বিপুল পরিমাণ কাগজ।

দেশিয় উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি করা বেশির ভাগ কাগজই নিম্নমানের। মিথ্যা ঘোষণা ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করার কারণে এসব কাগজ বিক্রি হচ্ছে, কম দামে। দেশে উৎপাদিত কাগজের মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও আমদানিকৃত কাগজে মান যাচাই করা হয় না। ফলে, দেশের বিকাশমান কাগজশিল্প এখন হুমকির মুখে।

এদিকে, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা কাগজসহ বিভিন্ন পণ্যে সয়লাব দেশ। পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পের জন্য শতভাগ পুনঃরফতানির অঙ্গীকারনামা দিয়ে আমদানি করা পণ্যসামগ্রী অহরহ পাওয়া যাচ্ছে খোলাবাজারে।

শুল্ক প্রশাসনের নীরবতায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব পণ্য আমদানি করছেন। ফলে, ধ্বংসের মুখে পড়েছে দেশিয় কাগজশিল্প। শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্য এবার নতুন কৌশল নিয়েছেন অসাধু কাগজ আমদানিকারকরা।

তারা হৃদরোগের চিকিৎসার ইসিজি (ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম) রিপোর্ট তৈরিতে ব্যবহৃত কাগজের নামে সাদা কাগজ আমদানি করে বিক্রি করছেন বাজারে। ফলে, সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশিয় কাগজশিল্প। কারণ, শুল্ক ফাঁকি দেওয়া কাগজের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না তারা। কিন্তু আমদানি বন্ধ নেই। আমদানি হচ্ছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে।

রোগীদের স্বার্থে সরকার ইসিজি পেপার আমদানিতে মাত্র পাঁচ শতাংশ শুল্ক আদায় করে। অন্যদিকে, সাদা কাগজ আমদানির শুল্কহার ২৫ শতাংশ। ফলে, অসাধু আমদানিকারকরা ইসিজি পেপারের কথা বলে সাদা কাগজ আমদানি করলে ২০ শতাংশ শুল্ক হারায় সরকার।

ইসিজি পেপার কয়েক ইঞ্চি লম্বা ছোট ছোট রোল করে আমদানি করা হয়। আর সাদা কাগজ আমদানি হয় বড় বড় রোল করে। আবার ইসিজি পেপারে একটু তাপ দিলেই সেটি কালো হয়ে যায়। ফলে, এ কাগজের নাম করে অন্য কাগজ কেউ আমদানি করলে তা সহজেই ধরা সম্ভব।

সূত্র জানায়, ইন্দোনেশিয়ার কনকর্ড ও এপ্রিল প্রিমিয়াম নামের দুটি কোম্পানির কাছ থেকে মূলত এ কাগজগুলো আমদানি করা হচ্ছে। এই আমদানিকারকদের মধ্যে অন্যতম রাজধানীর পল্টনের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটিই মূলত সিন্ডিকেট চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে জানা গেছে।

পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশে বছরে মাত্র ১০ টন ইসিজি পেপারের চাহিদা আছে। এর এইচএস কোড- ৪৮০২.৫৫.১০/০০।

এ কোডের মাধ্যমে আমদানি করা ইসিজি কাগজ শুধু হাসপাতালে বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু, একই কোডে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টন সাদা কাগজ আমদানি করছেন। গত কয়েক মাসে দেশে কী পরিমাণ ইসিজি পেপার আমদানি হয়েছে এবং সেগুলো কোথায় বিক্রি করা হয়েছে, তা খোঁজ নিলেই শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি ধরা পড়বে বলে মনে করে অ্যাসোসিয়েশন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কাগজ ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এক নেতা ইসিজি পেপারের নামে কাগজ আমদানির বিষয়টি স্বীকার করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, গুটিকয়েক কাগজ ব্যবসায়ী এ কাজটি করছেন। এতে সৎ ব্যবসায়ীরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। পাশাপাশি বদনামের ভাগীদার হচ্ছেন কাগজ ব্যবসায়ীরা।

তিনি ইসিজি পেপারের আড়ালে কাগজ আমদানি বন্ধ করে প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির দাবি জানান। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাগজ আমদানিতে দেশিয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) দেওয়া তথ্য মতে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন কাগজ কল রয়েছে ৬৭টি। এসব কারখানায় প্রায় সব ধরনের কাগজই তৈরি হচ্ছে। কাগজ মিলগুলোর দেশের সাত লাখ টন চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১০ লাখ টন কাগজ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে, দেশিয় কাগজ মিলগুলো উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে না। দেশিয় কাগজ যখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে, সে অবস্থায় আমদানির প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন মিলমালিকরা।

এ অবস্থায় অহরহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাগজ আমদানি হচ্ছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা কাগজে সয়লাব দেশ। দেশিয় কাগজশিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ, অবকাঠামো সমস্যাসহ বিভিন্ন অসুবিধার কারণে এমনিতেই দেশে কাগজ উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ছে।

অন্যদিকে, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউসের অপব্যবহার করে আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাগজ খোলাবাজারে কম দামে বিক্রি করায় দেশিয় কাগজ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। কাগজ রফতানিতেও কোনো প্রণোদনা নেই। ভারতে কাগজ রফতানিতে ৭ শতাংশেরও বেশি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায় এ সহায়তা ৩৩ শতাংশ। বাংলাদেশে এ ধরনের সরকারি প্রণোদনা না থাকার পরও রফতানি বাজারে জায়গা করে নিয়েছে দেশে উৎপাদিত কাগজ।

অন্যদিকে, নিম্নমানের বিদেশি কাগজের কাছে দেশেই বাজার হারাচ্ছে দেশিয় কাগজ।

এদিকে, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে পুনঃরফতানির উদ্দেশ্যে আনা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে, এমন অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা।

ওই অভিযোগে ব্যবসায়ীরা বলেন, বন্ড লাইসেন্সের বিপরীতে আমদানি করা বিভিন্ন প্রকার প্যাকিজিং সামগ্রী খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। বন্ড ও শুল্ক বিভাগ সঠিক পরীক্ষা না করায় এমনটা ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, তৈরি পোশাক, ওষুধসহ নানা ধরনের শিল্পে মোড়কজাতকরণের (প্যাকেজিং) সুবিধার্থে কাগজ আমদানিতে শুল্কসুবিধা দিয়েছে সরকার। এ সুযোগের অপব্যবহার করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কাগজ আমদানি করছেন এবং অতিরিক্ত কাগজ দেশিয় বাজারে কম দামে ছেড়ে দিচ্ছেন। অথচ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে, দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কাগজ।

স্থানীয় কাগজশিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে ব্যবহারের জন্য বিশেষ ধরনের কাগজ আমদানির ক্ষেত্রে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দেওয়া হয়। এ সুবিধার অপব্যবহার করে আমদানি করা হচ্ছে লেখার কাগজ, টয়লেট টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু ও আর্ট পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজ। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

এদিকে, ১ জুন বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার আওতায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কারখানার নামে ডুপ্লেঙ বোর্ড আমদানিকারক চট্টগ্রামের এস কে ইন্ডাস্ট্রিজের দুটি পণ্য চালান করে বেনাপোলের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এর মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে খোলাবাজারে বিক্রির পাঁয়তারা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অবৈধভাবে এ আমদানির সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তারা জড়িত থাকলেও অজ্ঞাত কারণে নীরব জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

ভারত থেকে আমদানি করা ডুপ্লেঙ বোর্ডের দুটি চালান আটকের পর এর আমদানি-যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় আমদানি করা আড়াই শত টন ডুপ্লেঙ বোর্ড কালোবাজারে বিক্রি করা হবে, এমন খবরে হৈ চৈ পড়ে যায় বেনাপোল কাস্টমস হাউসে।

একই নিয়মে রফতানিকারক কৃষ্ণা টিস্যু প্রা. লি. থেকে চট্টগ্রামের ওয়াসা কলোনির এলাকার ট্যাচ প্যাক নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নামের বিপরীতে ১০০ টনের পণ্যের চালান বন্দরে আসে। চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট থেকে ইস্যুকৃত বন্ড লাইসেন্স নং-৫(১০)কাবক/আকা/বন্ড/সাঃ/লাই/১৩-২০১০ তাং-২১.১২.১০তে এসকে ইন্ডাস্ট্রিজের নামে বার্ষিক প্রাপ্যতা ১৬৫৭.৩৭৪ মে. টন কাগজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এত বিপুল পরিমাণ কাগজ বরাদ্দের অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আমদানিকারক ও বন্ড কমিশানরেটের বিরুদ্ধে। কারখানা বন্ধ থাকলেও বন্ড সুবিধায় আমদানি করে উল্লিখিত মালামাল খোলাবাজারে বিক্রি করা হবে বলে কাস্টমসের শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।