জীবন আসলেই এক নাটকের মঞ্চ।
বেবী আপার (বেবী মওদুদ- খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সাবেক সাংসদ) মৃত্যু সংবাদ খন পাই তখন আমি আমার এক ঈদের নাটকের শুটিংয়ে।
সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই এপি’র বাংলাদেশ প্রধান সাংবাদিক জুলহাস আলম। মোবাইলের ব্রেকিং নিউজ দেখে তিনি জানালেন বেবী আপা আর নেই।
বেবী আপা অসুস্থ ছিলেন জানতাম। কিন্তু সেটা যে তাঁর চির বিদায়ের মঞ্চ প্রস্তুত করছে সেটা ভাবনায় ছিল না।
শুটিংয়ে বেশ মজা হচ্ছিল। খবরটা শোনার পর আর তাতে অংশ নিতে পারলাম না। শুটিং বাড়ির কোনার এক রুমে গিয়ে বসে থাকলাম।
অনেক স্মৃতি এসে ভীড় করলো। প্রায় এক যুগেরও আগের কথা।
বেবী আপাকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম। তার নাম জানতাম। তবে তিনি আমাকে চিনলেন ২০০২ সালের শুরুর দিকে। বেবী আপা তখন শেখ রেহানার মালিকানাধীন সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। বলা চলে অল ইন অল।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্র। এবং সদ্য বেকার। সঙ্গে আরেক বেকার বড় ভাই লেখক, সাংবাদিক আহসান কবির। আমরা বিভিন্ন জায়গায় লেখালেখি করি। কিন্তু তাতে করে হাতে টাকা-পয়সা তেমন আসে না। দুপুরে রুটি-কলা খাওয়া জীবন।
বিষয়টা জানতেন পরিচিত সবার বিপদের ‘উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা’ শিল্পী মাসুক হেলাল। মাসুক ভাই তখন বিচিত্রার প্রধান চিত্রশিল্পী।
মাসুক ভাই একদিন আমাদের দুজনকে ধরে নিয়ে গেলেন বিচিত্রা অফিসে। দাঁড় করালেন সরাসরি বেবী আপার সামনে।
বেবি আপার প্রতি একটা সমীহ আগে থেকে ছিল। শুনেছি কিছুটা মুডি। তারওপরে বিচারপতিকন্যা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ট বান্ধবী। সের এর ওপর অনেক সের।
তাঁর রুমে ঢুকে আমি বেশ নার্ভাস। কবির ভাইয়ের মধ্যে অবশ্য সেসব কিছু দেখলাম না। বেবী আপার বড় ছেলের সঙ্গে তার বেশ জানাশোনা। সে সুবাদে কবির ভাইকে বেবী আপা আগে থেকেই চিনতেন। আমি নবাগত। নাম বলার পর অবশ্য মাথা নাড়ালেন। সেটা কি চেনার নাড়ানো নাকি না চেনার তা বুঝতে পারিনি। তবে ধওে নিয়েছিলাম চিনেই মাথা নেড়েছেন। তখন লেখালেখি জীবনের প্রথম ধাপে ছিলাম। পত্রিকার পাতায় লেখা ছাপা হলে ভাবতাম দুনিয়ার সবাই আমার লেখা পড়ছে। আশপাশের কেউ তাকালে মনে হতো নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পেরেছে। এই তাকানোর অর্থ হচ্ছে পাঠ প্রতিক্রিয়া।
প্রথম দিন বেবী আপার সাথে কি কি কথা হয়েছিল এখন আর পরিষ্কার মনে নেই। তবে তারপর থেকে আবিষ্কার করলাম আমরা নিয়মিতভাবে বিচিত্রায় যাচ্ছি। লিখছি। সপ্তাহে অন্তত একদিন কখনো দু-তিনদিন বিচিত্রা অফিসে হাজির হতাম। এবং সেটা হিসেব করে ঠিক দুপুরের খাবার আগে আগে। উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা হিসেবে মাসুক ভাই আছেন। আমাদের দুপুরের খাবারের দায়িত্ব বাই ডিফল্ট তাঁর কাঁধে চলে যেত। আর সন্ধ্যার পরপরই পেস্টিং ডে উপলক্ষে বিচিত্রা থেকেই বেশ ভারি খাবার বরাদ্দ হত। আমাদের দিনটি দারুণভাবে পার হয়ে যেত।
এভাবে প্রায় দু বছরের মতো সময় বিচিত্রার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম আমরা। জড়িয়ে ছিলাম বেবী আপা এবং বিচিত্রার অন্যদের সঙ্গেও। খ্যাতিমান ফটো জার্নালিস্ট পাভেল ভাইকে (পাভেল রহমান) দেখতাম। পাভেল ভাইকে দেখিয়ে মাসুক ভাই বলতেন, চিনো? পাভেল রহমান। মানুষের পায়ের ছবি তুলেই আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিয়া আসছে। পুরা ছবি তোলা লাগে নাই।
সে সময়ই পরিচয় হয় সদ্য অবসরে যাওয়া ডাকসাইটে আমলা এবং বর্তমানে যমুনা টেলিভিশনের সিইও আবু আলম ভাইয়ের সাথে। পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব জাওয়াদুল করিম ভাইয়ের সাথে (বর্তমানে প্রয়াত)। জাওয়াদ ভাইয়ের সাথে আরেকজন কাজ করতেন লেখক, ছড়াকার আসলাম সানী। জাওয়াদ ভাই যেমন গুরুগম্ভীর সানি ভাই ঠিক তার উল্টো।
আহা বিচিত্রার সেই দিনগুলো। ছিলেন ফজলুর রহমান ওরফে রুদ্রাক্ষ রহমান, রঞ্জন সেনসহ আরও অনেকে।
একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা যে একটি পরিবারের মতো হতে পারে সে ধারণা আমি বিচিত্রা থেকেই পাই। সাপ্তাহিক বিচিত্রাই প্রথম পত্রিকা যার ঈদসংখ্যায় আমার মতো সেসময়ের একজন তরুণের লেখা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছিল। আর তা বেবী আপা না চাইলে সম্ভব হতো না।
বেবী আপার সঙ্গে আমার পরিচয় এবং যুক্ত থাকার সময়কাল খুব বড় না। তবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ক্যারিয়ারের সংকটকালীন সময়ে বেবি আপার দেয়া সুযোগ ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব কাজে লেগেছে ক্যারিয়ারের পরবর্তী পর্যায়ে।
বেবী আপা, আপনি নেই। এটাই এখন বাস্তবতা।
আরেকবার বুঝলাম, বাস্তবতা আসলেই কঠিন।
পলাশ মাহবুব : সাহিত্যিক ও নাট্যকার। প্রোগ্রাম ম্যানেজার- বৈশাখী টেলিভিশন।