২০১২ সালের জুলাই মাসে ছাত্রলীগের কর্মীরা সিলেটে এমসি কলেজ পোড়ানোর পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি এমসি কলেজের ছাত্র।
কিন্তু না। সেখানে গিয়ে তিনি কেঁদেছেন। চোখের পানি টপটপ করে পড়েছে। মন্ত্রী হয়ে কান্নাকাটি করা বিরাট ঘটনা। চোখের পানি ফেলে কান্নাকাটি করা আরো বিরাট ঘটনা। এমন ঘটনা আমাদের মত জাতির জীবনে অহরহ ঘটেনা। সেদিন ঘটেছিল!
আমরা ধরে নিই মন্ত্রীরা ব্যপক ক্ষমতাবান। পুলিশ, প্রশাসন তাদের ভয়ে তটস্থ থাকবে। তারা চাহিবামাত্র লোক জেলে যাবে। কিন্তু নাহিদ সাহেব সেদিন কিছুই করেননি, শুধুই কেঁদেছেন। নাহিদ সাহেবের সেদিনের কান্নাকাটির প্রতীকী কারণ থাকতে পারে- তিনি মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাবান নন, নখদন্তহীন। ক্ষমতা থাকলেও ছাত্রলীগের সঙ্গে সেই ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে মন্ত্রিত্বে সমস্যা হতে পারে। ততটা সাহসী তিনি নন। নিজের অক্ষমতার জন্য তিনি সেদিন কেঁদেছিলেন-হতে পারে।
নুরুল ইসলাম নাহিদের সেই সময়ের ক্রন্দন কাহিনী আলোচিত ঘটনা। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ভদ্রলোক মানুষ। দেশে খুন খারাবিতে বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা সুশীল। যারা মারামারির পর নিহতের পরিবারে গিয়ে স্বান্ত্বনা দিতে পারেন, ক্যামেরার সামনে মিষ্টি এবং মোলায়েম শব্দে উদ্বেগ প্রকাশেই যাদের সারা। তারা কঠিন ও কঠোর হতে পারেন না। ক্ষমতা পেলেও না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পোড়ানো হয়, মন্ত্রী কাঁদেন। প্রশ্নফাঁস হয়, তিনি জানেন না। শিক্ষাবোর্ডগুলোর মধ্যে নম্বর প্রদানের অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়, তিনি জানেন না। হাজার টাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট বিক্রি হয় তিনি সেটাও জানেন না। বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করা যেতে পারে- তিনি জানেন কী? তিনি কী কী জানেন তার কিছু বক্তব্য পত্রিকায় এসেছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সমালোচনার পর তিনি বলেছেন- আমাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এটা তিনি জানেন। তিনি আরো জানেন, ক্ষমতা কিভাবে রাখতে হয়। চেয়ার কিভাবে রাখতে হয়। এজন্য সব অভিযোগ অস্বীকার করতে হয়। তিনি সংসদে বসে সেই কাজ করেছেন। বলেছেন- গত ৫ বছরে দেশে কোন প্রশ্নফাঁস হয় নি।
সর্বশেষ টিআইবির রিপোর্টে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকায় সার্টিফিকেট পাওয়া যায় এই তথ্য উপস্থাপনের পর তিনি বলেছেন- টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট অবাস্তব, অসম্ভব । প্রমাণ না দিতে পারলে মাফ চাইতে হবে।
এই হলো আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর জানার পরিধি। শিক্ষামন্ত্রী জানেন না মনে করে সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তাকে জানানোর উদ্যোগ নিলেন। পত্রিকায় একপ্রস্থ চিঠি লিখলেন। জবাবে শিক্ষামন্ত্রী এক প্রস্থ বিবৃতি দিলেন। তার বিবৃতি পড়ে মানুষ আরো নিশ্চিত হল- তিনি কিছুই জানেন না। তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র ব্যাতীত কোন বিষয়ে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি তার দাবি ছিল! আমরা তার বক্তব্য শুনে অবাক হলাম।
আসলে আমরা যেমনটা ভাবি, আমাদের ভাবনার নাহিদ সাহেবরা তেমন হন না। আমাদের আর আট/দশজন মন্ত্রী যেমন নাহিদ সাহেবও তেমন। তিনিও সকল দায় অস্বীকার করে অভিযোগকারীদের সমালোচনা করেন। কোমল মৃদু ভাষায় অভিযোগকারীদের তোপ দাগান। মোলায়েম ভাষী শিক্ষামন্ত্রীর আচরণে ক্ষুদ্ধ পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাহাদাত হোসেন বলেছেন- মিষ্টি মিষ্টি কথা না বলে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের খুঁজে বের করুন।
আমরা জানলাম সর্ববিষয়ে মিষ্টি ভালো নয়, মিষ্টি কথাও নয়। সময় ও পরিবেশ বিবেচনায় কথা না বললে আশেপাশের লোক ক্ষুব্ধ হয়। যত মিষ্টই হোক, যত্রতত্র প্রয়োগে সাবধান হওয়া বাঞ্ছনীয়।
যারা অনলাইনে আছেন তারা জানেন, পরীক্ষার আগের দিনই ফেসবুকে/অনলাইনে প্রশ্ন প্রকাশ হয়। পরদিন সেই প্রশ্নেই পরীক্ষা হয়। প্রায় সব বিষয়ের ক্ষেত্রেই এটা ঘটেছে। ছাত্ররা টেক্সটবুকের চেয়ে ফেসবুকে বেশি মনোযোগী।
ফেসবুকে এসব নিয়ে মজাও করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ১৯৭২ সালের এসএসসি পাশের মতো ২০১৪ এর এইচএসসি ব্যাচকেও একসময় বলা হবে- '১৪ এর পাশ। এই যে একটি প্রজন্মকে আমৃত্যু লজ্জায় ফেলা হলো, তার দায় শিক্ষামন্ত্রীকে নিতে হবে। একটি প্রজন্মকে ধ্বংসের দায় শিক্ষামন্ত্রীর একার। এতবড় একটি ঘটনা ঘটার পরও শিক্ষামন্ত্রীর দায় অস্বীকার খুবই অসাধু। তিনি বলেছেন - আমাকে সরানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে
যাই হোক, বাম নেতা নাহিদ সাহেবের ডান কথা আমাদের ভালো লাগেনি। নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো বাম নেতাকে পদ হারানোর ভয় তাড়িয়ে বেড়াবে এটা মেনে চলা কষ্টের। পদের জন্য অসাধু বক্তব্য দেবেন এটাও কষ্টের। রাজনীতিতে ক্ষমতার সংস্পর্শ নেতাদের নীতিভ্রান্ত করে - এটাই বোধহয় নিয়ম।
মনোয়ার রুবেল: ইমেইল : monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৪