হুমায়ূন আহমেদের অনুপস্থিতি বাংলা সাহিত্যে এক বড় শূন্যতা তৈরি করেছে। এই শূন্যতা কীভাবে পূরণ হতে পারে, তা এখন অনেকের বোধে ও মননে আবর্তিত হচ্ছে।
আশির দশকের শুরুতে আমরা দেখেছি, বইয়ের দোকানের যে কোনো বই মানেই কোলকাতা-কেন্দ্রিক বই। ফিকশন-ননফিকশন, যে কোনো ধরনের বইয়ের উৎস ছিল কোলকাতার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো।
আজ সেই অবস্থা পাল্টে গেছে। হুমায়ূন আহমেদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ওপার বাংলার সেই প্রাধান্যকে খর্ব করেছে। বাংলাদেশের যে কোনো বইয়ের দোকানের সম্মুখসারিতে এখন আর সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ বাবুকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে এখন হুমায়ূন-জাফর ইকবাল-মিলন-আনিসুল হক শোভা পাচ্ছেন। এটা সত্যিই বড় এক আনন্দের বিষয়!
হুমায়ূন আহমেদের মহাপ্রয়াণে আজ অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আমরা কি সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠালব্ধ এই প্রাধান্য ধরে রাখতে পারবো! সম্ভাবনাগুলো আলোচনায় আনা যাক-
১) আমাদের সাহিত্যের সাম্প্রতিক পটভূমি কি! বাংলার অনেক মানুষ চায়নি, তবুও ১৯৪৭-এ দেশভাগ হলো, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। ইংরেজরা মূলত এটাই চেয়েছিল।
৪৭-এর পর বাংলার বৃহৎ অংশ অর্থাৎ পূর্ববাংলায় (পূর্ব পাকিস্তানে) আমাদের জীবনযাত্রা শুরু হলো। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম পশ্চিম বাংলা থেকে। এ যেন এক মায়ের দুই ভাই ভিন্ন দুই দেশে বড় হতে থাকলো। গত ৬৫ বছরে এই দুই ভাই কিংবা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জীবন ও জীবন অভিজ্ঞতা কি এক ছিল? নাহ্। আমাদের যাত্রা অনেকখানি আলাদা হয়ে গেছে, পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের থেকে।
২) গত ৬৫ বছরে আমরা কেমন ছিলাম? ১৯৪৭-এর পর, পূর্ববাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) বাঙালিদের জীবন আবর্তিত হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণের মধ্য দিয়ে। ১৯৫২ সালে আমরা বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪-তে নির্বাচনে জিতেও দেশ পরিচালনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরা এই বাঙালি জাতি।
১৯৬২-তে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গনঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ধীরে ধীরে বদলে দেয়। ৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ব্যাপৃত হই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। যে আন্দোলন এখনো চলছে।
অন্যদিকে, পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জীবন সংগ্রামটা ছিল অন্যরকম। ১৯৬৮-১৯৭৪ এর নকশাল বাড়ির আন্দোলন ছিল পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জীবনে এক বড় ঘটনা; যা পরবর্তীতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এছাড়া গত ৬৫ বছরে ওখানে বাঙালি ও অবাঙালিদের দ্বন্দ্বই অন্যতম মূল ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে; যা এখনো আছে। অর্থাৎ গত অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দুই দেশের বাঙালিরা জীবন সংগ্রামের জায়গায় অনেকখানি আলাদা ছিল। আমরা যেমন তাদের ‘বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্ব’ ও ‘নকশাল আন্দোলন’ বুঝি না, তেমনি আমাদের ৫২, ৬৯, ৭১ কিংবা ৯০-এর ঘটনাপ্রবাহ ওপার বাংলার বাঙালিরা বোঝে না।
এছাড়া অনেক পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সামাজিক ইস্যু যেমন, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন প্রক্রিয়া, ধর্মীয় সংস্কৃতি আমাদের আরো দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
সাহিত্য মূলত বর্তমানের জীবন নিয়ে আবর্তিত হয়। অতীতও আস, তবে কম। তাই আমরা দেখি, পশ্চিম বাংলার লেখকদের লেখায় আমাদের বর্তমান ও সাম্প্রতিক অতীত অনুপস্থিত। একইভাবে বাংলাদেশের লেখকদের লেখায় পশ্চিম বাংলার জীবন ও জীবন সংগ্রাম অনুপস্থিত। আমরা ক্রমশ সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে এবং চর্চায় আলাদা ও অচেনা হয়ে যাচ্ছি, অভিন্ন মাটির সন্তান হওয়া সত্ত্বেও। এ কারণেই, বাংলাদেশের লেখকদের বইয়ের বিক্রি ওপার বাংলায় কম। তেমনি ওপার বাংলার লেখকদের বইয়ের বিক্রি বাংলাদেশে ধীরে ধীরে কমে গেছে। দুঃখজনকভাবে এ অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে।
৩) পশ্চিম বাংলায় বাংলা চর্চা এখন কোন পর্যায়ে? ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী এখন বোম্বে ও চেন্নাই। সারা ভারতের তরুণরা তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে এখন হিন্দি ভাষায়। মৃণাল সেন তার জীবনের শেষদিকের বিখ্যাত চলচিত্রগুলো (পার, খান্ডার) নির্মাণ করলেন ওই হিন্দিতে; বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও। অনেক মেধাবী বাঙালিরাও এখন তাই করছেন। কোলকাতার বাঙালিরা ঘরের বাইরে এখন অর্ধেক সময়ই হিন্দি বলেন, যা বাড়বে ভবিষ্যতে। আগামী ৫০ বছর পর হয়ত বাংলা হয়ে যাবে তাদের ঘরের ভাষা। সেই দিনগুলোতে সাহিত্য চর্চার অবস্থাও যে কমতির দিকে যাবে, তা সহজেই অনুমেয়!
৪) সার্বিক বিবেচনায় যে কারো মনে হবে, বাংলাদেশের লেখকরা আন্তরিকভাবে চাইলে এবং আরো খানিকটা পরিশ্রমী হলে, সাহিত্য ও বইয়ের বাজারের প্রাধান্য ধরে রাখা তাদের পক্ষে কঠিন হবে না। একাজে অবশ্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহযোগিতা ভীষণভাবে বাঞ্ছনীয়।
ক) প্রিন্ট মিডিয়া: জাতীয় দৈনিকগুলোর ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক বছরে ঈদ বিশেষ সংখ্যাগুলোতে দেখা গেছে, ওপার বাংলার লেখকদের লেখার ছড়াছড়ি। অথচ, দুই/একটা ব্যতিক্রম বাদে, ওপার বাংলার পত্রিকাগুলো তো আমাদের লেখকদের লেখা ছাপেই না। তা হলে, একাজটি আমরা কেন করি? কেন আমরা তাদের লেখা ছাপিয়ে এদেশে তাদের বাজার সৃষ্টিতে সহায়তা করি? আমাদের তো অসংখ্য নবীন লেখক আছেন, যাদের লেখা কোথাও ছাপা হচ্ছে না। আমরা কি তাদের লেখা ছাপাতে পারি না? সুযোগ পেলে এইসব অখ্যাত নবীনরাই তো এক সময় ভালো লিখবেন, নেতৃত্ব দেবেন।
খ) ইলেকট্রনিক মিডিয়া: টিভি চ্যানেলগুলোরও অপরিসীম ভূমিকা আছে, দায়িত্ব আছে। তাদের উচিত প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদেরও পরিচয় করিয়ে দেওয়া। লেখক ও শিল্পীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুষ্ঠান করতে পারে তারা।
চ্যানেলগুলোর মনে রাখতে হবে, ভালো নাটক কিংবা ধারাবাহিকের স্ক্রিপ্ট পেতে হলে নবীন/প্রবীণ লেখকদের উৎসাহিত করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অথচ তারা কী করছে! আমাদের লেখক-শিল্পীদের মূল্যায়ন না করে, ছুটছে ওপার বাংলার লেখক-শিল্পীদের পেছনে, তাদের গল্পের পিছনে! অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে চ্যানেলগুলোকে।
গ) বাংলাদেশের প্রকাশকদের উদ্দেশে অভিযোগ আছে। তারা বইয়ের দাম আকাশচুম্বী করে ফেলেছেন। অন্যপ্রকাশ, কাকলী, অন্বেষা- এই প্রকাশনাগুলোর বইয়ের দাম সত্যিই বেশি। পশ্চিম বাংলার প্রকাশনার সঙ্গে তুলনা করলে এই সত্যটি আরো প্রকটভাবে ধরা পড়ে। আমাদের প্রকাশকদের এই অভিযোগটি আমলে নিতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, হুমায়ূন ক্রেজ প্রায় শেষ, পাঠকরা আগামীতে বই কিনবেন হিসাব করে।
নতুন লেখকদের ভালো বই প্রকাশ করে, লেখক সৃষ্টির সাহসী দায়িত্ব, প্রকাশকদেরও নিতে হবে। কে বলতে পারে, আজকের নতুন একজন লেখক আগামী দিনের হুমায়ূন আহমেদ নয়!
ঘ) দায়িত্ব আছে, আমাদের লেখকদেরও। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একজন পরিশ্রমী লেখক। একা লিখতেন ৩/৪ জনের লেখা। তার অনুপস্থিতিতে আমাদের লেখকদের লেখার পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। সাহিত্যের পাঠক বাংলাদেশে এখন অনেক বেশি, বইয়ের ক্রেতাও বেশি। সুতরাং, লেখকদের বাড়তি পরিশ্রমের সময় এসেছে। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের প্রতি অনুরোধ, তিনি যেন বড়দের জন্যও লেখেন। বড় ভাইয়ের জায়গায় পাঠকরা তাকে চাইতে পারে। ইমদাদুল হক মিলনকে আমরা চিনি ‘নূরজাহান’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘পরাধীনতা’ দিয়ে। এই মানের আরো বই আমরা তার থেকে চাই ।
‘যাঁরা ভোর এনেছিল’ এবং ‘মা’ দিয়ে আনিসুল হক হইচই ফেলে দিয়েছেন। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা এখন অনেক। সেলিনা হোসেন, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, লুৎফর রহমান রিটন- এদের প্রতি পাঠকদের ভরসা ও শ্রদ্ধা বরাবরের। তারা আরো প্রবাহিত হতে থাকুক বর্ষার নদীর আবেগে।
পশ্চিম বাংলার লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, আগামীতে বাংলাদেশই হবে বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্বদানকারী। হুমায়ূন আহমেদ নেতৃত্বের সেই কাজটি শুরু করে গেছেন। অর্থাৎ কোলকাতা নয়, ঢাকাই এখন বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্বদানকারী।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের বর্তমান লেখক-সাহিত্যিকেরা সেই অবস্থানটি ঠিকই ধরে রাখবেন। অন্তহীন শুভেচ্ছা থাকলো সম্পৃক্ত সবার উদ্দেশে।
শাফিন রাশেদ: লেখক ও চিকিৎসক, অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী