ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

উটের পিঠের আরবেরা, ভাবলেশহীন পশ্চিমারা এবং গাজার জন্যে শোকগাঁথা

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৪
উটের পিঠের আরবেরা, ভাবলেশহীন পশ্চিমারা এবং গাজার জন্যে শোকগাঁথা

গাজা জ্বলছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গাজার প্রান্তর।

শিশুদের মুণ্ডুহীন লাশ আমি দেখি না, দেখতে চাই না। ফেসবুকে এরকম স্ট্যটাস দেখলে আমি ছবি নিমিষেই ডিলেট করে দেই। দুর্বল চিত্তকে আরও দুর্বল করে দেয় এসব ছবি। চরমভাবে বিপর্যয়-বিধ্বস্ত’ এই মানবতার কাছে নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয়।

বারো-তেরোদিনের রকেট হামলায় তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। যার মাঝে শিশু আর বয়সী মানুষই বেশী। হামলা চালাচ্ছে হাসপাতালে, উপাসনালয়ে। এ যুদ্ধ চলবে,  মৃত্যুর মিছিলে নাম লেখা হবে আরও শত শত শিশুর। এ মরনযজ্ঞ চলছে, মাতালের অট্টহাসি দিয়ে ইহুদী বেনজামিন নেতানিয়াহু চালাতে থাকবেই তার মানুষ নিধন। দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশী সময় ধরে চলছে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। গাজা কিংবা প্যলেস্টাইনের মুসলমানদের উপরই চলছে নির্যাতন। হামাস নামক সংগঠনটির ‘গোয়ার্তুমী’ বন্ধ করে দিতে ইজরাইলীরা চালাচ্ছে এই মানবতবিরোধী বর্বর হামলা।

দীর্ঘ ছয় দশকের ইতিহাস শুধুই বেদনার। গাজা কিংবা প্যালেস্টাইনের শিশুরা যেন জন্মই নেয় মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্যে। যে কোন সময় মিসাইল এসে এদের বিদ্ধ করবে। ঝরে যাবে এরা। এরই মধ্য দিয়ে এই শিশুগুলো বেড়ে উঠছে। গাজার শিশুরা এই কথিত সভ্য পৃথিবীতে যেন জন্মই নেয় অভিশপ্ত হয়ে। মৃত্যু কিংবা হত্যার লুকোচুরির মধ্য দিয়েই এরা বেড়ে উঠছে। এদের বেঁচে থাকা যেন দৈবক্রমে বাঁচা।  

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। ইরাক, লিবিয়া, হালের সিরিয়া সবখানেই যেন চলছে এক দানবীয় যুদ্ধ। নৃশংসতা যেন শুধু মুসলমানদের মাঝেই। পশ্চিমের দেশগুলো তা দেখে এখন শুধু বগল বাজায় আর উস্কে দেয়, সহযোগিতার নাম নিয়ে মিলিয়ন-ট্রিলিয়ন পাউন্ড-ডলারের বাণিজ্য করে। আর সেকারণে হয়ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামাও ইসরাঈল নিয়ে কিছু বলতে দ্বিধা করেন। বরং ইসরাইলের স্বাধীনতাকেই পাকাপোক্ত করে রাখতে বলতে গেলে নির্মমতার পক্ষেই কথা বলেন।

লন্ডনে হয়ে গেছে অসংখ্য মানুষের বিক্ষোভ। শুধু মুসলমান নয়, বহু ধর্মের ভিন্ন বর্ণের মানুষ মানবতার এ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। এ বিক্ষোভ ছড়িয়েছে বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরগুলোতে। কিন্তু ব্রিটেনের মূলধারার গণমাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভের খবর অনুপস্থিত। আমাদের ট্যাক্সে চলে যে বিবিসি, সেই বিবিসিতে নেই মানুষের ডেমোস্ট্রেশনের চিত্র। মানবতার পক্ষে কথা বলার জন্যে বিবিসি‘র নীরব ভূমিকা আমাদের আহত করে। এতে করে মূলত ইহুদি রাষ্ট্রটির জন্যে সরকারের একটা প্রত্যক্ষ সমর্থনই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে  কিন্তু এ নিয়ে কথা উঠেছে। গাজার হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে বিভিন্ন পার্লামেন্ট সদস্যরা ইসরাইলকে চাপ সৃষ্টি করতে ব্রিটেনের সরকারকেও চাপের মুখে রেখেছেন। এ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশী বংশদ্ভূত এমপি রোশনারা আলী। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অদ্ভূদ স্থিরতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। আমাদের জানিয়ে দেয় পশ্চিমের দেশগুলোর প্রতি তাদের নতজানু থাকার কথা। মুসলমানিত্ব‘র আবেগ আরব লীগ কিংবা মুসলিম দেশগুলো দিয়ে সুরক্ষিত হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক স্বার্থেই হোক, রাশিয়ার কথিত নাস্তিকরাই কথা বলছে ফিলিস্তিনের হয়ে। নাস্তিক বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস কথা বলছেন। কারণ মানবতাই এখানে প্রধান, আস্তিকতা কিংবা নাস্তিকতা নয়। অথচ মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলো পারছে না তাদের মানবতা কিংবা ধর্মীয় বোধ দিয়ে গাজার পক্ষে কথা বলতে। এ যেন বালুর প্রান্তরে আলখেল্লা পরিবেশিত শেখেরা বসে আছে আরবের উঠের পিঠেই।   

ইসরাইল একটা ইহুদী রাষ্ট্র। তারাও তাদের ধর্মীয় আবেগ নিয়ে এই রাষ্ট্রটি গঠন করেছে। এবং গাজায় যখন তারা রকেট হামলা চালাচ্ছে, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির প্রয়োজনে তারা তাদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকেই ব্যবহার করে গাজার মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। সুতরাং এ জায়গায় যদি মুসলমানরা তাদের নিজস্ব ধর্ম নিয়ে কথা বলে এর প্রতিবাদ করতেই চায়, তবে এদের দোষের কিছু থাকার কথা নয়। যদিও হামাসের কার্যকলাপ নিয়ে আরব গোত্র খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। তাতে কি?

প্যলেস্টাইনের অভ্যন্তরে এমনকি হামাস প্রশ্নবিদ্ধ হলেও প্রতিরোধ কিন্তু থেমে থাকবে না। মৃত্যুর অভিশাপ থেকে বাঁচার তাগিদে কেউ না কেউ সচেষ্ট হবেই। আর সেজন্যেই ইতিমধ্যে উগ্র দলের জন্ম হয়ে গেছে গাজায়, ওয়েস্ট ব্যাংকে তথা আগ্রাসনের শিকার প্যালেস্টাইনে। এবং এটা হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। একের পর এক শিশু আর নারী হত্যা করবে নির্বিচারে, বিশ্ব মোড়লরা চোখ তুলে চাইবে না, আবার মুসলিম উগ্রবাদ বলে নাক সিটকাবে সেটাতো হতে পারে না। সেজন্যেই গাজার মানুষ হয়ত লড়বে। এরা জানে এরা মরবে, কিন্তু বেঘোরে মৃত্যুর চেয়ে অন্তত বেঁচে থাকার জন্যে লড়াই করে মৃত্যুটাই হয়ত তারা শ্রেষ্ঠ মনে করছে। হামাসের ব্যানারে না লড়লেও এরা লড়বেই ভিন্ন নামে।

২) সারা পৃথিবীর মানবতাকামী মানুষ ইসরাইলের হামলার প্রতিবাদে মেতে উঠেছে। বিশ্ব মোড়ল ছাড়া সবাই-ই কথা বলছে। বাংলাদেশের সরকার দেরিতে হলেও গাজার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। বিএনপি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে অদ্ভূতভাবে নীরব এখন পর্যন্ত। মৌলবাদী দলগুলোর ভুমিকা আরও রহস্যজনক। এতে করেই বোঝা যায়, কি অদ্ভূত এক নতজানু নীতি আমাদের বঙ্গীয় দেশের রাজনীতিতেও। পশ্চিমা বাপ কিংবা দাদাদের চটাতে চায় না তারা। বিদেশ নির্ভর ক্ষমতার পালাবদলের জন্যে এরা উপরের নির্দেশেরই অপেক্ষায় আছে এখনও।

এই রমজান মাসে ব্রিটেনের মুসলমানরা ভিন্নভাবে নিয়েছে এই গাজার হত্যাযজ্ঞকে। আমি বিশ্বাস করি আজকের গাজায় সারা বিশ্বের মানবতাকামী মানুষের এগিয়ে আসা উচিৎ। নিহত-আহতদের পাশে যেতে প্রয়োজন আর্থিক সহযোগিতা। এই সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে ব্রিটেনের বাঙালিরা। ব্রিটেনের বাঙালি পাড়ায় এখন অর্থ সংগ্রহের ধুম পড়েছে। নামে-বেনামে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য চ্যারিটি সংগঠন। বিশেষত মুসলিম তরুণীদের চ্যারিটি নির্ভর কাজ আমাদের বিস্মিত করে তুলেছে।

একজন তরুণী তার প্রয়োজনে আমাদের অফিসের হল নিয়েছে। ভাড়া না দিয়েই। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে এই অর্থ পৌছে দেবে গাজায়। বলে, এটাতো চিন্তা করি নাই। পরের দিন এসে বললো সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকার একটা চ্যারিটি আছে, সেখানে দিয়ে দেয়া হবে। পরের দিন তিনি এলেনও, মাথায় ঘোমটা পরা। পাউন্ডগুলো নিয়ে চলে গেলেন। চ্যারিটি ইফতার হচ্ছে প্রতিদিন। এভাবেই আনাচে-কানাচে পাউন্ড সংগৃহিত হচ্ছে, ঘটা করে বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে অর্থ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কোন হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। গাজার জন্যে আমাদের ভালোবাসা, প্যালেস্টাইনের জন্যে আমাদের সহমর্মিতা অবশ্যই আছে, থাকবে। একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখছে যে জাতি, যে জাতি দীর্ঘ ষাট বছরেরও অধিক সময থেকে রক্ত আর লাশের উপর দিয়ে তাদের জীবন চালিয়ে যাচ্ছে, সে দেশটির জন্যে আমাদের ভালোবাসা থাকবেই। অসংখ্য শিশুর নিষ্পাপ-নিস্প্রাণ মুখের দিকে তাকালে শোকের কোন ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। একজন মানুষ হিসেবে এ শোকের সাথে একাত্ম হতেই হবে সকলের। আর সেজন্যেই গাজা যেন ব্যবসার ফাঁদ  না হয় সেদিকে খেয়াল রাখাটা আরও বেশী প্রয়োজন।

আজ সময় এসেছ ফ্রি প্যালেস্টাইনের জন্যে দুনিয়াজুড়ে জনমত তৈরির । এ জনমত দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু মুসলমানিত্বের নাম নিয়ে তা কি সম্ভব? ইজরাইলিরাও যে ইহুদি ধর্মের নাম নিযে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এবং ধর্মকে ব্যবহার করেই চালাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ। মুসলমানখ্যাত আরবরা যেন প্যালেস্টাইনের হয়ে মানবতার পক্ষেই কথা বলছে না, ধর্মতো দূরের কথা। ধর্মের কনসেপ্টটাকেও তারা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।

৩)  ইতিহাস যেন উল্টো পথে হাঁটে। হিটলার একসময় মনে করেছিলেন, এই ইহুদীদের ধ্বংস করে দিতে হবে। তার জাতীয়তাবোধ তাকে ইহুদী নিধনে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। মানবতাবাদী বিশ্ব তখন হিটলারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলো। বিশ্বের অগণিত সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদরা এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। হিটলার পারেন নি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভেসে থাকা কচুরিপানার মতো ইহুদীরা শেষপর্যন্ত ভিত গাড়ে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা মুসলমানদের আঙ্গিনায়।

তাদেরও জায়গা প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু সেজন্যে কি তাড়িয়ে দিতে হবে আরেকটি জাতিকে, কিংবা সেজন্যে কি ধ্বংস করে দিতে হবে প্যালেস্টাইনে জন্ম নেয়া সকল শিশুকে, কিংবা তাদের মা’দের? ইসরাইল কিংবা ইহুদীরা এখন হিটলারের চেয়েও হিংস্র, তাদের ইহুদীবাদ তাদেরই ধর্মের উত্তরাধিকার কালজয়ী কার্লমাক্সের ভাষাকে উতরে দিয়েছে। তাদের ধর্ম আফিমের নেশাকে ছাড়িয়ে গেছে। তাদের ধর্ম ইহুদিবাদ মানুষ হত্যার মতবাদে পর্যবসিত হয়েছে এখন।   

প্যালেস্টাইনের একটা রাজনৈতিক সমাধানে তাইতো চাপ রাখতে হবে মানবতাবাদী বিশ্বের। তা নাহলে হামাস কিংবা উগ্রবাদও রুখা যাবে না। রক্তের হুলিখেলাও বন্ধ হবে না। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাঝে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে শিশু, নারী তথা একটা জাতি, একটা রাষ্ট্র। প্রলম্বিত হবে উন্মাদনা সারা দুনিয়াজুড়ে। এটাতো এই সভ্যতায় মেনে নেয়া যায় না।

faruk.joshi@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।