ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কিস্তি ২

বাংলাদেশে সরকারি অর্থায়ন ও নগর উন্নয়ন ।। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪১ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪
বাংলাদেশে সরকারি অর্থায়ন ও নগর উন্নয়ন ।। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

আগের কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন

স্থানীয় সরকারের অর্থায়ন
সরকারি কার্যক্রমের বৃহত্তর বিকেন্দ্রীকরণ প্রাসঙ্গিক বার্ষিক অর্থ বাজেটের বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে যুক্ত থাকা জরুরি। সেইসঙ্গে নিজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গেও এই বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি যুক্ত থাকা দরকার।

বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম জরুরি নির্দেশিকা হল, অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে ব্যবহারিক শক্তিতে রূপান্তর করা। স্থানীয় শক্তি কাঠামোগুলো স্বাধীনভাবে কতখানি রাজস্ব তুলতে পারে এবং ব্যয়ের খাতগুলো বরাদ্দ হতে পারে তার সম্প্রসারণের ওপরই নির্ভর করে স্বায়ত্বশাসনের সম্প্রসারণ। টেবিল ৬-এ দক্ষিণ এশিয়ার স্থানীয় সরকারের রাজস্বের বিভিন্ন উৎস দেখানো হয়েছে। অর্থ বাজেটের দিক থেকে বাংলাদেশ একটি অতিশয় কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র। স্থানীয় সরকারের ব্যয়ের দিক থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্থানীয় প্রশাসনগুলো যে পরিমাণ জিডিপি অর্জন করছে এখন পর্যন্ত তা ৩ শতাংশও অতিক্রম করেনি। স্থানীয় সরকারগুলোর যে বিভিন্ন স্তর রয়েছে তাতে অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর বিস্তার খুবই সীমিত।        

যদিও বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের আকার এবং সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোগুলোতে এর ব্যয় প্রবাহ ক্রমাগত বাড়ছে। তবে মূলত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পদের মোট বরাদ্দ বেড়েছে আশির দশকের শুরু থেকে। অপরদিকে সরকারি ব্যয়ের ঊর্ধ্বমুখিতা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসনে সবসময়ই আর্থিক সংকট থাকে। স্থানীয় সরকারের আয় আসে সাধারণত কর, ফি, খাজনা ও বিভিন্ন ধরনের চার্জ থেকে। এছাড়া স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সম্পদের ভাড়া, সেবা ও মুনাফা থেকে আয় সঞ্চিত হয়। নানান ব্যক্তি বিশেষ, প্রতিষ্ঠান ও সরকারি মঞ্জুরি প্রকল্প থেকেও আয় সংগ্রহ করা হয়। একইসঙ্গে বিনিয়োগ প্রকল্প, সংস্থা-সমিতি থেকেও আয় আসে। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের মাধ্যমেও আয় সঞ্চয় করা হয়। এধরনের খাতগুলো সরকারি আয়ের ভিন্নরকম উৎস হলেও কোনো স্থানীয় প্রশাসনের অনুপস্থিতি ঘটলে সেখানে এ উৎসগুলোকে যুক্ত করা হয়। স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নিজস্ব আয়ের খাত ট্যাক্স সংগ্রহ। যদিও ঋণ ও স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম থেকে আয় সংগ্রহের ব্যাপারটি খুবই দুর্লভ ব্যাপার।

করবিহীন রাজস্ব দুরকমভাবে আসে। একটা হল ফি কিংবা টোল আদায়। অপরটি হল, স্থানীয় সরকারের নিজস্ব সম্পদের ভাড়া ও লাভ। স্থানীয় নগর প্রশাসনগুলো গড়ে উঠেছে মূলত তাদের নিজস্ব উৎস থেকে আসা ৫৫ থেকে ৭৫ শতাংশ রাজস্বের উপর ভিত্তি করে। এগুলো হল সরকারের মঞ্জুরি তহবিল থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বর্তমানে একটি সিটি করপোরেশেনের বাজেটের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রাখে আন্তর্জাতিক প্রকল্পের অর্থায়ন। সরকারি তহবিল, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নসহ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে সিটি ও পৌরসভার মূল বিনিয়োগের চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগের জন্য গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশ মিউনিসিপাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিএমডিএফ)।    

পৌরসভা বা স্থানীয় প্রশাসনগুলোর কর ব্যবস্থাপনা দুর্বল মানের। কর সংগ্রহের পরিমাণও খুবই নগণ্য। এ অবস্থার জন্য অনেক কারণই দায়ী। তবে দুর্বল মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি এবং আইনি জটিলতা এর অন্যতম কারণ। (উল্লেখ্য যে, সম্পত্তি নিয়ে রিভিউ’র ৫০ শতাংশেরও বেশি মামলা এখনও আদালতে আটকে আছে। এসব রিভিউ মামলার প্রক্রিয়া শেষ করতেও সময়ের দরকার। আবার সাধারণত দেখা যায় যে, এধরনের মামলার রায় পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধেই যায়। )

অপরদিকে খুবই নগন্য পরিমাণে কর আদায়ের বড় কারণ হল মূলত দুর্নীতি। পৌরসভা বা স্থানীয় সরকারের ব্যয় প্রধানত ঘটে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কাজের ফলে। পৌরসভার সার্বিক ব্যয়ের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই ব্যয় হয় এ ধরনের নির্মাণের কাজে। জনস্বাস্থ্যের পেছনে ১৫ থেকে ২০ ভাগ ব্যয় হয়। পাশাপাশি গড়ে ৭ থেকে ১৬ শতাংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক কাজে। সামাজিক খাতে ব্যয় নেই বললেই চলে। (চৌধুরী ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৪২)।

বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের অর্থায়ন বিষয়ে পরীক্ষিত বা মান সম্পন্ন তথ্য পাওয়া বেশ দুষ্করই বটে। যা আছে তা খুবই অপর্যাপ্ত। দেশের পৌরসভাগুলো সাধারণ ব্লক মঞ্জুরির মাধ্যমে আসা প্রকল্পের নির্ধারিত তহবিলের উপর নির্ভর করে। ২০০৬/০৭ অর্থ বছরে ইউনিয়ন পরিষদের তুলনায় পৌরসভার মাথাপিছু মোট রাজস্ব অনেক বেশি অর্জিত হয়েছিল। ২০০৮ সালে অ্যান্ড্রু ইয়াং স্কুল অব জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি ৩০টি পৌরসভার ওপর এক জরিপ চালিয়ে জানায়, ২০০৬ অর্থবছরে তাদের মাথাপিছু আয় হয় ১২২০ টাকা যার ৪০৫ টাকা এসেছে নিজস্ব উৎস থেকে। পরের বছর মাথাপিছু আয় ছিল ১৯৩০ টাকা যার ৫৮০ টাকা আসে নিজস্ব উৎস থেকে। কিন্তু পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে দেশটির এসব পৌরসভার ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত আয় বেড়ে যায়।

                                                                              পৌরসভার রাজস্ব

সূত্র: Fox and Menon, 2008, p.16. Survey of 30 Pourashavas

পৌরসভার ব্যয়ের দিক থেকে ২০০৬/০৭ থেকে ২০০৭/০৮ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬০ শতাংশ। যদিও ২০০৭/০৮ সালে এ ব্যয়ের পরিমাণ কিছুটা নেমে যায়।   

সিটি করপোরেশনের আয়-ব্যয়
স্থানীয় সরকারের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সিটি কর্পোরেশনের আয়ের পরিমাণ অধিক হলেও ধরে নেয়া হয়েছে যে, আয়ের মাত্র এক তৃতীয়াংশ আসবে নিজস্ব উৎস থেকে। যাতে রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতিও অভিন্ন। তবে সিটি করপোরেশনগুলোর আয়ের প্রধান অংশ আসে দাতা-সহায়ক প্রকল্প থেকে। এর পরই আসে  মঞ্জুরি এবং সরকারি প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে। ২০০৬/০৭ এবং ২০০৭/০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। তবে মজার বিষয় হল, প্রাক্বলিত মোট রাজস্ব আয়ে কিছুটা ঘাটতিও দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অনুমান হল, নিজস্ব উৎস থেকে আসা রাজস্ব আয়ের স্তর সিটি করপোরেশনগুলোর সম্ভাব্য উন্নয়নের কোনো প্রতিফলন ঘটায় না।

                                                                               টেবিল ৯
                                                                 সিটি করপোরেশনগুলোর রাজস্ব আয়

      (‘000 Tk.)
      সূত্র: Fox and Menon (2008). Survey of 6 City Corporations (CCs)

প্রতি বছর সিটি করপোরেশনগুলোর কমপক্ষে ৭৩২ শতাংশ ব্যয় করা হয় উন্নয়ন খাতে। এই উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশ আসে দাতা সংস্থার হাত ধরে, এরপরই রয়েছে সরকারি অর্থ। তবে উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় এক চতুর্থাংশ ব্যয় করা হয় নিজস্ব উৎস থেকে। এছাড়া মজুরিবিহীন ব্যয়ই হল চলমান ব্যয়ের বড় অংশ।
(ইংরেজি থেকে অনূদিত)








লেখক : সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক


বাংলাদেশ সময় : ১৪৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।