মিলার বান্ধবী সুমির কাঁঠাল খুব পছন্দ। কিন্তু গাছের কাঁঠাল পাকার সময়তো এখনো হয়নি।
আমাদের দেশের রাজনীতিতেও অনভিজ্ঞ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাহীন, অপরিপক্ক ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলে এমন তরমুজের দশাই হয়। আমেরিকাতে হিলারিরা দায়িত্ব পেলে আরো অভিজ্ঞ হয়, আরো পরিপক্ক হয়। আর আমাদের অপরিপক্ক হিলারিরা দায়িত্ব পেলে যে সুমির তরমুজের মত হয় সেটা আমরা দেখেছি। এইতো কিছুদিন আগেও ড: হাছান মাহমুদের মত নেতারা মাঠে ময়দানে বিএনপি’র কাছে বর্তমান সরকারের বৈধতা চেয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছিলেন। আমরা সাধারণ মানুষরা যতটুকু জানি কোনো সরকারের বৈধতা আসে সাংবিধানিক অবকাঠামোর মধ্যে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জয়ী দলের সরকার গঠনের মাধ্যমে।
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন থাকতে পারে। হাছান মাহমুদরা নির্বাচন বয়কট করা দলগুলিকে আহবান করতে পারেন তাদের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু দু’একজন সাবেক মন্ত্রী মাঠে ময়দানে বিএনপিকে ধমকাচ্ছিলেন, আগে এই সরকারের বৈধতা দিন তারপর আলোচনা। তাহলে কি বিএনপি বৈধতা না দেওয়া পর্যন্ত তার সরকার অবৈধ? তার দলের নেত্রী, দেশের প্রধানমন্ত্রী সংবিধান রক্ষার আইনি বাধ্য বাধকতার জন্য প্রধান বিরোধী দল ব্যতিরেকেই একটা নির্বাচন করে সরকার গঠন করেছেন দেশকে সাংবিধানিক সংকটমুক্ত রাখতে; সেখানে সরকারের একজন মন্ত্রী হয়ে তিনি যখন কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে সরকারের বৈধতার সার্টিফিকেট চেয়ে বেড়ান তখন প্রকারান্তরে তিনিই তার সরকারকে প্রশ্নœবিদ্ধ করে তোলেন। এটা তার দল ও দলের নেত্রীর নীতি কৌশলের পরিপন্থি।
খেলার মাঠে একটা কৌশল খুব প্রচলিত; তা হলো বিপক্ষের খেলোয়ারদের উত্যক্ত করে তোলা। যাতে সে উত্তেজিত হয় । কারণ উত্তেজিত হলে তার স্বাভাবিক খেলা বিঘিœত হয়। জানি না বর্তমান আধুনিক রাজনীতিতে এই কৌশল অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা বা হাছান মাহমুদরা বিরোধী দলকে উত্তেজিত করার কাজে দায়িত্ব প্রাপ্ত কিনা। কারণ, উনাদের অতি বাচালতা গণমাধ্যমগুলিতে গুরুত্ব সহকারে প্রচার হচ্ছে এবং দলের নীতি নির্ধারকরাও তা দেখছেন । এতে তিনি মন্ত্রিত্ব ফিরে পাবেন কিনা জানি না তবে তার দলের নেতৃত্বের দৈন্য যে প্রকাশ পাচ্ছে তা হলফ করে বলা যায়। অতি সম্প্রতি তার ইহুদিদের সাথে বিএনপির যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মন্তব্য তাকে আরো উচ্চ মাত্রায় নিয়ে গেছে। উনার পান্ডিত্যের প্রলাপ এখন গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ দেশের সাধারণ মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। একজন রাজনীতিকের দায়িত্বজ্ঞান সাধারণ মানুষের উপর অনেক বেশি প্রভাব রাখে। একজন রাজনীতিককে হাজার হাজার মানুষ সম্মান করে, তার আদেশ মানে, তাকে অনুসরণ করে এবং ভোটের মাধ্যমে তাকে তাদের নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। রাজনীতিকরাই পারেন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নিতে। একজন নেতা, একজন মানুষ বদলে দিতে পারে একটা জাতির ভাগ্য। আমরা দেখেছি মাত্র একজন মানুষের তর্জনী উত্তোলনে এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ একদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের মাতৃভুমি রক্ষায়।
বর্তমানে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন তো দূরের কথা, দেশের প্রতিটা দলের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তে দুটি পরিবারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কারণ, আমাদের রাজনীতি এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অরাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা। পেশাজীবী কিংবা ব্যবসায়ীরা অতি দ্রুত নেতা হওয়ার জন্য অতি বাচালতা বা স্তাবকতার মাধ্যমে নেত্রীর সুনজর পাওয়ার আশায় সর্বদা সচেষ্ট। অতটা স্তাবকতা হয়তো থাকত না যদি রাজনীতি থাকত রাজনীতিবিদদের হাতে। কেননা একজন ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানের একটা আত্ম অহং থাকে যা তাকে নৈতিক এবং চারিত্রিক বিচ্যুতি থেকে বিরত রাখে।
মূলত ৭৫ পরবর্তী সময় থেকেই রাজনীতি চলে যায় অ-রাজনীতিকদের হাতে এবং শুরু হয় রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে দেয়ার প্রক্রিয়া। অনুপ্রবেশ ঘটে বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের। ৯০-এ জেনারেল এরশাদের পতনের মাধ্যমে এদেশে একটা গণতান্ত্রিক ধারার সুচনা হয়েছিল। অন্তত গত ২৪ বছর ধরে একটা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু এখনো দেশের রাজনীতিতে পুন:প্রতিষ্ঠা হয়নি রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণ। বরং বন্ধ হয়ে গেছে দেশে রাজনৈতিক চর্চা । রাজনীতি হচ্ছে এমন একটা প্রক্রিয়া যার মাধমে নেতৃত্ব তৈরি হয়। সেই নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়াটাই আজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দেশের ছাত্র সংসদগুলির নির্বাচন। কোথাও আদর্শগত রাজনৈতিক চর্চা হচ্ছে না। জনগণের নেতা নিয়োগ হচ্ছে দলীয় প্রধানের কাছ থেকে। ফলে, এসব নিয়োগপ্রাপ্ত নেতারাও গণযোগাযোগের পরিবর্তে সর্বদা ব্যস্ত ল্যাজ নেড়ে তার নিয়োগকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে। এসব অ-রাজনীতিকরাই তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে রাজনীতির মূল ধারায় উত্থান ঘটিয়েছেন ধর্মীয় সংগঠনগুলোর ।
রাজনীতি কোনো পেশা নয়; কিংবা তা হতে পারে না ব্যবসা রক্ষার হাতিয়ার। রাজনীতির ভিত্তি হওয়া উচিৎ আদর্শ, নীতিবোধ ও জনগণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চা শুরু করা যায়। তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব তৈরির একটা প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরি করা যায় তাহলে অবশ্যই আমাদের রাজনীতি তার হারানো সম্মান ফিরে পাবে। প্রতিটা রাজনৈতিক দলই একটা মজবুত গণভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারবে। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি; কারণ তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের ছিল একটা আদর্শগত গণভিত্তি। এর ফলে একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও দাপটের সাথে ফিরে আসতে পেরেছে ক্ষমতায়। শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি ও সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততার কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ভিতরে ও বাইরে দুই জায়গা থেকেই সমানভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে এদেশের রাজনীতি। তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা ২১ বছর যে ত্যাগ স্বীকার করে দলীয় ঝান্ডা ধরে রেখেছে তা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র দলীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্যের কারণে; কোনো বিদেশি প্রভুর আশির্বাদে নয় । তৃণমূলে প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক চর্চা শুরু করা গেলে স্থানীয় মাস্তানদের পরিবর্তে পরীক্ষিত নেতাদের উঠে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
দেশ আজ যে নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে তা লাঘবের একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। তাতে দল লাভবান হবে, দেশ লাভবান হবে ।
একটা সুস্থ রাজনীতির ধারার সুচনা হলে আমাদের ভাবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো একটা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে পারবে। ইতিহাস বলে বাঙালি জাতি নির্ভীক বীরের জাতি। এদেশের মানুষের রয়েছে অনেক সংগ্রামী ইতিহাস । আমাদের সংগ্রামী ইতিহাস ব্রিটিশবিরোধী অসংখ্য আন্দোলন ছাড়াও রয়েছে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রচিত। এছাড়া রয়েছে প্রতিটি সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অব্যাহত সংগ্রাম। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় এতসব সংগ্রামের ফসল এদেশের জনগণ এখনো পায়নি। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও ব্যক্তি বিশেষের খেয়াল-খুশি, জেদ বা অহমের কাছে জিম্মি হয়ে আছে দেশের রাজনীতি, দেশের মানুষ। গণতন্ত্রের মোড়কে একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থাই দেখছে দেশের জনগণ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪