রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের রয়েছে সাংবিধানিক আইনি সম্পর্ক। সে কারণে নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টি যেমন রয়েছে তেমনি এসব সাংবিধানিক সম্পর্ক ও অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
ইসরাইল রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিকদের যেভাবে দেখছে, সেভাবে দেখছে না ফিলিস্তিনিদের। ইসরাইল পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে, ইসরাইলি আর ফিলিস্তিনি এক বা সমান নয়। ইসরাইল আরও পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে নিন্দা জ্ঞাপন না করলে তারা এই অসমতা ও বৈষম্যের কখনো পরিবর্তন করবে না।
এর দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বৈত নীতি ধারণ করছে। যেটা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, ইসরাইল শুধু তাদের জনগণ এবং তাদের রাষ্ট্রের সীমানা রক্ষা করতে চায়। যু্ক্তরাষ্ট্র এ কথা বলে মূলত ইসরাইলের সব অবৈধ তৎপরতাকে ন্যায্যতা দিচ্ছে। আবার অপরদিকে ফিলিস্তিনের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখছে।
ছোট্ট কিশোর মোহাম্মদ আবু খাদেইরকে নৃশংশভাবে হত্যা এবং হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের পর আবু খাদেইর-এর চাচাতো ভাই ১৫ বছরের তারিক আবু খাদেইরকে গ্রেপ্তার করে ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। গ্রেপ্তার করে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তাতে দেখা যায়, কী ভয়ঙ্করভাবে হিংস্রতার সঙ্গে তার সারা শরীরে আঘাত করা হয়।
তারিকের গ্রেপ্তার এবং তার ওপর নির্যাতনের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। যেটা অস্বাভাবিক সেটা হল, তার গ্রেপ্তারের পর একে একে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে চলছে।
তারিক একজন ফিলিস্তিনি ও আমেরিকান। গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে যেকোনো মুহূর্তে তাকে হত্যা করা হতে পারে। কোনো আইনজীবীর প্রবেশাধিকার কিংবা কোনোরকম চিকিৎসা দেয়ার অধিকার ছাড়াই একটি থানায় তাকে আটক করে রাখা হয়। তারেক দাবি করেছে, তাকে মার্কিন দূতাবাসের কোনো একজন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে দিতে হবে। তারেক জানিয়েছে, সে যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। এরপর অবশ্য চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ওই ভিডিওটির মাধ্যমে তারিক ইস্যু নিয়ে কীভাবে ‘মারাত্মক ডিস্টার্ব’ করা হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে ইসরাইল তা অবহিত করেছে। অবশেষে তারিককে কিছু অর্থের বিনিময়ে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। তবে মু্ক্তি পেলেও তারিক বর্তমানে গৃহবন্দি। এদিকে তারিকের মা ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ আইনে মামলা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
কিশোর তারিক ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ইসরাইলের প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এ বিষয়টি জানার পর তার প্রতি ইসরাইলের সব আচরণই নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়। এই হল আরেকটি অস্বাভাবিক ঘটনা। কারণ একজন ফিলিস্তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় মুহূর্তের মধ্যে সব অন্যরকম হয়ে গেল। কিন্তু এ ঘটনার মোকাবেলা অন্যভাবে হয়নি কেন? মূলত এ ঘটনাও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতিরই ফল।
দ্বৈতনীতি ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের দিক থেকেই ঘটছে। ইসরাইল যে মুহূর্তে বুঝতে পারল, কিশোর তারিক মার্কিন নাগরিক। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হল। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারল কিশোর তারিক তার দেশেরই নাগরিক। তখন তারা নিন্দা জানায় এবং কূটনৈতিকভাবে তার মুক্তি দাবি করে।
আমরা অনেকবারই আটক বহু শিশু কিশোরের ভিডিও দেখেছি। যাতে দেখা যায়, তাদেরকে অবর্ণনীয়ভাবে মারা হয়। ইসরাইলের নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে বহু শিশু কিশোরের নিহত হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলির চিত্রও দেখা যায় এসব ভিডিওতে। আসলে ফিলিস্তিনি শিশু কিশোরদের হত্যার এরকম অসংখ্য ভিডিও পাওয়া যায়। কিন্তু এতসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটির জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের তরফে কোনো প্রকার নিন্দা কিংবা ‘গভীর উদ্বেগ’মূলক কোনো বিবৃতি আসেনি।
ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনি শিশু কিশোরদের ধরে নিয়ে গেছে বহুবার এমন অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এতে কখনো ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ টু শব্দটিও করেনি। মনে হয় তারা শুনতেই পায়নি। তারা অনবরত তাদের গ্রেপ্তারি তৎপরতা এবং নির্যাতন নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। কোনোদিকেই তাদের কোনো কর্ণপাত নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানের ফলে বরাবরই ইসরাইলের এমন ভয়াবহ অবৈধ কর্মকাণ্ড বৈধ হয়ে যাচ্ছে!
এখন আবু খাদেইর-এর হত্যার ঘটনায় আটকদের মধ্যে কারা দায়ী হচ্ছে সেটা দেখার পালা। কিন্তু আমরা আশা করছি তাদের পুরাপুরি আইনের আওতায় আনা হবে।
ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার রক্ষা করা হবে এমনটাই আশা করা উচিত, যেখানে কোনো পক্ষে-বিপক্ষের কিছুই দেখা হবে না। কিন্তু বড় কথা হল, মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র সেই নিরপেক্ষতা দেখাতে পারবে না। ইতিমধ্যেই সে তা দেখাতে পারেনি কারণ, আটক তারিক যুক্তরাষ্ট্রের। সবমিলিয়ে একজন তারিককে নিয়ে যা করা হয়েছে, সেটা খুবই নিন্দনীয়, অবৈধ ছিল। অথচ গত কয়েক সপ্তাহে ইসরাইলি বাহিনী শত শত ফিলিস্তিনিকে আটক করে নিয়ে গেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেয়নি। নিন্দা তো দূরের কথা।
তারিকের ঘটনাকে পুরো ফিলিস্তিনের শান্তি প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া থেকেও আলাদা করে দেখা যাবে না। এ প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে দেখতে হবে। কারণ আটক তারিকের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রেরে দিক থেকে ফিলিস্তিন প্রশ্ন বুঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মোটকথা ফিলিস্তিন সম্পর্কে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বড় ধরনের পরিবর্তন আসা জরুরি। সেইসাথে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্য স্থায়ী সদস্যদেরও দিক থেকে এ পরিবর্তন আসতে হবে। যখন ইস্যুটিই হল ইসরাইল তখন অবশ্যই এ ডিম ছোঁড়াছুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। ইসরাইল যদি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে তবে অন্যান্য দেশের মতো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেরকে অবশ্যই নিন্দা জানানো উচিত।
এটা সত্য যে, ইসরাইল বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের আক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকি মোকাবেলা করে যাচ্ছে। এ ধরনের আক্রমণকে অবশ্যই কড়া ভাষায় নিন্দা করতে হবে। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, কোনো বিদ্রোহী সন্ত্রাসী গ্রুপের ফলে ফিলিস্তিনের সবাইকে এক করে দেখতে হবে।
ইসরাইল ক্রমাগতভাবে নিয়মিত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক যেসব চুক্তি হয়েছে সেসব চুক্তির বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ইসরাইল কোনো কাজই করছে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে এসব চুক্তি লঙ্ঘন করা হলে বলা হয়েছে, কড়া ভাষায় এর প্রতিবাদ জানাতে হবে। এবং ধাপে ধাপে অ্যাকশন নিতেও বলা হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রতিবাদ নিন্দা কিংবা কোনো অ্যাকশনই নিচ্ছে না।
টবি ক্যাডম্যান: লন্ডনের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং দি হেগের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল বুরোর সদস্য
লেখাটি ১৫ জুলাই আল জাজিরায় প্রকাশিত হয়েছে।
অনুবাদ: শাহাদাৎ তৈয়ব
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৪