বিএনপি ইদানিং অনেকটাই যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। বিএনপির মত একটি জনপ্রিয় দলের এমন নির্লিপ্ততা এবং ঝিমুনি-ভাবের পেছনে অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট ও অর্থবহ কারণ আছে।
সরকার বিরোধী আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য বিএনপির যে গবেষণালব্ধ ও বিশ্লেষণ মাফিক সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল তা নিতে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতে কতটুকু করতে পারবে, সে সংশয়ও জনমনে বেশ প্রবল।
দলটি ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকেই সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সাত বছর ধরেও মূল দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করে নিজেদের গুছিয়ে আনতে পারেনি। অনেক জেলায় আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে বছরের পর বছর চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ছাত্রদলের মত একটি প্রাণচঞ্চল সংগঠনকে বাবা-চাচাদের দলে পরিণত করা হয়েছে। বর্তমান কমিটির পদধারী প্রায় সব নেতাই বিবাহিত। যাদের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। অধিকাংশই বিভিন্ন পেশায় জড়িত। অথচ বিএনপির মূল শক্তি এই ছাত্র সংগঠনটি। এই বাবাদলের নেতারা সংসার ও ব্যবসার মায়া ছেড়ে দলের জন্য কতটুকু আত্মত্যাগ করতে পারবেন-এই সত্যটি বুঝতে না পারাও দলটির নীতি নির্ধারকের অন্যতম ব্যর্থতা।
দলটি কয়েক বছরেরও একজন মহাসচিব নির্বাচন করতে পারেনি। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসাবে দায়িত্বরত আছেন।
বিগত সরকারের সময় বহুবার জেলে গেলেও তিনি বহুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। একটি বড় দলের মহাসচিব যখন জেল-জুলুমের ভয়ে পালিয়ে বেড়ান, তখন দলটির আদর্শিক এবং সাংগঠনিক শক্তি ও নৈতিকতার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে।
তাছাড়া জামায়াত-জোট সরকারের সময় ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিমান প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান ও ভ্রাতা শামীম ইস্কান্দরের সঙ্গে বিমান বাণিজ্য নিয়ে বনিবনা না হওয়ার মন্ত্রিত্ব হারান। তার জায়গায় আসেন মীর নাসির। তাই আলমগীরের সঙ্গে তারেক রহমানের আস্থা, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গীর জায়গাটিতে একটি বিস্তর ফারাক এখনো বোধকরি বিদ্যমান।
দলটির ভেতর পারস্পারিক বিশ্বাসের জায়গাটি বেশ নড়বড়ে। খালেদা জিয়া সংস্কারন্থিদের দলে নিলেও বিশ্বাস অবিশ্বাসের শ্রেণী বিভাজনে দলটি বহুধা বিভক্ত।
সংস্কারপন্থিদের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার একটি বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ দলটির ভেতর রয়েছে। অনেকেই এখনও সংস্কারপন্থিদের দল থেকে বের করে দেওয়ার আওয়াজ তোলেন।
খালেদা জিয়াও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের বিশ্বাস করতে পারছেন না। স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত বাইরে পাচার করার অভিযোগ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উপর ছিল।
তাই সভার আগে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মুঠোফোন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে জমা দিতে হত। নীতিনির্ধারকের মধ্যে এই মাত্রার আস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগের মত এমন একটি অভিজ্ঞ দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কুলিয়ে না উঠতে পারারই কথা।
বিএনপির জামায়াত তোষণ নীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে কৌশলী নীতি দেশের জনগণ ভালভাবে নেয়নি। সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যুগুলোতে জনগণকে যে সব কারণে সম্পৃক্ত করা যায়নি, তার অন্যতম কারণ হল এটি। বিএনপির চালাকি জনগণ বুঝে গেছে। ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে, জনগণ তা বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার আন্দোলনে জনগণ সম্পৃক্ত হয়নি।
যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের পর বিএনপির পরীক্ষিত মিত্র জামায়াত ও শিবির মধ্যযুগীয় তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল। এ বিষয়ে বিএনপির নীরবতায় সাধারণ মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। বিএনপি সরকারের ফাঁদে পা দিয়েছিল বলে অনেকেই মনে করে। সরকার এই তাণ্ডবলীলা থেকে রাজনৈতিক ফলাফল নিজের কোষাগারে জমা করেছে। আর বিএনপি পেয়েছে সন্ত্রাসবান্ধব রাজনীতির তকমা।
হেফাজতের ৫ মের সমাবেশটি ছিল বিএনপির জোটের জন্য শাঁখের করাত। এর ফলে দেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ইসলামীকরনের কুফলটি সামনে চলে আসে। সারা বিশ্বব্যাপী হেফাজতের তাণ্ডবলীলা দেখে যে সমস্ত শক্তি বিএনপির পক্ষে ছিল তারাও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে।
সরকারি বাহিনী এদের বেশ দক্ষতায় সরিয়ে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহসিকতাটা শেখ হাসিনাকে দিয়েছে আয়রন লেডির মর্যাদা। দেশের সাধারণ মানুষ পেয়েছে স্বস্তি। যে প্রক্রিয়ায় হেফাজতের উপর নির্ভর করে সরকারকে টেনে হেঁচড়ে সরিয়ে দেওয়ার পথ অনুসরণ করা হয়েছিল, তাতে কেবল দেশের সাধারণ জনগণ নয়, বিএনপির বহু নেতা কর্মীই এই প্রক্রিয়াটিকে ভালভাবে নেয়নি।
হেফাজতের ৫ মে সমাবেশের বিষয়ে দেশের উন্নয়ন সহযোগী, দাতাগোষ্ঠী ও দেশগুলো সরাসরি কিছু বলেনি। তবে উগ্রতা ও চরমবাদ সমর্থনযোগ্য নয়, তা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন জার্মানের রাষ্ট্রদূত। এই ঘটনার পরে ড্যান মজিনার বিএনপিপন্থি অবস্থান নিয়েও কূটনীতিকদের মধ্যে বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। দৃশ্যত মজিনা একা হয়ে পড়েন।
আন্দোলনের জন্য ইস্যু নির্বাচন করে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি ততটা সক্ষমতার পরিচয় দেয়নি, বরং দলটি বেশ আনাড়ি ছিল। জিয়া পরিবারের ব্যক্তিগত ইস্যুগুলোতে হরতালের মত কর্মসূচি দেওয়ায় বিএনপির কেয়ারটেকারের ইস্যুটি অস্পষ্ট হয়ে পড়ে, আড়ালে চলে যায়।
অধিকন্তু, বিএনপি জামায়াত-শিবিরের দলীয় হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতেও পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের জন্য বেশ সুবিধা হয়। আওয়ামী লীগ তা পুরোপুরি কাজে লাগায়। বিএনপির কেয়ারটেকার ইস্যুটি দেশবাসীর সামনে গ্রহণযোগ্যভাবে প্রতীয়মান হয়নি, বরং দলটি কেয়ারটেকার ইস্যুটিকে সামনে রেখে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করছে, এই ধারণাটিই প্রগতিশীল জোট প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে বিএনপির প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা নির্বাচনের পদ্ধতিটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। দলটির এই বিষয়ে কোন হোম ওয়ার্ক ছিল না। দশজন উপদেষ্টার নাম দিতেও তারা ব্যর্থ হয়। এতে দলটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিষয়টি যে খুবই দুর্বল, তা দেশবাসীর কাছে প্রকাশ পায়।
বিগত মহাজোট সরকারের নেওয়া কিছু বিতর্কিত ইস্যুতে জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকায় তা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিল সেই সরকার। যেমন মুন্সীগঞ্জে একটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপন করা, যা ছিল একটি অবিবেচনাপ্রসূত কাজ। অন্যদিকে অনেকগুলি ইস্যুতে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল। যেমন শেয়ারবাজার ও ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সেসব ইস্যুতে বিএনপির নেতৃত্বে জোটটিকে নীরব থাকতে দেখা গেছে।
বিএনপির ভেতরে যে অংশটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়াদি দেখভালের দায়িত্বে ছিল, তারাও চরমভাবে ব্যর্থতার ষোল কলা পূর্ণ করেছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশ্ব দরবারে ভারতের ভূমিকা, ভারত- চীনের মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল বাণিজ্যে, মার্কিনী সাম্রাজ্যের সূর্য যে ক্রমশ অস্তগামী, এই সত্য অনুধাবন করতেও দলটি ব্যর্থ হয়েছিল।
দলটি আশা করেছিল যে, আমেরিকার মতো চীনও নির্বাচনের বিরোধিতা করবে। কোন দেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার নৈতিক শক্তি যে চীনের নেই, তাও বিএনপির বিবেচনায় ছিল না। আমেরিকার চতুর্মুখী চাপ উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্তটি চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়।
অন্যদিকে ভারতের সাউথ ব্লক দীর্ঘ দিনে ধরেই বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। খালেদা জিয়ার একটি সফল ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দলটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বেশ উন্নয়নও হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সফররত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির নেতৃত্ব সুদূরপ্রসারী ও সুবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এতে দলটি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও কয়েক ধাপ পিছিয়ে যায়।
বিজন সরকার: গবেষক ও কলাম লেখক, চন্নাম ন্যাশানাল বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথ কোরিয়া, bipoly3001@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১৪