ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

গাজা বর্বরতা: এই গণহত্যা মানবতার বিরুদ্ধে

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৪
গাজা বর্বরতা:  এই গণহত্যা মানবতার বিরুদ্ধে ছবি : সংগৃহীত

মুনীর চৌধুরীর সেই বিখ্যাত ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের পংক্তি- ‘মানুষকে খুন করে মানুষ। মানুষের রক্তে পিয়াস মেটায় মানুষ।

জানোয়ার চাটে জানোয়ারের রক্ত। ’

লেখকরা জ্যোতিষী নন, তবে শক্তিমান লেখকরা সমাজ, দেশ এবং মানুষের বাস্তব চিত্রকে এভাবে চিত্রিত করতে পারেন নিখুঁতভাবে। তাঁদের এমন কালজয়ী উক্তি না হয়েছে সেকালে মিথ্যা, না হয়েছে একালে। বিশ্বযুদ্ধ কিংবা জন্মভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনটিই আমার দেখা হয় নি। তবে স্বাধীনতা চাইতে গিয়ে কত নির্মমতার শিকার হতে হয়েছে, কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তা উপলব্ধি করতে পারি। স্বাধীনতার ইতিহাস আমাকে গর্বিত করে, এই ইতিহাস আমাকে দেশকে ভালোবাসতে শেখায়।

গণহত্যার  কষ্ট আমরা বুঝতে পারি। এখন বর্ষাকাল। চারপাশে যখন প্রবল বৃষ্টি হয় খুব অস্বস্তি লাগে। চারপাশে যখন বোমাবৃষ্টি পড়তে থাকে তখন কেমন লাগতে পারে একবার ভেবে দেখুন। প্রতি ১০ সেকেন্ড পর পর বোমা বর্ষণ করা হচ্ছে গাজা উপত্যকায়। ৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া গাজায় ইসরায়েলি হামলা চলছেই। গত শুক্রবারের পাঁচ ঘণ্টার যুদ্ধ বিরতিও শেষ হয়ে গেছে। ইসরায়েলের ভাষায় এটি ‘মানবিক যুদ্ধ বিরতি’। মিসরের  নেতৃত্বে যুদ্ধ বিরতির চেষ্টা করা হলেও যুদ্ধ বন্ধের কি কোন সুযোগ নেই? এই গণহত্যা কি চলতেই থাকবে? গত চৌদ্দ দিনে নিহতের সংখ্যা ৫০০ জন ছাড়িয়ে গেছে। আরো কত প্রাণ বলি হবে তাও বলা যায় না। আমি যখন এই লেখাটি শুরু করেছিলাম তখন নিহতের সংখ্যা ছিল ২২৭ জন। আমাকে প্রতিদিন সংখ্যা পরিবর্তন করতে হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছেন,  ‘ইসরায়েল বিশ্বসম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে। ’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন,  ‘যুদ্ধ বিরতির জন্য সব উপায় ব্যবহার করা হবে। ’
জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতা চলছে। এসব কিছুই ভাল দিক। তবে রক্তগঙ্গা কি বহমান থাকবে? একজন মানুষ ছোট দু’টি হাতে তার পরিবারের কয়জনকে দাফন করতে পারেন? কয়জনের জন্য কাঁদতে পারেন? এত শোক সইবার মত শক্তি কোথায় পাবেন ফিলিস্তিনিরা?

নিষ্পাপ শিশুদের চাহনি, মায়ের বুকফাটা আহাজারি, পিতার অসহায়ত্ব- এসব দেখেও কি কোন মানুষ স্থির থাকতে পারেন? মানুষ হয়ে মানুষের এই কষ্ট সহ্য করা বড় কষ্টের। আমাদের চিৎকার, প্রতিবাদ তাদের কানে পৌঁছুবে না। যাদের কিছু করার আছে তারা কতটা করছেন? কতটা ভাবছেন? বিল ক্লিনটনের মত উচু মাপের ব্যাক্তিরা একটা বিবৃতি দিলে সেটাও বড় কিছু মানছি। তবে মানবতার এমন দুর্দিনে লোক দেখানো ভূমিকা রাখা মূলকথা নয়। কাজের কাজ কি হচ্ছে, এই গণহত্যা বন্ধে পদক্ষেপ কি, জাতিসংঘ কি করতে পারছে, বিশ্ববাসীর ভূমিকা কি এখন এসব কথা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনেকে আহবান জানিয়েছেন ‘মুসলিম উম্মাহ এক হও’, ‘আরব বিশ্ব এক হও’ ইত্যাদি। কারণ এই যুদ্ধ চলছে মুসলমান এবং ইহুদির মধ্যে। অনেকে মনে করেন ফিলিস্তিন- ইসরায়েল এই সংঘাত নতুন কিছু নয়। শত বছরের এই মেরুকরণের মূল কারণ হয়তো ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়তো ভূ- সম্পদের মালিকানা ও দখল।

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে বিরোধের প্রধান একটি কারণ হল জেরুজালেম। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল জেরুজালেম দখল করে। তাহলে ইসরায়েল এখন নতুন করে কি করতে চায়?  গাজায় চলমান গণহত্যা কোন সম্প্রদায়ের উপর নয়, এই হামলা গোটা মানবতার উপর। তাই এই গণহত্যা বন্ধে সমগ্র মানব জাতিকে এক কাতারে আসতে হবে। বিশ্বসম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।  

ইসরায়েল গুরুত্ব দিক বা না দিক বিশ্ববাসীর চিৎকার, প্রতিবাদ এবং মানববন্ধন থামিয়ে রাখা যাবে না। বিশ্বের প্রতিটি দেশে দেশে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারলে ইসরায়েল বেশি দিন এই গণহত্যা চালাতে পারবে না। কিন্তু বিশ্ববাসী নীরব থাকলে ইসরায়েল ভাববে তারা যা করছে তা ঠিক করছে। হিটলারকে শুধু ইহুদিরাই ঘৃণা করেন তা  কিন্ত নয় বরং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের মানুষ মাত্রই তাকে অপছন্দ করেন। কারণ তিনি অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিয়েছিলেন। মূলত হিটলার একজন মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবেই পরিচিত।

হত্যাযজ্ঞ, খুনাখুনি, রক্তারক্তি কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে জাত, শ্রেণী, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ কোন কিছুই বিবেচ্য নয়। মিয়ানমার কিংবা গাজায় মুসলমান আগ্রাসনের শিকার হলে বিশ্বের মুসলমানরা প্রতিবাদী হবেন। বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ আক্রান্ত হলে ভারত কিংবা জাপানকে স্বোচ্চার হতে হবে এটা মানবিকতা নয়। বাংলাদেশে অমুসলিমদের উপস্থিতি তেমন একটা দেখতে পাচ্ছি না। সবার সাথে সংহতি প্রকাশ করতে সমস্যা কোথায়?  সম্প্রদায় বলতে যদি কোন কিছু থেকে থাকে তাহলে তার নাম বিশ্বসম্প্রদায় কিংবা মানবসম্প্রদায় ,যেখানে  ধর্মের খোলসের চাইতে মানুষ বড় কথা। মানুষের সম্পর্ক ধর্মের হয় না, মানুষের সম্পর্ক হয় মানবতার। জাত, ধর্ম পরিচয়ের ঊর্দ্ধে দাঁড়িয়ে হাতে হাত ধরে দাঁড়াতে পারলে আমাদের মানববন্ধনের সারি আরো দীর্ঘতর হবে। সম্মিলিত কন্ঠে ধ্বনিত হউক বারে বারে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। ’

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।