রীতিমত অবিশ্বাস্য। পাঁচবারের বিশ্বকাপ বিজয়ী ব্রাজিলকে এমন শোচনীয়ভাবে হেরে যেতে হবে, ভাবতেই বিস্ময়কর মনে হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ফুটবলের প্রধান আসর স্বপ্নের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে এসে এতগুলো গোলের ব্যবধানে কেন হারতে হলো ব্রাজিলকে? কিভাবে এ ঘটনা ঘটতে পারে? এর পেছনে কি আর কোনো মারপ্যাঁচ আছে, কোনো ষড়যন্ত্র?— না। কিছুতেই এমনটা সম্ভব না। খেলতে নেমেই এত দ্রুত ব্রাজিলের পুরো টিমের ভিতরগত শক্তিমত্তা দুর্বল হয়ে পড়লো, তার পেছনে রয়েছে অন্য কারণ। একটি টিমের সার্বিক শক্তিমত্তা, ভিত্তি ও আক্রমণের মতো মনোবলের দৃঢ়তা বা টিম স্পিরিট যে কয়েকজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করে তারাই ছিল না গতকালের খেলায়। প্রধান স্ট্রাইকার নেইমার এবং রক্ষণভাগের মূল রক্ষাকবচ থিয়াগো সিলভাকে হারিয়েছে ব্রাজিল। তারাই ছিল ব্রাজিলের মূল খুঁটি। যেখানে নেইমারকে ছাড়া ব্রাজিলের গোল দেয়ার কথা ভাবাই যায় না, সেই প্রাণশক্তিকে ছাড়াই খেলতে হলো তাদের। প্রশ্ন হলো, সিলভাকে বাদ দিয়েও কি ব্রাজিল জার্মানিকে হারিয়ে দিতে পারতো না? অথবা জার্মানির মোকাবেলায় লড়াইয়ে জিততে না পারলেও একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকত পারতো না? এসব প্রশ্ন আমলে নিলেও মানে সিলভা, নেইমারকে বাদ দেয়ার পর ব্রাজিল টিমের দ্রুত দুর্বল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সত্যি মেনে নেয়া কঠিন। দুর্ভাগ্যবশত ব্রাজিল যা খেলেছে বাস্তবিকই তা খুব বেদনাদায়ক।
প্রথমার্ধের মাত্র আঠারো মিনিট। তীব্র উত্তেজনাময় একটি পর্ব। যেখানে জার্মানি মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পাঁচবার প্রায় শতবছরের সেরা একটি দেশের রক্ষণভাগ দূর্গ ভেদ করতে সক্ষম হয়। আঠারো পার হয়ে পঁচিশ মিনিটের মাথায় আঘাতে আঘাতে জার্মানি ব্রাজিলের দূর্গ ভেঙে চুরমার করে দেয়। ভেঙে পড়ে ব্রাজিলের রক্ষণভাগ। এমনকি খুবই সাধারণ আক্রমণ ঠেকিয়ে নিজেদের রক্ষা করতেও ব্যর্থ হয় তারা। কিন্তু কেন এমনটি হলো? এটি কি তবে খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে না খেলার ফসল, নাকি এর সব ব্যর্থতা ব্রাজিল কোচ লুইস ফেলিপ স্কলারির? এসব প্রশ্নই এখন খেলা পরবর্তী যুদ্ধ— তর্কবিতর্ক এবং খেলার পরের খেলা হয়ে উঠবে। ব্রাজিলের মতো একটি দেশে এ ঘটনা যে জাতীয় লজ্জার বিষয় হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
গতকাল সবচেয়ে আকষর্ণীয় দিক ছিল গ্যালারি উপচে পড়া ব্রাজিলয়ানদের জাতীয় সঙ্গীতের সুর। কিন্তু বেলো হরাইজন্তে শহরের মিনেইরাও স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হাজার হাজার ভক্তের সেই মনকাড়া সুর মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যখনই জার্মানরা বল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে তখনই ব্রাজিলিয়ান ভক্ত সমর্থকরা ফিঁসফাঁস করেছে। কিন্তু যদি সত্যিই তারা ভাবতো যে, ব্রাজিল জার্মানিকে স্তব্ধ করে দিতে পারবে, তারা যদি তাদের টিমকে কিংবা বিশ্বকাপে তাদের পুরোনো রেকর্ডের কথা জানতো তবে সেটা হয়তো তাদের জন্য ভালো ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় চার বছর আগে গেল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও ইংল্যান্ডকে ৪-১ গোলে হারিয়ে নিস্তব্ধ করে দেয় জার্মানি। ব্যাপক তীব্রতা, খেলোয়াড়ি কৌশল, নৈপুণ্য আর বল ধরে রাখার বিপুল শক্তিমত্তা দিয়ে সেবার ইংলিশ টিমকে নাস্তানাবুদ করেছিল তারা। জার্মানির জন্য সেটিও ছিল অন্যতম স্মরণীয় বিজয়। তবে কি একই ভাবমূর্তি নিয়ে গতকালের হরাইজন্তেও হাজির হয়েছিল জার্মানি?
এগারো মিনিট পরও ব্রাজিলের বিরুদ্ধে জার্মানি ১-০ গোলে চরম আক্রমণাত্মক অবস্থায় টিকে ছিল। এরপরই যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে জার্মানি। গোলের পর গোল। ২৫ মিনিটে সেই এক-শূন্য ব্যবধান আঘাতে আঘাতে হয়ে উঠলো পাঁচ-শূন্য। নিয়ম মতো ডানদিকের কর্নার পাচ্ছিল জার্মানি। আর জার্মানির সবচেয়ে লিডিং স্কোরার থমাস মুলার রীতিমত অপ্রতিরোধ্য হয়ে সুযোগ নিলো এই কর্নারের। বল ঢুকিয়ে দিল ব্রাজিলের গোলপোস্টে। কিন্তু প্রথম গোলটি দেয়ার পরবর্তী দশ মিনিটের মধ্যে অনেকেই আশা করেছিল, ব্রাজিল তার গতিতে ফিরে আসবে। কিন্তু না, জার্মানির পাওয়ার ফুটবলের কাছে শাম্বা নৃত্যের মুদ্রা থেমে গেল। দ্বিতীয় গোল হয়ে গেল, এরপর শুধু আঘাত আর আঘাত। প্রথমার্ধের প্রথম পঁচিশ মিনিটের শেষে মাত্র ছয় মিনিটেই চারটি গোল। বিশ্বকাপ তার ইতিহাসে এমন দৃশ্য আর কখনো দেখেনি।
প্রথম রাউন্ড, এরপর কোয়ার্টার ফাইনাল— সবমিলে জার্মানির ডিফেন্স ছিল পুরাপুরি কর্তৃত্বপরায়ণ। কিন্তু তারপরও কয়েকটি গোল করেছে জার্মানি। এসব পর্বে জার্মানির দেয়া প্রতিটি গোলের মধ্যে ব্যবধানও ছিল বেশ। কিন্তু সেমিতে ব্রাজিলের মতো পাঁচবারের বিশ্বসেরার বিরুদ্ধে খেলে অনন্য রেকর্ড গড়লো জার্মানি। জার্মান টিমের মিরোস্ল্যাভ ক্লোসা দিলেন দ্বিতীয় গোলটি। যার মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপের এ যাবতকালের সেরা গোলদাতা হলেন ক্লোসা। তৃতীয় এবং চতুর্থটি দিলেন টনি ক্রস। এবং সামি খেদিরা দিলেন পঞ্চম গোল। গোলের এমন এক স্রোত তৈরি করলো জার্মানি যেন তারা অন্তত দশের কোটা পুরা করবে। তবে না। সাতটা গোল করেই এবারের মতো ক্ষান্তি দিল তারা। শেষ মুহূর্তে একটি গোল করলো ব্রাজিল। এভাবে হেরে যাওয়ার পেছনে ব্রাজিলের কী সংকট ছিল?
মাঠে দেখা যায়, যখনি জার্মানি তার শক্তিমত্তা নিয়ে বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল, আর ঠিক সে মুহূর্তে ব্রাজিল নিজেই নিজের পতনের কারণ হয়ে ওঠে। শুরু থেকেই ব্রাজিল টিমটির শক্তিশালী এবং সমন্বিত কোনো গঠন ছিল না। গোল খাওয়া মাত্রই ব্রাজিল টিমের যে অখণ্ড রূপ ছিল মুহূর্তেই সেটি সামনে পিছনে বিভিন্ন প্রান্তে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। খেলার মাঠে কেউ বল না-ই পেতে পারে, কিন্তু ব্রাজিলের মতো একটি দলের ক্ষেত্রে দেখা গেল, প্রথম গোল খাওয়ার পর তারা যখন বল পায়নি, তখন বল পেতে তারা কোনো জরুরি শক্তিমত্তাও দেখাতে পারেনি। প্রায়ই দেখা গেছে, বল পাওয়ার পর বিরোধী খেলোয়াড়কে পাস কাটিয়ে যথাসম্ভব লক্ষ্য পর্যন্ত বল তুলে নিতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গোলটি হয়েছে স্রেফ জার্মানদের কৌশলগতভাবে বল কেটে কেটে নেয়ার ক্ষমতার কারণে, যেখানে কোনো খেলোয়াড়ের একক শক্তিশালী ভূমিকা ছিল না। অর্থাৎ পুরো খেলায় দেখা গেছে, বারবার ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা বল পেয়েও তার নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। বল পাস করে করে জার্মানির রক্ষণভাগ ভেদ করতে পারেনি তারা।
পরের দুটি গোলের দিকে নজর দিলেও বল নিয়ন্ত্রণে ব্রাজিলিয়ানদের ব্যর্থতা চোখে পড়ে। দেখা যায়, ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা নিজেদের এলাকাতেই বল ধরে রাখতে পারেনি। অপরদিকে জার্মানরা খুব শান্তভাবেই তাদের এলাকাকে রক্ষা করে গেছে।
দ্বিতীয়ার্ধেও দেখা গেছে ব্রাজিলের ব্যর্থতা। বেশ কয়েকটি সুযোগ পেয়েছিল ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দশ মিনিটে অন্তত তিনটি সুযোগ পায় ব্রাজিল। কিন্তু আঘাত ঠেকিয়ে দিয়েছিল জার্মানির গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নুয়্যার। এসব সুযোগ যখন মিস হয়ে গেল, তখন জার্মানির রক্ষণ এলাকা আরো অনেক বেশি কঠোর হয়ে উঠলো। পরে ক্লোসাকে বিশ্রামে পাঠিয়ে ষষ্ঠতম গোল দিলো আন্দ্রে স্কুরেল। ষষ্ঠ গোলটি যখন হয়ে গেল— বিশ্বকাপের ইতিহাসে জার্মানির গোলের হিসাবও গেল পাল্টে। একধাপ এগিয়ে দ্বিগুণ হয়ে ওঠে তাদের রেকর্ড। খেলা যখন ৭৮ মিনিট অতিক্রম করছে, ‘আপনি তখনো চেয়ে চেয়ে দেখছেন ৯৪ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরাজয়’— বললেন ডার্কে। ৭৯ মিনিটেও সাত-শূন্যের ব্যবধান। জার্মানি যেন সপ্তস্বর্গে পৌঁছে গেল। ঠিক নব্বই মিনিট যখন চলছে। মানে খেলার শেষ মিনিট। একেবারে শূন্য থাকার লজ্জা থেকে একটি গোল দিয়ে ব্রাজিলকে বাঁচালেন অস্কার। একটি গোলে বিশ্বকাপের এমন হৃদয়বিদারক খেলার দৃশ্যে লীলা সাঙ্গ করে বিরহী মঞ্চে শেষাবধি ব্রা—জিল, ব্রা—জিল, ব্রা—জিল সুরে বেজে ওঠে।
*আজ ৯ জুলাই প্রকাশিত জন ক্যাসেডির এই লেখাটি নিউ ইয়র্কার থেকে গৃহীত
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১৪