সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।
বাংলাদেশ দল জিম্বাবুয়ে সফরে। বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক তখন দলের অপরিহার্য সদস্য। হুট করেই খবর এলো অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্য মোহাম্মদ রফিককে সিরিজের মাঝপথেই দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অপরাধ দলের আরেক তরুণ বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাকের সাথে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ।
পরে জানা গেলো, জিম্বাবুইয়ান স্পিনার রেমন্ড প্রাইসের কাছে পরামর্শ চাওয়ার অপরাধে রাজ্জাকের ওপর চটে যান রফিক। রফিকের ভাষ্য ছিল- তার মত একজন বিশ্বমানের স্পিনার নিজ দলে থাকতে রাজ্জাককে কেন প্রাইসের কাছে পরামর্শ চাইতে হবে!
সাকিব প্রসঙ্গে বলার আগে অতীত হয়ে যাওয়া সেই ঘটনাটি টানার কারণ- খেলোয়াড়দের অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের ঘটনা আগেও ঘটেছে। শাস্তির ব্যাপারটিও ঘটেছে। সাকিবের ঘটনাই সব নয়। আবার রফিকের ওই ঘটনাও একমাত্র ঘটনা নয়। আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে। যা ড্রেসিংরুম বা টিম হোটেলের বাইরে আসেনি। না আসার কারণও ছিল। তখন দলে বিকল্প খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল কম। হাবিবুল বাশার বা খালেদ মাসুদের মত খেলোয়াড়কে সরিয়ে দিয়ে তাদের জায়গায় হুট করে কাউকে খেলিয়ে দেয়ার ঝুঁকি নিতে নির্বাচকদের দুইবার ভাবতে হত। যার কারণে অনেক ঘটনা টিম ম্যানেজমেন্টকে কেবল সাবধানবাণী শোনানোর মধ্য দিয়েই এড়িয়ে যেতে হত।
আবার তখনকার খেলোয়াড়দের মাঝেও হয়তো একটা ভয় কাজ করতো। জাতীয় দলের হয়ে খেলে যাওয়া ছাড়া তাদের সামনে আয়ের অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। এখনকার মত ক্রিকেট বাণিজ্যের আসর বসতো না, দেশি লিগ যা হতো তাতেও আহামরি কোন টাকা জুটতো না। তাই অখেলোয়াড়ি আচরণ আর ব্যবস্থাগ্রহণের মাঝে সবসময়ই একটা ভারসাম্য হয়তো থাকতো। তাছাড়া আইসিসি ট্রফি জেতার পর থেকেই ক্রিকেটাররা আরো বেশি করে জাতীয় হিরো। জাতীয় দুর্নাম কুড়ানোর ভয় বা নিখাদ দেশপ্রেম থেকেও তারা হয়তো আরো বেশি করে শুদ্ধ থাকতে পেরেছে।
তবে রফিককে সেই ঘটনায় শাস্তি দেয়া হয়েছিল। কারণটা কি দলে তার অপরিহার্যতা কমে এসেছিল বলে! এটা সবার জানা যে, বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় দলের হয়ে রফিকের বিকল্প ভূমিকাই পালন করে এসেছেন। অর্থাৎ, রফিককে রাস্তা দেখানোর মত বিকল্প থাকায় ম্যানেজমেন্ট একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিল। আবার এমনটিও হতে পারে, রফিক দীর্ঘ সময় ধরেই অখেলোয়াড়ি আচরণ করে আসছিলেন। সেদিনের ঘটনা ছিল তার কয়েক দফা সাবধানবাণী অতিক্রমের দিন।
এবার আসি সাকিব আল হাসান প্রসঙ্গে। রফিকের কথা মনে করিয়ে দেয়ার অর্থ এই নয় যে- সেই ঘটনার সাথে এখনকার ঘটনার কোন মিল আছে। এখনকার ক্রিকেট আরো বেশি পেশাদার। অর্থের ঝনঝনানি পেরিয়ে এখন অর্থের ওড়াউড়ি পর্যায় চলছে। দেশি লিগ, জাতীয় দলের বেতন ভাতায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে নানা সুযোগ সুবিধায়। খেলোয়াড়রা এখন জাতীয় দলের বাইরেও টাকা রোজগার করতে পারেন। পণ্যের প্রচার, ভিনদেশি বাণিজ্যিক ক্রিকেট লিগ থেকে এক মাসের আয় কখনো কখনো জাতীয় দলের কয়েক বছরের আয়কেও ছেড়ে যায়। বিদেশ ট্যুর না হলে আগের খেলোয়াড়রা হয়তো মাথার ওপর উড়ে যাওয়া প্লেনের দিকে তাকিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। আর এখনকার খেলোয়াড়রা বাড়িতে বেড়াতে গেলেও প্লেনে যান।
তবে একটা জিনিস, সেই রফিক-বাশারদের আমলের মতই রয়ে গেছে, সেটা হলো- দলে অপরিহার্যতা। এমন নয় যে আরো বেশি করে বিকল্প খেলোয়াড় গড়ে ওঠেনি। কিছু কিছু খেলোয়াড় বরং নিজ যোগ্যতাগুণেই নিজেকে আর সবার থেকে আলাদাভাবে পরিচিত করে তুলেছেন। তাই একটা জায়গায় সেই আগের মতই মিল থেকে গেছে, "আমি তো অপরিহার্য, আমাকে পায় কে!"
সাকিবের মাঝে তেমন মানসিকতা ছিল কি না সেটা তার টিমমেম্বার বা কাছের মানুষরাই ভালো বলতে পারবেন। অন্তত মাঠে তার আচরণে সেরকম কিছু ছিল না। তাকে দলের হয়ে সবটুকু উজাড় করে দিতেই দেখেছি। দেখেছি একজন সাধারণ দর্শকের মত দলের পরাজয়ে কাঁদতে। অথচ সেই সাকিব অখেলোয়াড়সুলভ আচরণে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ৬ মাসের জন্য নিষিদ্ধ।
শাস্তির মেয়াদ এখানেই শেষ নয়। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরের কোনো লিগে খেলতে বোর্ডের অনুমতি পাবেন না তিনি। আগামী আইপিএল'সহ অনেকগুলো বিদেশি লিগে তিনি বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি এবং সেসব দলের অপরিহার্য সদস্য। আবার আচরণ না শোধরালে ভবিষ্যতে আজীবন নিষিদ্ধের ঝুঁকিও থাকছে।
কি এমন হলো যেজন্য দলের মূল সদস্যকে এত বড় শাস্তি দিতে হলো? অনেকে হয়তো ভাবছেন সম্প্রতি ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলতে যাওয়া নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থার জেরে শাস্তি পেয়েছেন সাকিব। আসলে কি তাই? আসুন সাকিবের কিছু শিরোনাম হওয়ার মত বিষয় জেনে নিই। যার প্রত্যেকটিই দুর্ভাগ্যজনকভাবে অখেলোয়াড়সুলভ।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালে এক দর্শক সাকিবের কাছে অটোগ্রাফ চান। অটোগ্রাফ দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই দর্শক কটূক্তি করেন। পরে ক্ষুব্ধ সাকিব দর্শকের কলার চেপে ধরেন।
চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি ম্যাচে ছক্কা মারতে গিয়ে লং-অফে ক্যাচ হন সাকিব। সেই আউট নিয়ে টিভি ধারাভাষ্যকাররা আলোচনা করার সময় ড্রেসিংরুমে বসে থাকা সাকিবের দিকে টিভি ক্যামেরা ধরলে অত্যন্ত গর্হিত অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেন তিনি। পরে তিন ওয়ানডেতে নিষিদ্ধ ও অর্থদণ্ড দেন।
স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে গত ১৬ জুন এক দর্শককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন সাকিব। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ চলাকালে নিয়ম ভঙ্গ করে ম্যাচ চলাকালে করিডোর সীমা অতিক্রম করে স্ত্রীর কাছে এসে এ কাণ্ড করায় শাস্তিও পেতে হয় তাকে।
এর আগে আফগানিস্তানের পেসার দওলত জারদানের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে শাস্তি পেয়েছিলেন। অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্য অধিনায়কত্ব হারিয়েছিলেন। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালে ম্যানেজমেন্টের অনুমতি না নিয়ে একটি দৈনিকে সাক্ষাতকার দিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলাসহ খাদ্য অপ্রতুলতা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন। সম্প্রতি ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলা সংক্রান্ত জটিলতায় তিনি বাংলাদেশের হয়ে আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবেন না বলে হুমকি দেয়ার অভিযোগ করেছেন সদ্য নিযুক্ত জাতীয় দল কোচ।
এমন নয় যে সাকিব আল হাসান সহধর্মিনীর সম্মান রক্ষার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে তিনি সাকিব আল হাসান বলেই সেটি আরো বেশি করে যথোপযুক্ত উপায়ে হওয়া উচিত। তার বিশৃঙ্খলতার এই তালিকা কেবল যেটা প্রকাশিত সেটাই। অনেক ক্রীড়া সাংবাদিকের মাধ্যমে এমনও শোনা গেছে যে, সবকিছু তারা প্রকাশ করতে পারেন না।
তাহলে সাকিবের সমস্যাটা কেবল আজ বা গতকালের নয়? ধীরে ধীরে দলের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠার সাথে সাথেই তার আচরণগত সমস্যাটি বৃদ্ধি পেয়েছে? হয়তো সেটাই। নয়তো বয়স ভিত্তিক দল হয়ে জাতীয় দলে অপরিহার্য হয়ে ওঠা সাকিবকে নিয়ে তো আগে এমন অভিযোগ ওঠেনি। তবে জাতীয় দলে বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে কেন বাড়ছে তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের তালিকা? আগে থেকেই তিনি কি এমন ছিলেন, সময়ের সাথে সেসবের উন্মত্ততা বেড়েছে কেবল?
তিনি অবশ্য বিসিবি'র ডাকে দেশে ফিরে বিমানবন্দরেই আত্মপক্ষ সমর্থন করে মিডিয়াতে প্রচার হওয়া বক্তব্য তার নয় বলে জানিয়েছেন। তাতেও তাকে বড় শাস্তি পেতে হলো। আসলে এটা ছিল তার ক্রমাগত অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডের ফল।
প্রশ্ন উঠছে ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির প্রধান আকরাম খানের মৌখিক অনুমতি নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। শাস্তির সময় সেই বিষয়টি নিয়ে কোন আলোচনা হয়েছে বলে বিসিবি জানায়নি। তারা বলেছে- এটি কেবল এ ঘটনার শাস্তি নয়, বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনার ফল। দীর্ঘদিন ধরেই সাকিব দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে চলেছেন। দেশের মূল খেলোয়াড় হওয়ায় এতদিন বিষয়গুলো উপেক্ষা করেছেন তারা। সাকিব কোচ-অধিনায়ক কারও কথা মানেন না। ব্যাপারগুলো অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এখন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন।
বিসিবি আরো জানিয়েছে, সাকিব দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিলেন। সাকিবের দেখাদেখি অন্যরাও এমনটা করার সাহস পাচ্ছিল। তিনি কাউকে পরোয়া করেন না। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।
এখন আকরাম খানের মৌখিক ইস্যু বা পারফরমেন্স যে কারণেই হোক, দর্শকদের সহমর্মিতা পাচ্ছেন দেশ সেরা এই ক্রিকেটার। কিন্তু আসলেই কি তার সবকিছু ক্ষমার যোগ্য? তিনি কি জানেন না ম্যাচ চলাকালে বিনা অনুমতিতে খেলোয়াড় জোন ত্যাগ করা যাবে না? মৌখিক অনুমতিইবা কেন নিতে যাবেন? সবকিছুর তো একটা নিয়ম আছে। তিনি কি সময় সংকট ছিল বলে যথাযথ নিয়মে আবেদন করে রেখে অতঃপর মৌখিক অনুমতি নিয়ে গেছেন? যদি কোন যথোপযুক্ত উপায় অবলম্বন করেই থাকেন তার উচিত সেটা প্রকাশ করে দেয়া। এতে তার প্রতি মানুষের সমর্থন আরো বাড়বে, ভুল ধারণা ঙেঙ্গে যাবে। আর যদি তা নাই করে থাকেন তবে সেটাও তারই ভুল। কেননা নিয়ম একটা থেকে থাকলে সেটা সবার জন্যই সমান। আর সেই নিয়মটা তিনি অবলম্বন না করলে সেটাও তারই দায়!
গত এক দেড় বছর ধরেই দলের পারফরমেন্সের হার নিম্নমুখী। ঠিক এই সময় ধরেই তার অনিয়ন্ত্রিত আচরণের হার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যদিও এই সময়ে তার ব্যক্তিগত পারফরমেন্স যথেষ্ট উজ্জ্বল। কিন্তু দল হিসেবে তা কোন কাজে আসেনি। কিছুদিন পরপরই শোরগোল ওঠে দলের কিছু খেলোয়াড়ের কারণে দলকে এক সুতোয় বাধা যাচ্ছে না। যার ফলাফল সরাসরি হারের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে। আর সেই কয়েকজনের মধ্যে তার নাম বরাবরই সামিল। অথচ হওয়ার কথা ছিল ভিন্ন। বাংলাদেশ দলে তো আর কম সময় হলো না তার। সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে টিম গেমের টিমকে টিম হয়ে ওঠায় কি ভূমিকা রেখেছেন তিনি? উল্টো দলের সবচেয়ে শাস্তি পাওয়া খেলোয়াড় তিনি।
কেউ কেউ আবার টানা ব্যর্থতা নিয়ে তামিমের দলে টিকে যাওয়ার সাথে সাকিবের শাস্তির বিষয়টি মেলাচ্ছেন। আমাদের এই এক সমস্যা। সমস্যার গোড়া নিয়ে না ভেবে শুধু তুলনা করে যাওয়া। আর নিজে যেটা শুনতে পছন্দ করি সেটাকেই সহি ধরে বসে থাকা। সাকিবের শাস্তির সাথে তামিমের দলে থাকার কি সম্পর্ক? সাকিবও রান না করুক, দেখি দলে রাখে না বাদ দেয়। তখন তুলনা টানা যাবে। ভুলে যাওয়া যাবে না, এটা রান না করে দলে খেলে যাওয়ার শাস্তি নয়। তাতে মূল সমস্যাটা উপেক্ষিতই থেকে যাবে। পরবর্তীতে যেটা আরো ভয়ঙ্কর হযে দেখা দিতে পারে।
কেউ যখন একই কাজ ২ বছর ধরে নিয়মিত করে যায় তখন সেটাকে পারফরমেন্স বলে। সেটা খেলায় হোক- আর শৃঙ্খলা ভঙ্গে হোক। সাকিব একজন পারফর্মার। খেলাতেও। বিশৃঙ্খলাতেও। তাহলে সে তার পারফরমেন্সের জন্য যদি পুরস্কার পায়, শাস্তি কেন পাবে না? একই কাজ লাগাতার করে যাওয়া মোটেই ভুল নয়। নেহাত বেয়াদবিও নয়। এটা বিশৃঙ্খলা। বেয়াদব মানুষকে সংশোধন না করা গেলেও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। বিশৃঙ্খল মানুষকে শেকল পরানো যায় না। এতে সে আরো বেয়াড়া হয়ে ওঠে। তখন দরকার হয় তাকে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলার। অন্তত এমন একটি উপায় অবলম্বন করার যাতে সে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে। নিজের গুরুত্ব বোঝে। আর বেয়াদব কেবল নিজের জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনে। কিন্তু বিশৃঙ্খল ব্যক্তি বিপর্যয় ডেকে আনে পুরো শৃঙ্খল সিস্টেমের জন্য। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল একটি শৃঙ্খল প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, এ সিস্টেম অব প্রেজেন্টেশন অব এ নেশন।
এর সাথে অন্যরাও যখন সেই বিশৃঙ্খল আচরণ করতে থাকে তখন সেটা কেবল অনুসরণ নয়, সংক্রামক। অথচ এমন একটি সংক্রামক ব্যাধির নিরাময়ের চেষ্টা আমরা মেনে নিতে পারছি না। আমরা বিসিবি'ব শাস্তি চাচ্ছি। কেবল এক পক্ষের শাস্তি কেন? সাকিবের কেন নয়? তাকে আমরা ভালোবাসি বলে? ক্রিকেট ভালোবাসি বলে? সাকিব তার ক্রমাগত বিশৃঙ্খলার শাস্তি পেয়েছেন। এখন ঘুণপোকা ধরা-অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত বিসিবি'র শাস্তিটা তাদের দেয়ার ব্যবস্থা করা জরুরী। এটাই বরং ক্রিকেটপ্রেমীদের সত্যিকার ভালোবাসার ধরন হওয়া উচিত। সবার আগে ক্রিকেট। কেউই ক্রিকেটের থেকে বড় নয়।
অবশ্য আশরাফুলের শাস্তির পরও অনেককে আশরাফুলের পক্ষ নিতে দেখেছি। অথচ আশরাফুল যে কি-না দেশ বেচেছে। ক্রিকেট তো একখণ্ড দেশই। সাকিবের শাস্তিটা যদি মাহমুদুল্লা বা জুনায়েদ সিদ্দিকির জন্য হত, তবে এত প্রতিবাদী পাওয়া যেত কি? হয়তো নয়। তাদের প্রতি সেই জনসমর্থন নেই। শাস্তি মওকুফ যদি শাহাদত হোসেনের জন্য চাওয়া না হয়, তবে সাকিব আল হাসানের জন্যও চাওয়া উচিত নয়। তাকে হয়তো প্রশ্রয় দিয়ে নাগালের বাইরে যেতে দিয়েছিল বিসিবি। এখন তারাই তাকে শাস্তি দিয়েছে। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই।
দিনের শেষে এমনও হতে পারতো- দুই বছর সাকিবকে ভিনদেশী লিগে খেলায় অনুমতি না দিয়ে জাতীয় দলের দরজাটা খোলা রাখা যেত। একটু বেশী সাবধানবাণী, সামান্য বেশি বকে দেয়া যেত। হাজার হোক সে তো আমাদেরই ভাই-সন্তান। পরিবারের অতি আপন সদস্যকে কিভাবে দূরে ঠেলে রাখি! ভুল তো সবাই করে। আর এই ভাইটির ভুলের শাস্তিটি যখন সবার মাথায় এসে পড়ছে, তখন সবাই মিলেই না হয় তার ভুলগুলো শোধরাতে লেগে পড়তাম। আমরা ঠিক পারতাম। যেভাবে একটি জয় বা পরাজয়েও আমরা একসাথে সামলে নিতে পারি!
সাকিবকে ছাড়াই আগামী মাসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর দলের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। তারপর জিম্বাবুয়ের সাথে খেলা। আবার ফেব্রুয়ারিতে শুরু ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে আগে দলে ফিরে এই অলরাউন্ডার নিজের সেরা ফর্ম দলকে দিতে পারবেন কিনা সেটাও ভাবনার বিষয়। সবদিক থেকেই দেশের ক্রিকেট একটি বড় শূন্যতার মাঝে পড়ে গেলো। আবার হয়তো এ ঘটনাই দলকে অনেক শূন্যতা থেকে উতরে যাবার পথ দেখিয়ে গেলো। প্রস্তুত করে গেলো মেধা আর মননের সমন্বয়ের এক আদর্শ হবার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষা। ভবিষ্যতের কথা থাক, আপাতত শুধু সাকিব নয়- দেশের ক্রিকেটও এক অর্থে শাস্তি পেল। শাস্তি পেল সমর্থক গোষ্ঠী। যারা প্রতিটি লজ্জাজনক হারের পরও চোখ মুছে বসে যেত পরের ম্যাচটিতেই জিতবো আশায়।
বিসিবি'র অবকাঠামো বা অনিয়মের যেসব অভিযোগ সামনে আসছে সেসব কিন্তু ছাড় পেয়ে যায় না। সেসবও ক্রিকেটের অংশ। কঠোরভাবে সেসবের নিরাময়েও কর্তাদের বাধ্য করা উচিত। কিন্তু এতকিছুর পরেও এর অর্থ এই নয় যে সাকিবের পক্ষ নেয়াটাই সমীচীন। কেননা তিনি কেবল নিজেকে প্রেজেন্ট করেননা, খেলোয়াড়রা পুরো দেশের মুখচ্ছবি। তাদের মাধ্যমেই বিশ্ব এখন দেশকে চিনছে! স্পষ্ট করে বললে, তারা যেভাবে শিরোনাম হন- সেভাবে। তাদের আদর্শ মেনে লাখো তরুণ প্রতিনিয়ত স্বপ্ন বুনছে। মনে রাখতে হবে কেবল সাকিবের জন্যই বাংলাদেশের ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই তিনি সাকিব আল হাসান।
সাকিব আল হাসানের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা রইলো। কেননা, ২২ গজের সীমানা থেকে অবসর নিলে একদিন মানুষ তার সাফল্যগাঁথার জায়গায় অন্ধকার সময়গুলো নিয়ে আলোচনা করুক এটা হয়তো ক্রিকেট ভাগ্যবিধায়কও চাননা! সবশেষে তিনি তো ক্রিকেটেরই বরপুত্র!
লেখক: সাহিত্যিক, ক্রীড়া সাংবাদিক, mmh21261628@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৪