দারিদ্র্য থেকে মুক্তি কিংবা আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নে ব্যবসা’র গুরুত্ব আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া কোন জাতি এবং দেশ উন্নয়নের চাকা সহজে ঘুরিয়ে দিতে পারে না।
ছোট, বড়, মাঝারি যে কোন ধরনের ব্যবসায়িক সেবা আমাদের প্রয়োজন। ব্যবসা কেবল অর্থ উপার্জনের অবলম্বন নয়, এটা সেবার মাধ্যমও বটে। নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যবসা করে একদিকে যেমন অর্থ উপার্জন করা যায়, অন্যদিকে মানুষের সেবাও করা যায়।
একজন ব্যবসায়ীর পণ্য কেবল একজন মাত্র ক্রেতা ভোগ করে না। তার বিক্রিত পণ্য অনেকজনে ভোগ করে থাকেন। ব্যবসায়ীর পণ্য নির্ভেজাল হলে ক্রেতারা উপকৃত হন এবং ভেজাল হলে ক্রেতারা ক্ষতির শিকার হন। ক্রেতারা টাকা দিয়ে পণ্য কিনতে গিয়ে বিভিন্নভাবে ঠকতে পারেন। ওজনে কম পাওয়া, বেশি দামে কেনা, ভেজাল পণ্য কেনা ইত্যাদি। ব্যবসায়ী সৎ হলে ক্রেতারা এসব ক্ষতি থেকে বেঁচে যান। বেচা-বিক্রিতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো স্বভাবতই কম নজরদারিতে থাকে। ভেজালকরণের মাত্রা অসহনীয় মাত্রায় উঠে এলে তখন সবার টনক নড়ে। দাবি ওঠে, প্রতিবাদ হয়, প্রশাসন অ্যাকশনে নামে, এদিক ওদিক দু’চারটি ঝটিকা অভিযান চালায়। কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে, কোনটা সিলগালা করে দেয় কিংবা কোন কোন ব্যবসায়ীর পণ্য নষ্ট করে দেয়। তারপর প্রশাসন চোখ ফিরিয়ে নেয়, হাত গুটিয়ে নেয়। সবকিছু আগের নিয়মে চলতে থাকে। উপশমের ব্যবস্থা আছে কিন্তু প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। এটাই সব সমস্যার অন্যতম সমস্যা।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল ফরমালিন। হাট বাজার থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ ভবন পর্যন্ত ফরমালিন নিয়ে আলোচনা হয়।
ফরমালিন এর আভিধানিক অর্থ হল জীবানুনাশক রূপে ব্যবহৃত ফর্ম্যালডিহাইডের দ্রবণ। ফর্ম্যালডিহাইড হল এক ধরনের বর্ণহীন গ্যাস বিশেষ, যা জলে দ্রবীভূত করে রক্ষনোপাদান ও জীবানুনাশক রূপে ব্যবহৃত হয়। মাছ, সবজি, বিভিন্ন প্রকারের ফলমূলকে আকর্ষণীয় এবং দীর্ঘ দিন টিকিয়ে রাখার জন্য এখন মাত্রার চেয়েও অতিরিক্ত ফরমালিন ব্যবহার করে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে।
চিকিৎসকদের মতে, ফরমালিন অত্যন্ত বিষাক্ত বলে নিয়মিত ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার হওয়ার আশংকা থাকে। এছাড়া ফরমালিন খাদ্য পরিপাকে বাধা দেয়, পাকস্থলির ক্ষতি করে, লিভারের এনজাইমগুলোকে নষ্ট করে এবং কিডনির কোষ নেফ্রনগুলোকে ধ্বংস করে। ফলে গ্যাস্ট্রিক, আলসার বাড়ে, লিভার ও কিডনির নানা রকম জটিল ও দূরারোগ্য রোগ দেখা দেয়। গর্ভবতী মায়েরা যদি ফরমালিনযুক্ত খাবার খান তাহলে সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়ার আশংকা থাকে। এছাড়া ত্বকের রোগ ও চোখের সমস্যাও হতে পারে। টাকা খরচ করে খাবার খেয়ে মৃত্যুকে আহবান করা খুবই দুঃখজনক।
আমরা খাওয়ার জন্য বেচেঁ থাকি না, বাচাঁর জন্য খাই। খাবারের নিরাপত্তাটুকুও যদি না পাই তাহলে কিভাবে বাঁচি! দশম জাতীয় সংসদের প্রথম বাজেট অধিবেশনে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, গত চার বছরে ৩৮ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১১ লাখ কেজি ফরমালিন আমদানি করেছে। তিনি প্রশ্নোত্তরে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনের কথা বললেও আমদানিকৃত ফরমালিনগুলোর ব্যবহার সর্ম্পকে কিছুই বলেন নি। ট্যানারি ও মেডিকেল, খেলনা, বিজ্ঞান গবেষণাগার, আসবাবশিল্প প্রভৃতি খাতে ব্যবহারের জন্য মোট ফরমালিন এর চাহিদা ১০০ টন, অথচ আমাদের দেশে মোট ফরমালিন আমদানি করা হয় ৫০০ টন। বাকি ৪০০ টন ফরমালিন কেন আমদানি করা হয়? সরকারের উচিত এটা তলিয়ে দেখা। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন করা মানে ফরমালিন আমদানি এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে না। কারণ দেশে কোন কোন ক্ষেত্রে ফরমালিন এর ব্যবহার আছে। সরকারের প্রণীত ফরমালিন নিয়ন্ত্রক বিষয়ক আইন সর্ম্পকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ ও জাতীয় ভোক্তা সমিতি ফরমালিনে কটু গন্ধ যোগ করার প্রস্থাব দিয়েছেন। প্রশাসন বলেছেন, খাবারে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে হত্যা চেষ্টা মামলা করা হবে। দোষী সাব্যস্ত হলে জেল জরিমানা দুটোই হবে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন জায়গায় ফরমালিন বিরোধী অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। এত কিছুর পরেও ফরমালিনমুক্ত খাবার নিশ্চিত করা যাবে কিনা তা নিযে যতেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। দুধেও ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। অনেক ওষুধের দোকানে ফরমালিন বিক্রির অভিযোগ ওঠেছে। এখন পরিত্রাণের উপায় কি? ক্রেতাদের ফরমালিন বিষয়ে সতর্ক হতে বার বার বলা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ ক্রেতার তা সহজে বুঝার কথা নয়। ফরমালিন মুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে জনগণের সচেতনতা, প্রশাসনিক তৎপরতা যেমন দরকার, তেমনি ব্যবসায়ী ও আড়তদারদেরও নৈতিকতা বোধ সম্পন্ন হতে হবে। বৌদ্ধ ধর্মে পঞ্চ বাণিজ্য নিষিদ্ধ। অস্ত্র, প্রাণী, মাংস, মাদক ও বিষ বাণিজ্য ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ।
এই পঞ্চ বাণিজ্য করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে দান করলে দানের ফল পূণ্য না হওয়ার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। পাপ তো আছেই। ফরমালিনও এক প্রকার বিষ। তাই ধর্মীয়ভাবেও এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম ধর্মমতেও এই উপায়ে উপার্জিত অর্থকে হালাল বলা হয় নি। মানুষ হয়ে মানুষকে ঠকিয়ে, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে অর্জিত মুনাফা কখনো সুফল বয়ে আনবে না। কোন না কোনভাবে এর মাশুল দিতে হয় এই নীতি চিন্তা ব্যবসায়ীদের ভুলে গেলে চলবে না।
একইভাবে ফরমালিনের অযুহাতে পরিচালিত অভিযানে কোন ব্যবসায়ী বিনা দোষে শাস্তির শিকার হচ্ছেন কিনা, পথে বসছেন কিনা সেটাও গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্টরা পদক্ষেপ নেবেন এটাই কাম্য।
ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সঠিক পদ্ধতি ও যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করা হচ্ছে না। তাদের মতে ‘যে ফরমালডিহাইড ৩০০ যন্ত্র দিয়ে ফলমূলের ফরমালিন পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেটি আসলে ফলমূলের ফরমালিন পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্র নয়। এ যন্ত্র বাতাসে গ্যাসের বাষ্প পরীক্ষার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। এ যন্ত্র দিয়ে ফলের ফরমালিন শনাক্ত করে দেশি বিদেশি প্রচুর ফলমূল ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে করে ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। ’ তাদের এই অভিযোগটি আমলে নেয়া হউক। প্রশাসনের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও ফরমালিন দূরীকরণে উদ্যোগী হলে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ কিংবা ফরমালিনমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। পত্রপত্রিকার মাধমে জানতে পারি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ব্যবসায়ীরা ফরমালিনমুক্ত ফল বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। অনেকে দেশজুড়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক হিমাগার এবং হিমাগারযুক্ত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেছেন। এটা ব্যয় সাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও এই পথে এগোতে পারলে একটি স্থায়ী সমাধান চলে আসত।
উদ্বেগের বিষয় হল, খাদ্যকে বিষাক্ত করার ক্ষেত্রে ফরমালিন একমাত্র পদার্থ নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এরকম আরো বহু পদার্থ আছে যা ফরমালিন বা এর চেয়েও বেশি ক্ষতিকারক। ইতিমধ্যে এসব পদার্থের নামও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে সমান গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। ফরমালিনের ব্যবহার মৌসুম ভিত্তিক হয় না। তাই ফরমালিনের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানও সেই রকম হওয়া উচিত। তবে প্রশাসনের প্রশংসনীয় এই অভিযানকে হতে হবে স্বচ্ছ ও প্রশ্নাতীত। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সহযোগিতা প্রশাসনকে পথ দেখাবে সন্দেহ নেই।
একটা খবর জেনে খুবই দুঃখ পেয়েছি। রামুতে ভ্রাম্যমাণ আদালত ফরমালিন মেশানোর দায়ে এক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছেন। দুই জন সংবাদকর্মী অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খোদ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে টাকা চেয়ে নিলেন। কাজটা কি ঠিক হল?
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৪