ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সমুদ্রকে শুনি

এস এম মাসুম বিল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪০ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১৪
সমুদ্রকে শুনি

ওহে  জলদলপতি !
সমুদ্র নিয়ে লিখতে গেলে আমার সবার আগে মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'সমুদ্রের প্রতি রাবণ' কবিতার কথা মনে পড়ে। ওই কবিতার একটা লাইন ছিল এরকম- `কি সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে/ প্রচেত: হা ধিক ওহে জলদলপতি!/এই কি সাজে তোমারে, অলঙ্ঘ্য, অজেয় তুমি?’ এটি ছিল পরাজয়ে সমুদ্রকে লক্ষ্য করে রাবণের পরিহাস।



কিন্তু আমাদের খেদ নেই, কারণ বাংলাদেশ ভারতের সাথে সমুদ্র সালিশীতে ন্যায়বিচার পেয়েছে। সমুদ্র অজেয় নয়। সমুদ্রের প্রতি মানুষের নেশা চিরকালীন, বলা যায়  সহজাত। সমুদ্রের সাথে রয়েছে মানুষের জীবন সংযোগ।   ইংরেজ কবি লংফেলো তাঁর 'The Secret of the Sea' কবিতায় যথার্থভাবেই লেখেন:
"Till my soul is full of longing For the secret of the sea
And the heart of the great ocean
Sends a thrilling pulse through me"

সমুদ্রহীন জাতির আফসোসের সীমা নেই!  এই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্র সালিশির রায় নিয়ে কিছু কথা পাড়া। তবে আইনের বাইরের পাঠকের কথা চিন্তা করে সমুদ্র আইনের পটভূমি একটু খোলসা করলাম, যাতে ধরতে সুবিধা হয়।  

সমুদ্র আইন
সমুদ্র আইন সমুদ্রের মতোই অতল। আন্তর্জাতিক আইন বলতে গেলে সমুদ্র আইনের হাত ধরে গতি পেয়েছে। আইনবিদ স্টার্ক-এর জবানে বলি: `আন্তর্জাতিক আইনের প্রদীপ নিভু নিভু তো দূরের কথা, এর শিখা সমুদ্রের তলদেশ থেকে মহাকাশ অবধি বিস্তৃত’।

নৌ-পরাশক্তিদের সমুদ্র দখল এর বিরুদ্ধে একজন ডাচ দার্শনিক হুগো গ্রসিয়াস উচ্চকণ্ঠ হয়েছিলেন ১৬০৯ সালে। মেরি লাইবেরাম (দ্য ফ্রিডম অব দ্য সীস) বই লিখে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের জনক হবার পথে অনেক দূর এগিয়ে যান। তিনি বললেন যে, এভাবে সমুদ্র দখল করা চলবেনা। সমুদ্রকে বাচঁতে দাও। তাঁর যুক্তি দুটি, এক. সমুদ্রতো আসলে কার্যকরভাবে দখল করা যায়না এবং দুই. প্রকৃতি তার সম্পদ কারো একার জন্য বানায় নাই।

তবু থেমে থাকেনি সমুদ্রের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। মেরি লাইবেরাম-এর বিপরীতে জন্ম নিয়েছিলো ব্রিটিশ আইনজ্ঞ জন শেলডেন প্রবর্তিত মেরি ক্লোসাম (ক্লোস  সি বা ডোমিনান্স ওভার সী)।

বিঙ্কারশেক-এর মত মনীষীরা প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন কামানের পাল্লা নীতির (cannon shot theory)। কামানের গুলি যতদুর যাবে, সমুদ্রের উপর উপকূল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ততদূর বিস্তৃত হবে!

১৯৪৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেনরী ট্রুমান ঘোষণা দিলেন যে, মার্কিন সমুদ্র মহীসোপান-এর সব সম্পদ আমেরিকার এখতিয়ারভুক্ত। সে এক প্রতিযোগিতা!  আশার কথা হচ্ছে, আধুনিক সমুদ্র আইন এই মেরি ক্লোসাম এবং মেরি লাইবেরাম মতবাদের সার্থক সমন্বয় ঘটিয়েছে।  

আনক্লস তিন
সমুদ্র আইনের সংবিধান হলো ১৯৮২ সালের জাতিসংঘের সমুদ্র বিষয়ক কনভেনশন (United Nations Convention on Law of the Sea)। সংক্ষেপে আমরা একে 'আনক্লস থ্রী' বলে ডাকি। কারণ এই কনভেনশন-এর আগেও ১৯৫৮ এবং ১৯৬০ সালে সমুদ্র অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা বসেছিলেন।

এই কনভেনশন-এর মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে দ্বিতীয়টি নেই। বর্তমানে বিশ্বের ১৬৪ টি দেশ এই কনভেনশনের পক্ষভুক্ত রাষ্ট্র। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ৯ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কনফারেন্স করে অবশেষে এই কনভেনশন গৃহীত হয় জ্যামাইকার মন্তেগো বে-তে ১৯৮২ সালের ১০ ডিসেম্বর।

চুক্তিটি কার্যকর হতে আরো ১২ বছর সময় লেগেছে। ১৯৯৪ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। আনক্লস-কে বলা হয় 'প্যাকেজ ডিল'। এর মানে হলো পৃথিবীর নানান দেশের এবং অঞ্চলের স্বার্থগুলোর সর্বোচ্চ সমন্নয় ঘটেছে এই কনভেনশনে। কনভেনশনটি সমুদ্রের উপর অধিকার খাটানোর দিক দিয়ে সমুদ্রকে ৫টি অঞ্চলে ভাগ করেছে।

তটরেখা থেকে প্রথম ১২ নটিক্যাল মাইল হলো আঞ্চলিক সমুদ্র (territorial sea), যেখানে উপকূল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিদ্যমান। বিচারক ম্যাকনায়ার সেই ১৯৫২ সালে ব্রিটেন-নরওয়ে মৎস্য শিকার মামলায় মন্তব্য করেন যে, আঞ্চলিক সমুদ্র আসলে দেশের ভূ-খণ্ডের সমমর্যাদার। আঞ্চলিক সমুদ্রের পরে আরো ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এর প্রটেকশন/পকেট জোন থাকে, যাকে বলে সন্নিহিত অঞ্চল (contiguous zone)।

তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল (exclusive economic zone- EEZ)। এখানে রাষ্ট্র সব ধরনের প্রাণ-অপ্রাণ সম্পদের উপর 'সার্বভৌম অধিকার' (সার্বভৌমত্ব নয়) খাটাতে পারে। ই.ই.জেড এর সমান্তরালে সাগরের নীচ দিয়ে যদি প্রাকৃতিক সোপান থাকে, তবে তা হবে মহীসোপান (continental shelf)। মহীসোপান যেন একটা দেশের বিস্তৃত পদযুগল, যা পানির মধ্যে শান্তভাবে ভিজিয়ে দিয়ে দেশটি বিশ্রাম নিচ্ছে।

পানিতে এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর উপকূল রাষ্ট্রের অধিকার একচেটিয়া, সার্বভৌম এবং সহজাত। ১৯৬৯ সনে উত্তর মহীসোপান মামলায় বিশ্ব আদালত এই সাব্যস্ত করেছেন যে, উপকূল রাষ্ট্র ঘোষণা করুক বা না করুক, দখলে থাক বা না থাক, তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ এই অঞ্চলে কার্যক্রম চালাতে পারবেনা। কিছু ক্ষেত্রে মহীসোপান অঞ্চল ২০০ নটিকাল মাইলের বেশি হতে পারে, তবে তা কখনোই ৩৫০ নটিকাল মাইলের বেশি হয়না। যেমন বাংলাদেশ-মায়নমার মামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এখন ২০০ নটিক্যাল মাইলের থেকে বেশি কিছু এলাকার উপর অধিকার পাবে।

২০০ নটিকাল মাইলের বাইরের সাগরকে উন্মুক্ত সমুদ্র (open sea) বলে যেখানে সব রাষ্ট্রের বিভিন্ন রকম স্বাধীনতা রযেছে। উন্মুক্ত সমুদ্রের নিচের সাগর তলদেশের কোনো সম্পদ মানবজাতির অভিন্ন উত্তরাধিকার(common heritage of mankind)। এইভাবে তৃতীয় আনক্লস সমুদ্রের উপর আইনের শাসন বিস্তৃত করেছে। শান্তিপূর্ণভাবে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি করে এবং সাগরের সম্পদের সুষম ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করে, ন্যায়ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করাই আনক্লস-এর উদ্দেশ্য। বিরোধের ন্যায়ভিত্তিক সমাধান এই আইনের রিংটোন ।  

সমুদ্র কেন গুরুত্বপূর্ণ
বিজ্ঞজনরা বলছেন, আগামীর অর্থনীতি হবে সমুদ্রের অর্থনীতি। স্থল ভিত্তিক সম্পদ সীমিত হয়ে আসছে। তাই সবার নজর এখন সাগরের অফুরন্ত সম্পদের দিকে। খাদ্য, যোগাযোগ, ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য, শক্তি, প্রাকৃতিক গ্যাস, নিরাপত্তা, পরিবেশ, গবেষণা ইত্যাদি বিবেচনায় সমুদ্রের গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। বলা হয় বঙ্গোপসাগর তেল ও গ্যাসের উপর ভাসছে। ২০০৬/২০০৮ সালে ভারত বিরোধপূর্ণ সমুদ্র এলাকায় ১০০ ট্রিলিয়ন হাইড্রো-কার্বনের খোঁজ পায়। ২০১২ সালে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়। যেখান থেকে দিনে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট ভালো মানের গ্যাস তোলা সম্ভব। আবিষ্কৃত-অনাবিষ্কৃত এই বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙলাদেশের অর্থনীতি নতুন দিগন্ত খুঁজে পেতে পারে।  

সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির উপায় এবং বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্র বিরোধ
আনক্লস সুমদ্র নিয়ে বিবাদ মীমাংসার  কিছু পথের কথা বাতলে দিয়েছে। এর পঞ্চদশ অনুচ্ছেদ শুধু বিরোধ মীমাংসা নিয়ে লিখিত। এত স্বয়ং সম্পূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা সাধারণত চোখে পড়েনা। আনক্লস-এর ব্যখ্যা বা প্রয়োগ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে পক্ষরাষ্ট্রগুলো নিচের যেকোনো ফোরামে যেতে পারে:
১. সমুদ্র বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (ইটলস)
২. আন্তর্জাতিক আদালত
৩. সাধারণ সালিশী ট্রাইব্যুনাল এবং
৪. বিশেষ সালিশী ট্রাইব্যুনাল (মাছ ধরা, সামুদ্রিক গবেষণার বিষয়ে বিশেষ কিছু ঘটনাগত প্রশ্নে)

দেখা যাচ্ছে, আনক্লস অনেক এভিনিউ খোলা রেখেছে। এত ফোরাম রাখা নিয়েও কম তর্ক হয়নি। আলাদা সমুদ্র আদালত আন্তর্জাতিক আইনের উন্মেষকে ক্ষুণ্ন করবে মর্মে বলা হয়েছে। কিন্তু আমি আগেই বলেছি, আনক্লস-এ সবার মত সন্নিবেশ করতে এবং বেশি সংখ্যক দেশকে এই কনভেনশনের পক্ষ করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিলনা।

প্রতিবেশী কিন্তু বিরোধ থাকবেনা এমনটি হয়না।   ভারতের সাথেও বাংলাদেশের অনেক বিষয়ে মনোমালিন্য ছিলো। সমুদ্র নিয়ে মন কষাকষি ৪০ বছরের পুরনো। ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের পরে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় জেগে উঠা 'দক্ষিণ-তালপট্টি'/'পূর্বাশা'/'নিউ মূর' দ্বীপ নিয়ে রেষারেষি কম হয়নি। ১৯৮৯ সালে অদৃশ্য হয়ে তালপট্টি দ্বীপ নিজেই খান্ত দিয়েছেন (একটা গবেষণা প্রবন্ধে আমি ২০১০ সাল পেয়েছি)।

কিন্তু বাংলাদেশ-ভারতের মূল সমুদ্র বিরোধ হলো সমুদ্র অঞ্চল মাপার ভিত্তিরেখা ( baseline) কোথা থেকে শুরু করতে হবে তা নিয়ে। স্বাভাবিকক্ষেত্রে, পানি থামার বিন্দু (low water mark) হলো ভিত্তিরেখা। এটাকে বলে 'নরমাল বেইসলাইন'। ভারত চায় নরমাল বেইসলাইন মানা হোক। আর সংলগ্ন দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারতের উপকূলের মধ্যবিন্দু থেকে দুই দিকে সমান সমান দূরত্বের পয়েন্ট থেকে রেখা টেনে রেখাগুলোর মিলিত বিন্দু যোগ করা 'মধ্যবর্তী রেখা' (median line) হোক দুই দেশের সমুদ্রসীমা। এটাই বহুল আলোচিত সমদূরত্ব নীতি (equidistance principle)। কিন্তু বাংলাদেশ বলছে- না, ভারতের ভূখণ্ড হলো সমুদ্রমুখী (convex) । আর সমূদ্র  হলো বাংলাদেশ ভূখণ্ডমূখী (concave)। এর ফলে বাংলাদেশ বিশেষ ভিত্তিরেখা টানার দাবিদার।

আনক্লস-এ এর সমর্থন আছে, 'স্ট্রেইট বেইসলাইন' হিসেবে। সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গিয়ে ১০ ফ্যাদম গভীরতায় ৮টি ভিত্তি বিন্দু টেনে বাংলাদেশ ভিত্তি রেখা টানতে আগ্রহী ছিলো। ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বাংলাদেশ এই অধিকার পেতে আগ্রহী ছিল।
 
এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে উভয় দেশই আঞ্চলিক সমুদ্রে এবং ই.ই.জেড ও মহীসপানে পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ এলাকা দাবি করে আসছিল। যে দেশই কোনো গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেয় বা অনুসন্ধান করে অন্যদেশ তাতে বাঁধ সাধে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ গভীর ও অগভীর সমুদ্রে ২৮টি ব্লক তৈরি করে তেল-গ্যাস খোঁজার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র দিলে ভারত-মায়ানমার আপত্তি জানায়। মায়ানমার এর সাথে ঝামেলা মিটেছে ইট্লস-এ। ভারত ইট্লস বা আই.সি.জে -র এখতিয়ারে না আশায় বাংলাদেশ সাধারণ সালিশি  ডাকে।

সালিশিতে সুবিধা হলো মামলার চলনের উপর দুই পক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং রাষ্ট্রগুলো হার-জিতের অনিশ্চয়তায় ভোগেনা। বাংলাদেশ আনক্লস-এর ২৮৭ নম্বর ধারা এবং ৭ নম্বর পরিশিষ্ট অনুসারে সালিশি ডেকে ভারতকে তার দাবিনামার নোটিশ দেয় ৮ অক্টোবর ২০০৯। সালিশ আদালতে মোট ৫ জন বিচারক ছিলেন। এর মধ্যে ঘানার জজ টমাস মিনসাহ-কে বাংলাদেশ আর পেমারাজু শ্রীনিভাসাকে ভারত মনোনীত করে।   বাকি তিনজন--অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক ইভান শিয়েরার, ফ্রান্সের বিচারক পিয়েরে কোত এবং জার্মানির অধ্যাপক রুদিগার উলফ্রাম-কে নিয়োগ দেন ইট্লস এর মহাসচিব। অধ্যাপক উলফ্রাম ট্রাইব্যুনাল-এর প্রেসিডেন্ট-ও বটে। হেগ-এ অবস্থিত স্থায়ী সালিশ আদালত সব রকম দাপ্তরিক সহায়তা দিয়েছে। যুক্তি-তর্ক হয়েছে ৯ থেকে ১৮ ডিসেম্বর ২০১৩। খরচ দুই পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হয়েছে। সালিশি করে সমুদ্র বিরোধের ইতিহাস পুরনো হলেও (গ্রিস বাদার্না, সুইডেন-ডেনমার্ক, ১৯০৯), ১৯৯৪ সালে আনক্লস কার্যকর হবার পর এপর্যন্ত সমুদ্র বিরোধ নিয়ে মোট ১২টি সালিশ বসেছে। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত বিরোধটি ছিল ১৩তম।  

দুটি দেশি আনক্লস-এর অনুসমর্থনকারী দেশ (ভারত ১৯৯৪, বাংলাদেশ ২০০১)। সালিশি ট্রাইব্যুনাল আনক্লস এবং আই.সি.জে  সংবিধির বিখ্যাত ৩৮ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন উত্স প্রয়োগ করে রায় দিয়েছেন।  

বিচার্য বিষয়
বাংলাদেশ এবং ভারত সামুদ্রিকভাবে পরস্পর লাগোয়া রাষ্ট্র। লাগোয়া রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী রেখা টেনে সমুদ্র অঞ্চল মাপতে হয়।   প্রশ্ন হলো:
এক. দুই দেশের সমুদ্রগামী ভূমি-রেখার মধ্যবিন্দু কোথায় হবে? এই বিষয়ে সম্মত ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফ রেখার মানে কি হবে? হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর প্রধান চ্যানেল কোন জায়গা  দিয়ে প্রবাহিত এবং স্থল রেখার মধ্যবিন্দু কোন চার্টের উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করতে হবে?

দুই, কিছু বিশেষ পরিস্থিতির দোহাই দিতে পারলে সমদূরত্ব নীতির ব্যতিক্রম করা যায়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ এই বিশেষ পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে 'মধ্যবর্তী রেখা' নীতির বিপরীতে 'ন্যায়ভিত্তিক রেখা' টেনে তার সমুদ্রের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে কিনা?

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্র বিরোধ হলো সমুদ্রের দিকে রেখা টানার তীরবর্তী মধ্যবিন্দু কোথা থেকে হবে, সমদূরত্ব নীতি বনাম ন্যায়পরায়ণতা নীতির, কনক্যাভিটি বনাম কনভেক্সিটির।

ভারতের যুক্তি
ভারতের প্রথম যুক্তি হলো, মাপ শুরুর বিন্দু নির্ধারণের জন্য দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের/নিউ মূর (বর্তমানে অস্তিত্বহীন) পূর্ব পাশ দিয়ে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর প্রধান স্রোত গেছে ধরতে হবে। ভারতের মতে, এতে ওই অংশে বাংলাদেশের প্রবেশ ক্ষুণ্ন হবেনা। কিন্তু বাংলাদেশ প্রস্তাবিত পশ্চিম পাশ ধরলে ভারতের ওই অংশ ভূ-বেষ্টিত হয়ে পড়ে বলে তাদের দাবি ছিল। এটা করতে গিয়ে ভারত ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফ ম্যাপ এর উপর নির্ভর করার আবেদন জানায়। এছাড়া ভারতের

অন্য কয়েকটা যুক্তি হলো:
১.  সমদূরত্ব নীতি মেনে বিভিন্ন বেস পয়েন্ট থেকে আঞ্চলিক সমুদ্র মাপতে হবে।   এর ব্যতিক্রম করলে সমুদ্রের সাধারণ পথ ক্ষুণ্ন হবে এবং এর ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটবে।
২. অবতলতা, উপকূলের অস্থিতিশীলতা, কিংবা মত্স্য সম্পদের উপর নির্ভরতা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা হতে পারেনা, কারণ আনক্লস এর ৭ (২) একটি সাধারণ অনুচ্ছেদ, শুধু বঙ্গোপসাগরের মত বিশেষ কোনো  সাগরের কথা মাথায় রেখে এটির খসড়া হয়নি।
৩. বাংলাদেশ উত্থাপিত বিভিন্ন মামলার নজির প্রেক্ষাপট বহির্ভূত।

বাংলাদেশের যুক্তি
বঙ্গোপসাগর খুব অদ্ভূত ধরনের সাগর। এরকম সাগর বিশ্বে বিরল। ভারত প্রস্তাবিত রেখা মানলে বাংলাদেশের নিজের সমুদ্র বলে কিছু থাকেনা। বাংলাদেশ সমুদ্রে আটকা পড়ে, 'স্যান্ডউইচড' হয়ে যায়। বাংলাদেশ ৫ বালামে তার লিখিত যুক্তি ও তথ্যাদি দাখিল করে। এর কিছু পয়েন্ট হলো:
এক. ভূমি মধ্যরেখা (যেখান থেকে সমুদ্র মাপা শুরু হবে) হবে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মেইন চ্যানেল যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সেখান থেকে এবং তা হবে বি. এ চার্ট ৮৫৯ অনুসারে, ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফ মাপ অনুসারে নয়। বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টিকে অস্তিত্বহীন ধরে তার যুক্তি উপস্থাপন করেছে।
দুই. আঞ্চলিক সমুদ্র মাপার জন্য আনক্লস-এর ১৫ অনুচ্ছেদ শুধু সমতাদূরত্ব নীতির কথাই বলেনি, বরং দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তির উপস্থিতি, ঐতিহাসিক স্বত্ত্ব বা বিশেষ পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এর ব্যতিক্রম করা আইনসিদ্ধ। বাংলাদেশ চেষ্টা করেছে এটা বোঝাতে যে, তার কেসটা 'বিশেষ' কেস।
তিন. ন্যায়ভিত্তিক সমাধানে পৌঁছানোর জন্য আঞ্চলিক সমুদ্র, ই.ই.জেড এবং ২০০ নটিকাল মাইল মহীসপানে বাংলাদেশ 'অ্যাঙ্গেল-বাই-সেক্টর' নীতি (পক্ষদ্বয়ের তীরের সামগ্রিক দিকবিধি ঠিক করে লাইন টেনে যে ঘের তৈরি হবে তার আনুপাতিক বিভাজন) প্রস্তাব করেছিল। এ মর্মে পূর্ববর্তী কিছু মামলার

উদাহরণ বাংলাদেশ তুলে ধরে:
১. ১৯৮৪ সালের আমেরিকা-কানাডার মধ্যে গালফ অব মেইন মামলা এবং ২০০৭ সালের নিকারাগুয়া-হণ্ডুরাস মামলার প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশ 'অ্যাঙ্গেল-বাই-সেক্টর' পদ্ধতি প্রয়োগ করার আর্জি জানায়। এই পদ্ধতি ন্যায্যতার কাছাকাছি। এছাড়াও ন্যায্যতার-র সমর্থনে আরো কিছু মামলার কথা উঠে আসে। যেমন: 
২. নরওয়ে এবং বৃটেনের মধ্যে মাছ ধরার মামলায় ১৯৫১ সালে আই.সি.জে অসম, খাঁজকাটা, অদ্ভুত উপকূলের ক্ষেত্রে 'ইকুইটি'-র নীতি প্রয়োগ করেছিলেন।
৩. ১৯৬৯ সনের জার্মানি-নেদারল্যান্ডস-ডেনমার্ক এর মধ্যে উত্তর মহিসোপান মামলাসমূহে ভৌগলিক, ভূতাত্ত্বিক এবং ভূ-সমরূপতাকে সমুদ্রসীমা মাপার প্রাসঙ্গিক হিসবে ধরা হয়েছে।
৪. আনক্লস-এর ৭৩ এবং ৮৪ অনুচ্ছেদ-এ 'ন্যায়-ভিত্তিক সমাধানে' উপনীত হওয়ার কথা বলা আছে। তিউনিশিয়া/লিবিয়া (১৯৮২) মামলায় বিশ্ব আদালত 'ন্যায়-ভিত্তিক সমাধানে' পৌঁছানোর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
৫. ব্রিটেন-ফ্রান্স মহীসোপান মামলায় (১৯৭৭) বিশেষ পরিস্থিতির বিবেচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর বিশেষ পরিস্থিতি হলো অস্থিতিশীল এবং উত্তল উপকূল রেখা। এছাড়া মত্স্য সম্পদের উপর বাংলাদেশের নির্ভরতাকে বিশেষ অবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তি দেয়।  
৬. এছাড়া লিবিয়া-মালটা মামলা এবং গিনি-বিসাউ (১৯৮৫) মামলা, নিকারাগুয়া -কলম্বিয়া মামলার কথাও উঠে এসেছে।   

৭. ২০০ নটিকাল মাইলের বাইরে মহীসোপানের উপর দাবি আদায়ের জন্য বাংলাদেশ বেঙ্গল ব-দ্বীপের 'প্রাকৃতিক উলম্বন/দীর্ঘায়ন' (natural prolongation) নীতির কথা পাড়ে।

এই সালিশিতে বাংলাদেশের তিনটি মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা ছিল।   এক. বাংলাদেশের উপকূল যে অবতল, তার বাস্তবতা আগে থেকে ১৯৬৯ সনের উত্তর মহীসোপান মামলায় স্বীকৃত ছিল। ওই মামলায় জার্মানী সুনির্দিষ্টভাবে তার উপকূলের অবতলতা (concavity) বুঝাতে তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) উদাহরণ ব্যবহার করেছিল (আই.সি.জে, উত্তর মহিসোপান মামলা, বালাম ১, পৃষ্ঠা ৪২)।   দুই.  বিচ্ছিন্ন না করার নীতি (cut off effect) মাধ্যমে কোনো দেশকে সমুদ্র থেকে একঘরে করে ফেলা যাবেনা- তা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনসহ খুব সম্প্রতি বাংলাদেশ-মায়ানমার মামলায় সাব্যস্ত হয়ে ছিল।   তিন. ন্যায়পরায়ণতাকে সমতা নীতির সাথে সন্নিবেশ করার একটা প্রবণতা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন জুরিস্প্রুডেন্স-এ সবসময়-ই ছিল।  

সালিশ ট্রাইব্যুনাল-এর ফয়সালা
স্থলভাগের মধ্যবিন্দু নির্ণয়ের জন্য ট্রাইব্যুনাল ভারতের যুক্তি গ্রহণ করেছে এবং যে বিন্দুকে সনাক্ত করেছে তাতে দক্ষিণ তালপট্টি বেঁচে থাকলে ভারতের অংশে পড়ত। মজার ব্যপার হলো, ওই অংশকে ভারত 'low tide elevation' হিসেবে  দেখিয়ে ওখানে বেস পয়েন্ট ধরতে চাইলে ট্রাইব্যুনাল তা নাকচ করেছেন। অন্যান্য বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশ ও ভারত কোনো দেশেরই যুক্তি সম্পূর্ণ গ্রহণ করেননি। দুটির মধ্যে সমন্বয় করে ন্যায়ভিত্তিক সমাধান দিয়েছেন।

ভারত প্রস্তাবিত শুধু সমতাদূরত্ব নীতি যেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি, আবার বাংলাদেশ উপস্থাপিত 'অ্যাঙ্গেল-বাইসেক্ট' নীতিও পূর্ণাঙ্গ নয়। ১২ মাইল আঞ্চলিক সমুদ্র মাপার সময় ট্রাইব্যুনাল নির্ধারিত স্থলরেখার মধ্যবিন্দুর অবস্থান নিজেই  একটা 'বিশেষ' অবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সারকথা হলো, মধ্যবর্তী রেখা নীতি ঠিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশেরও দাবিকে অস্বীকার করা যাবেনা। ট্রাইব্যুনাল বঙ্গোপসাগরের অস্থিতিশীল উপকূলকে বিশেষ অবস্থার স্বীকৃতি দেননি। মাছের উপর নির্ভরতা প্রশ্নে বাংলাদেশ গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি।

কিন্তু বাংলাদেশ উতরে গেছে 'কনক্যাভিটি' প্রশ্নে। এটি বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল সমুদ্র এলাকার যথাযথ সমন্বয় করে দিয়েছেন। আবার, ২০০ নটিকাল মাইলের বাইরের মহীসোপানের (আরো প্রায় ১৫০ মাইল) উপর দাবির প্রশ্নে বাংলাদেশ যে 'প্রাকৃতিক দীর্ঘায়ণ' তত্ত্বের উপর নির্ভর করেছিল, ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ না করে, বরং 'কাট-অফ' নীতির আলোকে বাংলাদেশের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছেন। বলা হয়, ইক্যুইটি নিজেই সমুদ্র অঞ্চল মাপার কোনো নীতি নয়, এটা একটা উদ্দেশ্য মাত্র [আই.সি.জে , নাইজেরিয়া/ক্যামেরুন (২০০২)]।

তাই সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রবণতা ছিলো সমতা দূরত্ব নীতি প্রয়োগ করে ন্যায়-ভিত্তিক উপাদানগুলো বিবেচনায় নিয়ে সীমারেখা সমন্বয় করে দেয়া বা পক্ষগুলোকে সমন্বয় করে নিতে বলা (ব্লাক সী মামলা, ২০০৯)।

বাংলাদেশ-ভারত ফয়সালাটি-তে সেই বিবেচনার ধারা অব্যাহত রেখেছে। এই রায়ের ফলে বিরোধপূর্ণ এলাকার ১৯,৪৬৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের এবং বাকি ৬,১৩৫ বর্গকিলোমিটার ভারতের ভাগে পড়েছে। ২০০ নটিকাল মাইলের বাইরে একটা 'ধূসর এলাকা' আছে, যেখানে বাংলাদেশ শুধু মহীসোপানের উপর অধিকার খাটাতে পারবে, কারণ এলাকাটা ভারতের ই.ই.জেড-কে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

সবশেষে ট্রাইব্যুনাল দুই দেশের প্রাপ্ত এলাকাকে মোট সমুদ্র এলাকার সাথে তুলনা করে তা 'আনুপাতিক' মানদণ্ডে (disproportionality test) গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে মত দিয়েছেন।

রায়ের গুরুত্ব
যেহেতু এটা একটা সালিশি মামলা, তাই জয় পরাজয় দিয়ে একে মূল্যায়ন করা অনুচিত হবে। সালিশি একটা বোঝাপড়ার ব্যাপার। এর ফলে ভারতও নিশ্চয় তাদের সমুদ্র নীতি পর্যালোচনার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কারণে এই ফয়সালাটা গুরুত্ব বহণ করবে:
এক. ১৯,৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার উপর আমাদের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অঞ্চলের প্রাণ-সঞ্জীবিত কিম্বা প্রাকৃতিক (living or non-living) সকল রকম সম্পদের উপর বাংলাদেশ এখন তার সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে।
মৎস্য সম্পদ বা প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণ, উত্তোলোন, সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা করতে পারবে। পানি ও বাতাস থেকে শক্তি সৃষ্টিসহ নানান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে। এছাড়া কৃত্রিম দ্বীপ, অন্যান্য স্থাপনা তৈরি, সামুদ্রিক গবেষণা পরিচালনা এবং সামুদ্রিক পরিবেশ সুরক্ষার আয়োজন করতে পারবে।

একটা কথা মনে রাখতে হবে ই.ই.জেড-এ উপকূল রাষ্ট্রের এই অধিকারগুলো অন্যান্য দেশের কিছু নায্য অধিকারকে ক্ষুণ্ন করতে পারবেনা (যেমন পরিক্রমণ, উড্ডয়ন, সাব-মেরিন ক্যাবল বসানো)  তাছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে ধরনযোগ্য (allowable catch) মাছের পরিমাণ নির্ধারণ করার ব্যাপারে একমত হতে হয়।

দুই. আমাদের সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে সম্পত্তি বলতে আমরা সমুদ্রের সম্পত্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করেছি। সংবিধানের ২(খ) নং অনুচ্ছেদে দেশের সীমানা নিয়ে যে আমরা বলেছি 'এবং আর যে যে এলাকা বাংলাদেশের অধিভুক্ত হইবে'--তার যেন পূর্ণতা হিসেবে এই রায় হাজির হলো।  

তিন. প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্র বিরোধের শান্তিপূর্ণ সুরাহা হবে। এতে করে প্রতিবেশী দেশগুলো নিজেদের আবিষ্কার করতে পারবে। এই ফয়সালার একটা স্পিরিট হতে পারে: প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্কের 'সুষমা' ছড়াক, 'মদি'র হওয়া বয়ে যাক, সবার মুখে 'হাসি' ফুটুক!

চার. আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনবিজ্ঞান-এ বাংলাদেশ একটি জ্বলজ্বলে নাম হলো।   বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমার মামলাটি পৃথিবীব্যাপী পাঠ্য ও গবেষিত হবে। অন্য দেশের বিরোধ নিষ্পত্তিতে এটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। এটা একদিকে যেমন শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমাদের অঙ্গীকার সবার সামনে প্রতিভাত করবে, তেমনি আমাদের মেধাতাত্ত্বিক সৌন্দর্যকে উপস্থাপিত করবে।   

পাঁচ. সমুদ্র বিষয়ে জানতে আরো আগ্রহী হবো সবাই।  

একটা গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো ২১ ডিগ্রি ৩৮ মিনিট ৪০.২ সেকেন্ড  উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯ ডিগ্রি ৯ মিনিট ২০ সেকেন্ড পূর্ব দ্রাঘিমাংশে মধ্যবিন্দু টানাতে যেটি হয়েছে যদি দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ জীবিত থাকতো তবে তা ভারতের অংশে পড়ে যেতো। এটি নিমজ্জিত হওয়ায় আমি মনে করি এর ন্যাচারাল ডেথ হয়েছে। এটি নিয়ে রাজনৈতিক তাড়িত না হয়ে আমাদের আরো বাস্তববাদী হওয়া দরকার। পানি ঘোলা করার কোনো মানে নেই। দ্বীপটি জেগে থাকলে সালিশি আদালতের বিবেচনাকে সেটি প্রভাবিত করতে পারতো, তা হয়নি। ভবিষ্যতে শত বছরে এটি জাগবে কিনা তা নিশ্চিত নয়, জাগলে কোথায়, কখন জাগবে কেউ জানেনা। এই অনিশ্চয়তার  উপর আইন কাজ করতে পারেনা। এতে বাংলাদেশ একেবারেই কিছু হারায়নি, এবং একটা অংশে এর প্রবেশ্যতা এখনো জারি আছে। সালিশিতে দুই পক্ষকেই কিছু কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়। তবে আমার মনে হয়েছে আইনবৈজ্ঞানিক যুক্তিতে বাংলাদেশ একদম নতুন কোনো তত্ত্ব  প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও তাতে তার কোনো ক্ষতি হয়নি।    

ঘুমানোর আগে পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ:
সম্পদ একদিক দিয়ে যেমন সম্ভাবনা অন্যদিক দিয়ে তা বোঝা। সম্পদের ব্যবহার না জানলে বা উত্তোলন করতে না পারলে তা বোঝা  হয়ে যায় বৈকি। 'বুঝ'লে 'বোঝা' নিতে হয়। আমরা যখন 'বুঝতে' পেরেছি সমুদ্র গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের সমুদ্র আছে তাহলে কিছু 'বোঝা' বা দায়  নিতে হবে। শুধু 'সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে তোমার কপালে  ছোঁয়াবগো ভাবি মনে মনে' কনসেপ্টে বসে থাকলে হবেনা। সী পলিটিক্স-ও আছে!

১। বুঝেশুনে সাগর বিষয়ক চুক্তি করতে ও ইজারা দিতে হবে। সরকারের প্রজ্ঞা দেখানোর দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা আরো এক ধাপ বেড়ে গেলো। জবাবদিহিতার অভাবে 'sovereignty' 'so..barren..ty'-তে পরিণত হওয়ার আশংকা থাকে। রায় থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা অর্জনের জন্য ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। তাই এটিকে বিজয় না বলে 'উইন -উইন' অবস্থা বলাই সমীচীন। যদিও এর একটা রাজনৈতিক মূল্য নিশ্চয় আছে। প্রকৃতিগতভাবেই সালিশে কোনো পক্ষ জেতেনা।

 'ট্রাজেডি অব কমন্স' বলে সমুদ্র আইনে একটা পুরনো কথা আছে। যৌথ সম্পদ আহরণ ও বাজারজাত করা ঝামেলার। এজন্য দরকার হবে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কৌশল ও কাঠামো সৃষ্টি।

যেমন গ্যাস ব্লক কাকে কোন শর্তের ভিত্তিতে খুঁজতে দিতে হবে, অতিরিক্ত যে মাছ এখন আমরা ধরতে পারব তার বাজার ব্যবস্থাপনা কেমন হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ হবে ইত্যাদি ঠিক করতে হবে।  

১৯৭৪ সালের আমাদের যে মেরিটাইম আইনটা রয়েছে তা সাগর ব্যবস্থাপনার সব দিক মাথায় নিয়ে যুগোপযোগী করতে হবে। রাশিয়া, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া এবং গিনির মত দেশের ই.ই.জেড ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে মাত্স্যচারণ ক্ষেত্র, সামুদ্রিক শান্তি, সমুদ্রের অভিবাসি প্রজাতির (migratory species) সুরক্ষা, বে-আইনি ও অপরিমিত মত্স্য শিকার, পরিবেশ সতর্কতা, তথ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে সমন্নিত উপকূলীয় ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে।

দক্ষিণ চীন সাগরের দেশগুলোর মধ্যে এবং প্যাসিফিক দীপপুঞ্জের দেশগুলোর মধ্যে এরকম আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনার উদহারণ দেখা যায়। বিমসটেক, সার্ক, এসকাপ, ইউনেপ, এপফিক এর মত সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে ফোরাম হিসেবে কাজ করতে পারে।       

২। আইন ও নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি ওশান গভর্নেন্স ইনস্টিটিউশন সৃষ্টি করা না গেলে সব সাফল্য ম্লান হতে বাধ্য। সাগর নীতি ও বিজ্ঞানের মধ্যে সার্থক যোগসাজশ তৈরি করতে হবে। ই.ই.জেড-এর উন্মেষ ওশান গভর্নেন্স ইনস্টিটিউশন তৈরির প্রয়োজনিয়তা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। সমুদ্র আইনের মার্কিন বিশেষজ্ঞ আর. ডাব্লেউ স্মিথ যথার্থই বলেছেন: "ই.ই.জেড-এর ধারণা সমুদ্র আইনে বিপ্লব এনে দিয়েছে"।   আমাদের সামনে এখন বড় প্রশ্ন হলো 'ওশান গভর্নেন্স ইনস্টিটিউশন' আমাদের আছে কিনা, থাকলে তার প্রকৃতি, কার্যকারিতার মান কোন পর্যায়ে রয়েছে সেদিকে নজর দেয়া।

৩। গবেষণা ও পাঠ: সমুদ্র বাস্তুসংস্থানের (marine ecology) সাথে মানবজাতির সংযোগ বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। তাই এ বিষয়ে গবেষণার বিকল্প নেই। বাংলাদেশ-এ সমুদ্র বিষয়টি বেশিমাত্রায় সামরিক ও প্রতিরক্ষামূলক। এর পরিসর বাড়াতে হবে। মায়ানমারের সাথে মামলা জেতার পরে সমুদ্র আইন পড়াকে সরকারিভাবে উত্সাহিত করা হয়েছে। যা শুভ লক্ষণ। কিন্তু এটাই শেষ নয়।

আমাদের ইউনিভার্সিটি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসাথে বসতে হবে, সমুদ্র পাঠ ও গবেষণার পরিসর এবং মান কিভাবে বাড়ানো যায় ভাবতে হবে। সরকার এ বিষয়ে গবেষণা তহবিল সৃষ্টির পাশাপাশি বিদেশের নামকরা সামুদ্রিক ইনস্টিটিউশন ও ভার্সিটিগুলোর সাথে কথা বলে আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমুদ্র বিজ্ঞান ও সমুদ্র আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়াতে পারে।

শেষের আগে:
আইন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমার মাঝে মাঝে প্রফেটিক মনে হয়। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন নিয়ে তিনি যা ভেবেছেন, ১৯৯৮ সালে রোমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা নিয়ে ভাবছেন। ১৯৭৪ সালে শিশু অধিকার নিয়ে তিনি যে আইন করে গেছেন, তার অনেক পরে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ তা ভেবেছে শিশু সনদে।  

১৯৭৪ সালে সমুদ্র আইন করে রেখেছেন তিনি। তিনি যখন একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধারণা (ই.ই.জেড.) ১৯৭৪ সালের আইনে লেখান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার কথা ভেবেছে ১৯৮২ সালে আনক্লস-এ । শেখ হাসিনা ২০০১ সালে আনক্লস অনুসমর্থন না করলে আমরা এই বিষয়ে কথায়ই বলতে পারতামনা।
২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক সালিশটি ডাকার জন্য দীপুমনিকে আশীর্বাদ করতে হয়। অনেক গণমাধ্যম তার ব্যপারে যে 'চাঁদপুরের চন্দ্র অভিযান' তত্ত্ব প্রচার করেছেন তা তারা রিভিউ করবেন আশা করি। এ এইচ মাহমুদ আলী মামলার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।

কমোডোর খুরশেদ আলমকে আমাদের সাধুবাদ না জানালে মেধার অবমাননা হবে। আনক্লস-এর জন্মতিথিতে ১৯৮২ সালে তিনি বাংলাদেশ দলে ছিলেন বলে জানি, সমুদ্র আইন নিয়ে তার দরদ আমাদের উজ্জীবিত করে। আমরা তার জন্য গর্বিত।

সরকার প্রফেসর জেমস ক্রফোর্ড, পায়াম আখাভান, লরেন্স মার্টিন, পল রেইখলার, আল্যান বয়েল এবং ফিলিপ স্যান্ডস এর মতো সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক আইনের পণ্ডিতদের বাংলাদেশের পক্ষে কৌসুলি নিযুক্ত করে ব্যপারটা  সিরিয়াসলি নিয়েছেন। এজন্য নির্মোহভাবে সরকার ও তারা ধন্যবাদার্হ্য। আরো ধন্যবাদ পাবেন এখন যদি তারা বাংলাদেশ থেকে এরকম মানের বিশেষজ্ঞ তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সবাইকে শুভেচ্ছা। মাভৈ!
 এস এম মাসুম বিল্লাহ: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক। বর্তমানে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটনে পিএইচডি গবেষণারত, billah002@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৩ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।