মিতু আর টুটুলের মাঝখানে ছিলাম আমি। মিতু মানে নাসিমা সুলাতানা এবং আহসানুল হাকিম টুটুল দু’জনই আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তারা ঝগড়া করে আমার বাসায় আসতো ভুনা-খিচুরি খেতে। আমার ছোট ভাই নোমান এক সময় খুব চমৎকার খিচুরি রান্না করতো। নজরুল ইসলাম বাবু, আনওয়ার আহমদ থেকে শুরু করে নাসিমা-টুটুলের মতো অনেকেই সেই খিচুরির ভক্ত ছিলেন।
মিতু টুলুলের চেয়ে বয়সে দু’ তিন বছরের বড় ছিলো। তাই, নাসিমা সাংসারিক কাজে একটু মাতাব্বরি বা মুরুব্বিগিরি করতো। তাই নিয়ে তাদের ‘গৃহযুদ্ধ’। তারা তখন থাকে বাংলা মোটরের একটি ফ্ল্যাটে। আমি গেলাম ‘কাজী’ হয়ে। কিন্তু মিতুর অভিযোগ- ‘তোমরা’ সব ছেলেরা একই রকমের। আর টুটুল বলতো- তোমরা তো কবি। এক সাথে বই বের করেছো।
আমি মজা করে বললাম, ‘তবু কেউ কারো নই’। এক পর্যায়ে নাসিমা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে আর টুটুলকে বাসা থেকে ‘তাড়িয়ে’ দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। তার আগেই ‘বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধসমগ্র’ বইটি টুটুলের কাছ থেকে ধার নিয়ে এলাম।
বইটি ফেরত দিতে দেরি হলো বলে আবার আমার সাথে নাসিমার ঝগড়া। নাসিমা বললো- ‘তুমি আমাদের ঝগড়ার সুযোগ নিয়ে বইটি ‘মেরে’ দিতে চাচ্ছো! টুটুল তাকে কিছুতেই থামাতে পারছিলো না।
এভাবেই নাসিমা আর টুটুলের মাঝে আমি ছিলাম এক অন্য রকমের বন্ধু। আমি আর নাসিমা মিলে একবার একটি যৌথ কবিতা লিখেছিলাম। সেই কবিতায় টুটুল ছিলো। নাসিমার মৃত্যুর পর ‘আরশি নগরে লালন-নাসিমা’ শীর্ষক কবিতাতেও টুটুলের নাম চলে এসেছে।
সেই টুটুলের সাথে 01715... এই ফোনে আর জীবনেও কথা হবে না, ফেইসবুকে যোগাযোগ হবে না, শাহবাগে গেলে আর কোনোদিন দেখা হবে না! কথা হবে না- বাংলাদেশের হৃদয় হতে, বিচিন্তা, শৈলী, অনন্যা, শিল্পপ্রভা, ঋত্বিক নিয়ে। এ মির্মম কথাগুলো ভাবতেই ভয়াবহ মৃত্যুর হিম শীতলতা আমাকে স্পর্শ করে।
টুটুল টা টা। মানে টুটুল চলে গেলো না ফেরার দেশে। রেখে গেলো কত স্মৃতি। শাহবাগের আজিজ মার্কেটে আমার স্বরব্যঞ্জন আর পাঠাশালার পাশে টুটুলের প্রকাশনা ‘ঋত্বিক’ ছিলো। ফলে সারাদিন ঘুরে ফিরে চলতো আমাদের চা আর আড্ডাবাজি।
আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, নাসিমার মৃত্যুর পর টুটুল একা আর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিলো। ভেতরে ছিলো এক হাহাকার, শূন্যতা! তার দুই বোন- এক বোন থাকেন মগবাজার। আরেকজন সুইডেনে। আমি ২০০৩ সালে স্টকহোমে গেলে তার বোনটি বড় বোনের মতো অনুরোধ করেছিলেন যেনো তার ভাইয়ের একটা বিয়ের ব্যবস্থা করি। টুটুলের সাথে দেশ-বিদেশের অনেক সুন্দরী এবং বিখ্যাতদের আন্তরিকতা ছিলো। কিন্তু নাসিমার বৃত্ত থেকে টুটুল আর বেরিয়ে এলেন না। নাসিমার স্মৃতি নিয়েই আঠারো বছর কাটিয়ে দিলেন।
নাসিমা সুলতানার মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমি থেকে সেলিনা হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তার জীবনী লেখার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। কাজটি সিংহভাগ শেষ করেও সমাপ্ত করতে পারিনি। কিন্তু টুটুল ঠিকই তার ‘ঋত্বিক’ থেকে ‘নাসিমা সুলতানা সমগ্র বের করেছেন। কথা ছিলো আমরা কুষ্টিয়ার আমলা পাড়ায় যাবো। নাসিমার পরিবারের সাথে কথা বলে তার শৈশব-কৈশোর জানবো, কবরের ছবি তুলেবো। কিন্তু তা আর হলো না। টুটুল নিজেই কবরে চলে গেলেন। সেখানে কি টুটুলের সাথে নাসিমার দেখা হবে?
বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৪