ঢাকা: সকালে অফিসে যাচ্ছি। রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট।
দোকানের সামনের দিকে কাচঘেরা জায়গাতে বেশ কয়েকটি পোস্টার টাইপ ছবি। সেখানেও নতুন নতুন পোশাক পরা ছেলেমেয়েদের ছবি শোভা পাচ্ছে। আশেপাশে আরো কিছু বুটিক শপ রয়েছে।
দোকানগুলোর এসব আয়োজন, ঈদ আসছে আমাদের সেকথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ওই দোকানের সামনে খুব মনোযোগ দিয়ে নতুন জামা-কাপড়ের ছবি দেখছে এক ছেলে। ওর বয়স কত হবে? সাত কিংবা আট হতে পারে। পলকা শরীর। মলিন চেহারা। কাঁধের ওপর একতাড়া পত্রিকা। একটু আগেই আমার গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে গেছে। কেনার জন্য সেধেছে। দোকানের জামা-কাপড়ের দিকে ওর এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে হঠাৎ আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো।
গতবছর ওর মতো আরো কিছু ছেলেমেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। কমলাপুর রেলস্টেশনে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ওরা। ওরা জীবিকার প্রয়োজনে দিনভর স্টেশনে পড়ে থাকে, এটা-ওটা বিক্রি করে, মানুষের মালপত্র বহন করে।
যদিও চলতে ফিরতে ওদের সাথে কতোবারই তো দেখা হয়েছে। কিন্তু আমার মনে পড়লো একটি বিশেষ দিনের কথা। এরকমভাবে সেবারই ওদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। পরিচয়টা করিয়ে দিয়েছিল আমার সহকর্মী বায়েজীদ আক্তার।
বায়েজীদদের একটা সংগঠন আছে ‘আমরা জেগে আছি’ নামে। ওই সংগঠন থেকে বায়েজীদ’রা পথশিশুদের জন্য ঈদে নতুন জামা-কাপড় কিনে দেয়। নিজেরা চাঁদা দেয়, আশেপাশের পরিচিদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে। এরপর সব টাকা দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের জন্য নতুন জামা কিনে ঈদের আগে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছিন্নমূল শিশুদের মাঝে বিলি করে।
আমার কলেজ ছিল নটরডেম। সেসময়ে কমলাপুর কতো পরিচিত ছিল! এতোদিনে শহর সবদিকে বেড়েছে। নতুন দালানকোঠা হয়েছে। সেই চেনা জানা কমলাপুর অচেনা হয়ে উঠেছে।
অচেনা কমলাপুরে একটা কাজে সঙ্গে নিলাম বায়েজীদকে। বায়েজীদের বাসা ওইদিকেই। যে বাসায় যাব, সেটা খুঁজতে সুবিধা হবে। গাড়িতে যেতে যেতেই জানা গেল ওদের উদ্যোগের কথা।
ওদের সংগঠনটি সেদিন বিকেলেই কমলাপুর স্টেশনের ছিন্নমূল শিশুদের মাঝে বিলি করবে। আমার বাসায় ফেরার অতো তাড়া ছিল না। তাই ভিড়ে গেলাম বায়েজীদদের সঙ্গে।
স্টেশনে গিয়ে পরিচয় হলো কিছু সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের সঙ্গে। পরিচয় থেকে কথা, নানা গল্প জমে উঠলো। আর গল্পে গল্পে জানা গেল এমন অজানা সব কথা, যা এতদিন অজানাই ছিল আমার।
ওদের প্রায় কারোরই ঘর-বাড়ি, বাবা-মা নেই। কেউ বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। কেউবা ছোটবেলা থেকেই আছে স্টেশনে। প্রতিদিন যে টাকা আয় করে, তা দিয়েই ওরা খাবার কিনে খায়। কখনো রেলস্টেশনের লাগোয়া টং দোকান থেকে পাউরুটি, বাটার বান কিনে খায়। কখনো খায় ফুটের হোটেলে। ফুটের হোটেল গুলো বড় বড় হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার যে খাবার ফেলে দেয়, সেসব খাবার কম দামে বিক্রি করে। সেই খাবারই কিনে খায় এসব শিশুরা।
আর ঈদের দিন কি খায়? কি পরে? একজন জানালো, ঈদের দিন ওদের কাজকর্ম থাকে না। তাই খাওয়াও ঠিকমতো জোটে না। আর নতুন জামা! সেটা তো ভাবতেই পারে না ওরা। তাই বায়েজীদদের কাছ থেকে নতুন জামা পেয়ে ওরা যে কী খুশি হলো, সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। নতুন জামা পেয়ে ওদের কারো যেন তর সইছিল না। তাই কেউ কেউ গায়ের সামনে তুলে ধরে মাপ দেখে নিয়ে আবার যত্ন করে ভাঁজ করে রাখলো ঈদের দিন পরবে বলে। ঘেমে-নেয়ে যাওয়া মলিন মুখগুলো সন্ধ্যার আলোয় এক একটা অপার্থিব মুখ হয়ে উঠেছিল সেদিন।
কয়েকদিন পরেই শুরু হবে রোজা। তারপর ঈদ। আর সেই ঈদকে সমানে রেখে আমাদের পরিবারের শিশুরা বায়না করবে নতুন কাপড়ের। অনেকেই ঈদ বোনাস পাওয়ার আগেই হয়তো পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন জামা, জুতো, প্যান্ট কিনে ফেলবেন।
অনেকে অপেক্ষা করবেন কবে ঈদের বোনাস পেয়ে কেনাকাটা করতে যাবেন। আপনাদের সবার কাছে আমার অনুরোধ। সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশুদের জীবনেরও ঈদ আসে। আমাদের পরিবারের শিশুদের মতো ওরাও স্বপ্ন দেখে ঈদের দিনে নতুন জামা পরার। তাই ওদের ঈদের কথাও একবার ভাবুন।
আমরা চাইলে ওদের ঈদকেও আনন্দমুখর করে তুলতে পারি। ওদের নতুন জামাকাপড়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারি। আমরা সবাই যদি নিজ নিজ এলাকার ছিন্নমূল শিশুদের ঈদের নতুন জামাকাপড় কেনার দায়িত্ব নিই, তাহলে ওদের ঈদ আমাদের মতো আনন্দময় হয়ে উঠবে, ঈদে ওদের মুখে হাসি ফুটবে।
না। আপনাকে আমি সব ছিন্নমূল শিশুর দায়িত্ব নিতে বলছি না। আপনি আপনার এলাকার একজন সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশুকে ঈদের নতুন জামা কিনে দিন। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের ঈদের জামাকাপড় কেনার সময় এলাকার ছিন্নমূল শিশুটির জন্যও কিনবো। আর এভাবেই আমরা সবাই মিলে পারি ওদের ঈদকেও আমাদের মতো আনন্দমুখর করতে, ওদের মুখে হাসি ফোটাতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৭ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৪