নগর, নগরায়ণের চরিত্র, আমাদের নগরমুখিতা, এর বিস্তার, পরিকল্পনা, নগর বিস্তারে বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই বিশেষ প্রবন্ধ
কিস্তি ১
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে বছরে গড়ে ৬ শতাংশ করে নগর জনসংখ্যা বেড়েছে। একইসময় জাতীয় পর্যায়ে জনসংখ্যার গড় ছিল দুই দশমিক দুই শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তানের নগরগুলোতে বছরে ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বেড়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। বড় শহরগুলোতে নগরায়নও অনেক বেড়েছে। চারটি বড় শহরে নগর জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাস করছে।
বাংলাদেশে নগরায়ণের গুরুত্বপূর্ণ চিত্র হল, বিভিন্ন নগর এলাকাগুলোতে বিভিন্ন হারে ক্রমাগত জনসংখ্যা বাড়ছে। জেলাশহর ও পৌরসভার এলাকাগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পরিমাণে নগর জনসংখ্যার বসবাস রয়েছে। ২০০১ সালের আদম শুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩৩২টি এমন নগর এলাকা ছিল যেখানে জনসংখ্যার সর্বনিম্ন হার হল ২৫ হাজার।
অনেক শহরের জনসংখ্যা পরিস্থিতি কমবেশি স্থিতিশীল। তবে ১৫টি জেলায় গত শতকের শেষ দশকে জনসংখ্যার হার বেশ কম ছিল (টেবিল-১)। সে কারণে নতুন নতুন স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। সেইসঙ্গে মধ্যবর্তী ছোট ছোট শহরগুলোর সম্প্রসারণ করারও সুযোগ রয়েছে। এমনকি বড় শহরগুলোর চারপাশে কিংবা বড় শহরগুলোতে বাড়তি নগরায়ণের চাপ কমিয়ে আনতে সম্ভাব্য অঞ্চলে নগর এলাকা গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।
দেশে ৯টি সিটি করপোরেশন এবং ৩০৯টি পৌরসভা রয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে পৌরসভা ও মিউনিসিপ্যালিটির সংজ্ঞা তৈরি হয়। যেমনটি টেবিল ২-এ দেখানো হয়েছে। এছাড়া ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোর অধীনেও কিছু নগর এলাকা (আরবান সেন্টার) রয়েছে।
নগর জনসংখ্যায় ৪০ শতাংশেরও বেশি পরিবর্তনে অবদান রেখেছে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন। শহরে বিদ্যমান কর্মের সুযোগই নগরে অভিবাসন গড়ে তোলার অন্যতম কারণ। দেশের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যকেন্দ্র ও বাণিজ্য কেন্দ্রিক সেবা ব্যাপকভাবে গড়ে উঠেছে বড় বড় শহরগুলোতে। বাংলাদেশের প্রধান উৎপাদন শিল্পের ধারা তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর শতকরা ৮০ ভাগই শুধু ঢাকায়। দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় প্রধান চারটি শহরে বাণিজ্যসেবার কর্তৃত্ব বিশেষ করে বিনিয়োগ, অর্থায়ন ও রিয়েল ইস্টেট সেবা গুরুত্বপূর্ণভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশে দুধরনের স্থানীয় নগর সরকার পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন রয়েছে। এই দুই প্রশাসনিক ব্যবস্থার কার্যক্রম মূলত একইরকম। তবে বাধ্যবাধকতামূলক এবং ঐচ্ছিক কার্যক্রমে কিছু ভিন্নতা আছে। স্থানীয় সরকারি দ্রব্যাদি (এলপিজি) ব্যাপকভাবে সরবরাহ করাসহ ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ, সড়ক-রাস্তাঘাঁটের তদারকি, রাস্তার লাইটের ব্যবস্থাপনা, পানি সরবরাহ ও ড্রেন ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করার দায়িত্ব পালন করে থাকে এসব প্রশাসন। সেইসাথে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণ গ্রন্থাগার, পার্ক ও গার্ডেনের তত্ত্বাবধানও করে থাকে স্থানীয় নগর প্রশাসন।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও স্থানীয় নগর কাঠামোগুলোর মারাত্মক বাধা হল তহবিল ঘাটতি। ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ, রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ও পার্ক-গার্ডেনের তত্ত্বাবধানে প্রধান বাধা হল এলপিজি’র কার্যক্রম। এছাড়া পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে বস্তির উন্নয়নে বাড়তি দায়িত্বও (এতে ঢাকার নিজস্ব কিংবা বিদেশি তহবিলের উপর নির্ভর করতে হয়)পালন করতে হয়।
বাংলাদেশর ছোট বড় স্থানীয় প্রশাসনিক কাঠামোগুলো (ইউএলবি) সরকারের শীর্ষ পর্যায় কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যেমন স্থানীয় প্রশাসনিক কাঠামোগুলোর আকার ও পরিধি এবং তাদের কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনের অধীন। নগর অর্থায়ন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ বিশেষভাবেই ক্ষতিকর। সাধারণত রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও মিউনিসিপ্যালিটি বা সিটি করপোরেশনগুলোর বার্ষিক অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারগুলোতে ছাড় দেয়া খুবই জরুরি।
স্থানীয় পর্যায়ে মূল পরিকল্পনাকারী ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হল পৌরসভা। পৌরসভা বিল ২০০৯ অনুযায়ী মাস্টার প্লান তৈরি, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণ গড়ার চর্চা স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলোকে দেয়া হয়। এ বিল অনুযায়ী একজন মেয়র ও একাধিক কাউন্সিলর (কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলরদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা নির্ধারণ করবে সরকার) নিয়ে পৌরসভা গঠিত হবে।
অনুমোদনের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পৌরসভার চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলররা নির্বাচিত হবে। পৌরসভা (মিউনিসিপ্যাল) এ্যাক্ট ২০০৯-এ পৌরসভাগুলোকে ব্যাপক দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে দেশে দ্রুত ক্রমবর্ধমান নগরায়নের সাথে যুক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পৌরসভার প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সক্ষমতাগুলো যথেষ্ট নয়।
২. বাংলাদেশে সরকারি ব্যয়ের ধরণ
বাংলাদেশে বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মত খাতগুলোতে দ্রুত সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছে। (২০০৫/০৬ থেকে ২০০৯/১০ অর্থবছরের চলমান বাজার মূল্য অনুযায়ী রাজস্ব ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি(এডিপি)ব্যয়সহ সরকারি মোট ব্যয় দেশের জিডিপির শতকরা ১৩.২৫ থেকে ১৫.০২ এর মধ্যে রয়েছে। )
৩. গ্রামীণ উন্নয়ন ও ইন্সটিটউশন (আরডিআই)
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরেই (এলজিইডি) গ্রামীণ উন্নয়ন ও ইন্সটিটি্উশনগুলোর (আরডিআই) এডিপি’র বরাদ্দ দেয়া হয়। দেশব্যাপী গ্রামীণ ও নগরের সড়ক-যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে (টেবিল ৪-এ যেমন এলজিইডি’র বাস্তবায়িত প্রকল্প কাজ দেখানো হয়েছে)নিয়োজিত রয়েছে এলজিইডি। আরডিআই ও এডিপির অন্যান্য গ্রাহক সংস্থাগুলো হল বাংলাদেশ রুরাল ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিআরডিবি), চিটাগাং হির ট্র্যাক্টস ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (সিএইচটিবিডি), লোকাল গভর্নমেন্ট ডিভিশন (এলজিডি), রুরাল ডেভেলপমেন্ট একাডেমি বগুড়া (আরডিএ বগুড়া)। যখন গ্রামীণ উন্নয়নই সার্বিক লক্ষ্য তখন গ্রাহক অধিদপ্তরগুলো কাজের লক্ষ্য ও এসাইনমেন্টের টার্মস ও কন্ডিশন নিয়ে মতিবিরোধ করে।
গেল দশকজুড়ে সরকারি বরাদ্দগুলোতে (পিইআর ২০০৩) পরিবহণ খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। পিইআর এর নথিপত্র অনুযায়ী এলজিইডি নিজেই ১৯৯৭-৯৮, ১৯৯৮-৯৯, ১৯৯৯-২০০০, ২০০০-০১ অর্থবছরে ০.৪৭, ০.৫২, ০.৬৪ এবং ০.৭৮ শতাংশ জিডিপি গ্রহণ করেছে। এলজিইডি কর্তৃক গৃহীত মোট অর্থতহবিলের ৯০ শতাংশই অবকাঠামো নির্মাণ, উন্নয়ন, পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। অবশিষ্ট অর্থ তত্ত্বাবধানের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় (পিইআর ২০০৩)। তার মানে বড় অংশই অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামত বা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ পায়। আর তত্ত্বাবধানের জন্য যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয় সেটা খুবই কম।
৩.১ এডিপির অর্থ বণ্টন
এডিপি’র রিপোর্ট অনুযায়ী অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর চেয়ে আরডিআই-এ অর্থ বন্টনের সম্প্রসারণ অনেক বেশি। টেবিল ৫-এ এডিপি’ তথ বিবরণীতে প্রকাশিত বার্ষিক অর্থ বন্টনের মাত্রা দেখানো হয়েছে। টেবিলটিতে দেখানো হয়, ১৯৯৫/৯৬ অর্থ বছরে অর্থ বন্টনের স্তর ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। পরে ২০০০/০১ অর্থ বছরে এটি প্রায় ৪৮ শতাংশে উন্নীত হয়। তবে ২০০৫/০৬ অর্থ বছরে তা ২৭ শতাংশে কমে আসে। জেলা অনুযায়ী গড় বণ্টন ছিল আরডিআই এডিপি বরাদ্দের (টেবিলি ৫ দ্রষ্টব্য) প্রায় ৩৫ শতাংশ।
(ইংরেজি থেকে অনূদিত)
লেখক : সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৪