দেশের আদিবাসী বীরদের মধ্যে ইউ কে চিং হলেন বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি তিন পার্বত্য জেলায় একমাত্র ‘বীর বিক্রম’ উপাধিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। আদিবাসী মারমা সম্প্রদায়ের এ বীরপুরুষ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন।
তার সম্পর্কে আমার একটি বই ‘মুক্তিযুদ্ধের আগুনমুখো গল্প’ গ্রন্থে লিখেছিলাম।
১৯৩৭ সালের ১৭ নভেম্বর বান্দরবান জেলার উজানী পাড়ায় তার জন্ম। তার পূর্বপুরুষরা আরকান রাজ্য থেকে এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। পার্বত্য অঞ্চলের গহীন অরণ্য পরিষ্কার করে যারা প্রথম মানববসতি গড়ে তোলেন, তাদের মধ্যে তারাও ছিলেন। তার পিতা বাই সো ছিলেন কাঠমিস্ত্রী। তিনি ২০০২ সালে মারা যান। আর মা নাগ সানু ছিলেন গৃহবধূ। ২০০৮ সালে তিনি মারা যান। ইউ কে চিং-এর বয়স যখন ১২, তখন তার বাবা-মার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। বিবাহ বিচ্ছেদের পর ইউ কে চিংসহ তার অন্য ভাই-বোনরা মায়ের সঙ্গেই থেকে যান এবং বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে যান। যদিও তাদের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো।
ইউ কে চিং ৬ বছর বয়সে বান্দরবান রাজবাড়ি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেই স্কুলে তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। মারমা তাদের মাতৃভাষা হলেও ব্যবস্থা না থাকায় পড়ালেখা করেছেন বাংলা ভাষায়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন আন্দোলন চলছে, ঠিক তখনই (১৯৫২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর) ইউ কে চিং যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এ। পরবর্তীকালে এ সংস্থাটি বিডিআর ও বর্তমানে বিজিবি নামে পরিচিত। ১৯৭২ সালের ১ এপ্রিল তাকে হাবিলদার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের ৭ এপ্রিল তিনি নায়েব সুবেদার হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৯৪ সালের ১৬ নভেম্বর অবসর গ্রহণের কথা থাকলেও ৪৪ বছর ৮ মাস ১৯ দিন বয়সে ১৯৮২ সালের ৬ আগস্ট তিনি চাকুরি থেকে অব্যাহতি নেন।
১৯৫৬ সালে ইপিআর হকি দলে যোগদানের মাধ্যমে তার খেলোয়াড় জীবন শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে তার ক্রীড়া নৈপুণ্যের জন্য দিনাজপুর সেক্টর ইপিআর আন্তঃসেক্টর ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। তিনি ছিলেন রংপুর সাব-সেক্টরের ১০ নম্বর উইং সদস্য। এ সময় তার কর্মকাণ্ড ছিলো প্রশংসনীয়। এজন্য তাকে ‘সিতারা-ই হার্ভ’ মেডেল দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ ইপিআরের নায়েক হিসেবে রংপুর জেলার হাতিবান্ধা বিওপিতে কর্মরত ছিলেন ইউ কে চিং। সেখান থেকে মেজর বাশারের নেতৃত্বে ৯ বাঙালি ইপিআর সৈনিক নিয়ে পাটগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন। তিনি কর্মরত বিহারি ও দুই পাঞ্জাবিকে হত্যা করেন। যুদ্ধ করেছেন মূলত উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুর জেলায়। অপারেশন চালান রংপুর, লালমনিরহাট, পাখিউড়া, কাউয়াহাট, বাগভাণ্ডার, হাতিবান্দা, চৌধুরীহাট, ভূরুঙ্গামারী, জয়মনিরহাট, রায়গঞ্জ, নাগেশ্বরী, তিস্তা নদী, কুলাঘাট প্রভৃতি স্থানে।
বাগভাণ্ডার বিওপি যুদ্ধে তার দুই ভাই পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। সবাই তাকে দু’দিনের ছুটিতে স্ত্রীকে দেখে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি, যুদ্ধ করেছেন। লালমনিরহাট কাউয়াহাট যুদ্ধে তিনি সেখানকার মানুষদের আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করেন।
সম্মুখ যুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর (শনিবার) প্রকাশিত ‘দি বাংলাদেশ গেজেট-এক্সট্রা অর্ডিনারি পাবলিশড বাই অথরিটি’ বইয়ের ক্রমিক নম্বর ১০০-তে তার ‘বীর বিক্রম’ প্রাপ্তির উল্লেখ আছে।
ইউকে চিং বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে ‘ইউ কে চিং বীর বিক্রম’ নামে একটি সড়কেরও নামকরণ করা হয় বান্দরবনে।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সাংগু নদীর তীর ঘেঁষে পাহাড়ের পাদদেশে লাংগী পাড়ায় পরিবার নিয়ে তিনি বাস করতেন। ২০১০ সালে বান্দরবান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের পক্ষ থেকে পার্বত্যাঞ্চলের একমাত্র বীর বিক্রম ইউ কে চিং এর বাড়িটি পুন:নির্মাণ করে দেওয়া হয়। বাড়ির পাশেই আরো ১০ হাজার টাকার মালামাল দিয়ে একটি ছোট্ট দোকান করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ সহায়তা পেয়ে বীর বিক্রম ইউ কে চিং জীবনের শেষবেলাতে চলেছেন কোনোরকমে। ছেলেমেয়েরা সাঙ্গু নদীর চরে অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে যা আয় করেন তা দিয়েই কোনোমতে জীবন চালাচ্ছেন। ২০১০ সালের ১৩ অক্টোবর তার হাতে দেড় লাখ টাকার চেক তুলে দেয় জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা ভাতা পেলেও এর বাইরে তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি তিনি।
ইউ কে চিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করে আমি মহাখুশী। একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। নতুন লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছি, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!’
গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এ মহান মুক্তিযোদ্ধার প্রতি।
হাবীব ইমন: শিক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী, কবি