ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আবেদ চৌধুরীর সাথে একান্ত আলাপে জাফর ইকবাল

কোথায় যাচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা?

শুভ্রনীল সাগর, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৪
কোথায় যাচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা?

ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ও আবেদ চৌধুরী বাংলাদেশের শিক্ষা-গবেষণার আকাশে দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রথম জন জনপ্রিয় লেখক ও অধ্যাপক এবং দ্বিতীয় জন বিখ্যাত জিনবিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক ও কবি।



সম্প্রতি এই দুই শিক্ষাবিদ-গবেষক দেশের শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থা নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় মগ্ন হন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পসে খোলা আকাশের নিচে একটি কংক্রিটে বেঞ্চে পাশাপাশি বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। কোনো এক ভক্ত হয়তো মোবাইল ফোনে তা রেকর্ড করেন। পরে অধ্যাপক জাফর ইকবাল নিজেই কথোপকথনের সেই ভিডিওটি প্রকাশ করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে তার নিজস্ব পেইজে।

ভিডিওতে দেখা যায়, শুরুতেই কথা পাড়েন আবেদ চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, আমরা যখন দেখি আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন এবং এই ৭০-৮০ ভাগ মানুষ উল্লেখযোগ্য কোনো সুযোগ-সুবিধার মধ্যে নেই। জন্মসূত্রে আমাদের দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা এই ৭০-৮০ ভাগ মানুষের মধ্য থেকেই উঠে আসে। যেহেতু সুযোগ-সুবিধা নেই তাই তারা বেরিয়ে আসতে পারে না।

এই বলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন জাফর ইকবালের কাছে। জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিভার সামাজিক বিকাশ নিয়ে তার মতামত জানতে চাইলে জাফর ইকবাল বলেন, হ্যাঁ, এটা আমিও বিশ্বাস করি। তবে ‘মেধা’ বলে যে শব্দটি আমরা ব্যবহার করি সেটার গুরুত্ব আসলে খুব বেশি না। আমি দেখেছি, একটা বিষয় কেউ খুব বেশি জানত না, কিন্তু যখনই তার ভেতর বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ তৈরি করে দেওয়া হলো, এত দ্রুত সে বিষয়ের গভীরে যেতে পারছে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি।

আমি মনে করি, একজন ছেলে কিংবা মেয়ে এক ধরনের প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। আমরা যদি সেই প্রতিভাকে নষ্ট না করি, অনেক ক্ষেত্রে তার ভেতর থেকে অনেক কিছু বেরিয়ে আসে, বলতে থাকেন জাফর ইকবাল।

আবেদ চৌধুরী তখন মনোযোগী শ্রোতা। জাফর ইকবাল বলতে থাকেন, একটি গল্প বলি, আমার স্যার আমাকে বলেছিলেন- একবার তার কাছে একটি ছোট মেয়ে এসেছিল। স্যার তাকে বিড়ালের উপর একটি রচনা লিখে নিয়ে আসতে বললেন। মেয়েটি খুব সুন্দর করে একটি রচনা লিখে নিয়ে এল। বিড়াল এই করেছে, বিড়াল সেই করেছে। তারপর অনেক বছর পর মেয়েটির সঙ্গে স্যারের দেখা। মেয়েটি তখন খুব ভাল একটি কলেজে পড়ে, খুব ভাল রেজাল্ট করেছে। স্যার বললেন, ও আচ্ছা তুমি সেই মেয়ে! মনে আছে তুমি বিড়ালের উপর রচনা লিখেছিলে? মেয়েটি বলল, হ্যাঁ। স্যার আবার তাকে একটি বিড়ালের উপর একটি রচনা লিখতে বললেন। মেয়েটি খাতা-কলম নিয়ে অনেক চেষ্টা করে স্যারকে এসে বলল, স্যার আমি বহুমুখি সেতু, সার্ক বা সময়ের প্রয়োজনীয়তার উপর রচনা লিখি? সে আর বিড়ালের উপর রচনা লিখতে পারে না। সে কিন্তু অনেক জটিল বিষয়ের উপর রচনা লিখতে পারে, যা সে মুখস্থ করে এসেছে কিন্তু স্বতস্ফূর্ভাবে আর বিড়ালের রচনা লিখতে পারে না। তার মানে তার এই সৃজনশীল ক্ষমতাটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

এজন্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমি মনে করি, আমরা খুব নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের এই সৃজনশীল ক্ষমতাকে নষ্ট করে ফেলি। সে সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল, আমরা তাকে ভাল লেখাপড়ার নামে তার এই ক্ষমতা ধ্বংস করে ফেলছি। এজন্য আমি ভাল রেজাল্টের চেয়ে তার ভেতরে শেখার আগ্রহকে বেশি গুরুত্ব দেই, বলেন জাফর ইকবাল।

এ পর্যায়ে শিক্ষা ও পরীক্ষা তার আসল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে কেবল পরীক্ষানির্ভর হয়ে পড়ড়ে। এ ব্যাপারে আবেদ চৌধুরী তার মতামত জানতে চান। উত্তরে জাফর ইকবাল বলেন, আমি যেহেতু একজন শিক্ষক সেহেতু আমার পরীক্ষা নিতে হবে। কিন্তু একটা ছেলে বা মেয়ে যদি বিষয়টি শেখে তাহলে পরীক্ষা দিতে সমস্যা কী! সবসময় আমার ছাত্রদের বলি, আমি একটা জিনিস পড়াব, অন্য জিনিস থেকে পরীক্ষা নেব। আমি যেটা পড়ালাম সেটার জন্য তাদের একটা বুদ্ধি হলো, একটা জ্ঞান হলো, সেটার মাধ্যমে তারা একটা সমস্যার সমাধান করতে পারবে, আমি সেজন্য পরীক্ষা নেব।

তবে এটা ঠিক, ভাল পরীক্ষা নেওয়ার যদি সিস্টেম থাকে তাহলে ছেলেমেয়েরা ভাল শেখে। সব সময় বোকার মত ও সৃজনশীলতার বাইরে গিয়ে পরীক্ষা নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। একটা ছেলে বা মেয়ের মেধা যাচাই করার জন্য চমৎকারভাবে পরীক্ষা নেওয়া যায়। তবে পরীক্ষার উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ যদি শুধু লেখাপড়া শেখে তবে সেটা খুব ক্ষতিকর! সব সময় কিন্তু সেভাবে ধাক্কাধাক্কি দেওয়া হয়।

একটা উদাহরণ দিই, আমাদের দেশে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সৃজনশীল ব্যাপারটা হচ্ছে, যে প্রশ্নটা ছেলে বা মেয়েটি পাবে এর আগে পৃথিবীতে সেই প্রশ্নটির জন্ম হয়নি। সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রশ্ন তাকে দেওয়া হবে। কাজেই ছেলেমেয়েদের আর গাইড বই পড়ে কোনো লাভ নেই, কারণ কমন পড়বে না। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে প্রশ্নের গাইড বই বেরিয়ে গেছে। শুধু তাই না, আমাদের যারা প্রশ্ন করেন সেইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সেই বই থেকে প্রশ্ন করেন। মানে পুরোটাই একটা ধ্বংসাত্বক ব্যাপার। পুরো ধারণাটাই রাতারাতি নষ্ট হয়ে গেল। এগুলো যারা করেন দেশ ও সমাজের কত বড় ক্ষতি যে তারা করে! উদ্বেগ ঝরে জাফর ইকবালের কণ্ঠে।

কথোপকথন অনেকটা সাক্ষাৎকারে রূপ নেয় যখন আবেদ চৌধুরী একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন বা প্রসঙ্গ তুলে জাফর ইকবালের অভিমত নিচ্ছিলেন।

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আবেদ চৌধুরী আবারও জিজ্ঞেস করেন, কিভাবে আবার সৃজনশীল উপায়ে ফেরা যায়। জাফর ইকবাল বলেন, এই মুহূর্তে সৃজনশীলতা আরও ভয়ঙ্কর। কারণ, পুরো প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কাজেই ছেলেমেয়েদের আর পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষার আগের রাতে ফেইসবুকে বসে প্রশ্নটি ডাউনলোড করে উত্তর মুখস্থ করে পরদিন পরীক্ষা দিলেই হলো। এটা আরও বেশি ধ্বংসাত্মক অবস্থা। সৃজনশীল পদ্ধতিটিকে যদি ঠিকভাবে নেওয়া যায় তাহলে সম্ভব। এমন নয় যে এটা বাংলাদেশের আবিষ্কার। যখন ছাত্রছাত্রী জানবে প্রশ্ন কখনই কমন পড়বে না, তখন তারা বিষয়ের গভীরে গিয়ে জানার চেষ্টা করবে। আর মুখস্থ করার চেষ্টা করবে না। কারণ, সে জানবে মুখস্থ করে তো কোনো লাভ নেই, তার চেয়ে আমি যদি নিজের মত লেখার চেষ্টা করি তাতেই ভাল।

কাজেই আমি এখনও পুরোপুরি হতাশ হইনি, বলেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, এখনও আশা করে আছি যে, আমরা ছাত্রছাত্রীদের কিছু দিতে পারব। একজন শিক্ষার্থী কতটুকু ‍শিখেছে তার প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই, আমার আগ্রহ সে তার মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে কিনা।

এই কথার মধ্য দিয়েই শেষ হয় দেশের শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থা নিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ এই কথোপকথন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৭ ঘন্টা, ২৪ জুন, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।