ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মনুষ্যত্ব বিকাশে ধর্ম

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪
মনুষ্যত্ব বিকাশে ধর্ম

ধর্ম দুই প্রকার বলতে পারি। স্বভাব ধর্ম এবং আধ্যাত্মিক ধর্ম।

স্বভাব ধর্ম বলতে কোনো বস্তুর প্রকৃতিগত অবস্থাকে ইঙ্গিত করছি। যেমন বরফের ধর্ম হলো বরফ পানিতে ভাসে। মনের ধর্ম হলো চঞ্চলতা। চুম্বক লৌহজাত দ্রব্যকে আকর্ষণ করে। তাহলে লৌহজাত বস্তুকে আকর্ষণ করা চুম্বকের স্বভাব ধর্ম। স্বভাব ধর্মের অপর নাম সংস্কার ধর্মও বলা যায়।

সংস্কার ধর্ম মানে আগে থেকে হয়ে আসছে বলে বর্তমানও হচ্ছে। বর্তমানে হচ্ছে বলে আগামীতেও হবে। আধ্যাত্মিক ধর্ম হলো মানুষের ভেতরে যে এক অফুরন্ত শক্তি নিহিত আছে তাকে উদঘাটন করার এক উন্নত প্রক্রিয়া।

ধর্ম মানে ইহ-পরকালে একটি নন্দিত জীবন রচনার মূল ভিত। সংস্কার আচ্ছন্ন কোনো ব্যক্তিকে সংস্কারের খোলস থেকে বের করে এনে অফুরন্ত আলোর মিছিলে ছেড়ে দেওয়াই ধর্মের মুখ্য কাজ। মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ করাই ধর্মের ব্রত।

আমাদের শরীরের বাইরের চামড়ায় যখন ময়লা লাগে তখন আমরা তা সাবান দিয়ে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ময়লা মুক্ত হই। কিন্তু আমাদের মধ্যে অতিলোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, অজ্ঞানতা, নিন্দা, পরচর্চা ইত্যাদি কতগুলো ময়লা আছে। এই ময়লাগুলো আমাদের মনের ঘরটাকে ডাস্টবিনে পরিণত করে রাখে। যার ফলে উক্ত মন থেকে আমরা ভালো কিছু আশা করতে পারি না। যদিও বা মন্দ অনেক কিছু পাই। মনের সমস্ত ময়লা দূর করতে ধর্ম একটি সাবানের মতো কাজ করে থাকে। মূলতঃ ধর্ম মানে মানবতার এক অভিজ্ঞ পরিচালক। আবেগ তাড়িত বিবেক বিবর্জিত মানুষকে ধ্বংসের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য ধর্ম সবসময় জীবনের গান শোনায়। ধর্ম বিশ্বাস ধর্মভীরু মানুষদের অনেক পাপ আর অন্যায় থেকে রক্ষা করে। ধর্মবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি কখনো অধর্মের পথে চলেন না।

মানুষ যাকে অন্ধভাবে শ্রদ্ধা করে না ভালোবাসে না কেবল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র বিচার করে তাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে কেবল তাকেই ধার্মিক বা ধর্মবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি বলতে পারি। আমরা ধর্মাচার পালন করি কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়। নিজেকে শান্ত, সৌম্য আর পরিশুদ্ধ করার জন্য আমরা ধর্ম পালন করি। প্রতিটি ধর্ম মানুষকে নীতিবান, প্রজ্ঞাবান এবং শান্তিপ্রিয় হবার শিক্ষা দান করে। প্রতিটি ধর্ম বলে- তুমি আগে মানুষে পরিণত হও, নিজের মধ্যে এক অসম্প্রদায়িক চেতনার বীজ বপণ করো, মানুষকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসো, সর্বদা মানবতার জয়গান করো, সত্যের উপাসনা করো, পরচর্চা ত্যাগ করে আত্ম-সমালোচনা করো এবং নিজেকে আবিষ্কার করো অর্থাৎ ভেতরের মানব সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলো।

কোনো ধর্ম বলেনি যে, তুমি ধর্মের নামে অশান্তি করো, ধর্মের নামে কোন্দল করো, ধর্মের নামে রক্তপাত করো, ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করো, ধর্মের নামে সংঘাত করো। ধর্ম কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। কেউ ধর্মের পথে না চললে তার গলা কাটার শিক্ষা, তাকে নিন্দা করার শিক্ষা ধর্ম দেয় না। ধর্ম বলে তুমি তাকে ধর্মের শক্তি দিয়ে জয় করো, সে ধর্মের আশ্রয়ে আশ্রিত তাকে একথা বুঝানোর চেষ্টা করো।

ধর্ম-কর্ম করতে গিয়ে যদি কারো সাথে ভুল বোঝাবুঝি হয়, নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তাহলে সেটা ধর্মের কাম্য নয়। আমরা অনেক সময় নৌকা দ্বারা নদী পার হই। পার হবার পরে আমরা নৌকাটি কিন্তু সাথে করে নিয়ে যাই না। নৌকা দিয়ে আমরা কেবল এপার ওপার পারাপারের কাজটা করি। ঠিক তার মতো আমরা ধর্মকেও ব্যবহার করতে পারি। অর্থাৎ আমি ধর্ম করব নিজের ইহ-পরকালকে সুন্দর করার জন্য। আমি ধর্ম করব নিজের মধ্যে ঠেঁসে থাকা লোভ, দ্বেষ, মোহ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, অজ্ঞতা, অন্ধতা, ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ইত্যাদি বিসর্জন দেবার জন্য। আমি ধর্ম করব নিজকে শান্ত করার জন্য এবং নিজকে দমন করার জন্য। অন্যের সাথে বাড়াবাড়ি, তর্ক-বিতর্ক কিংবা যুদ্ধ করে ধর্মকে রক্ষা করা যায় না। ধর্ম রক্ষিত হয় নিজেদের আচরণের  মাধ্যমে। ধর্ম লাভ করা আর ধর্ম পালন করা একই বিষয় নয়। ধর্ম নিয়ে গর্ববোধ করা আর ধর্মাচারী হওয়া এক কথা নয়। যেমন- সংসারে এমন কতগুলো মানুষ আছেন যারা বংশের আভিজাত্য নিয়ে গর্ব করে কিন্তু নিজে একজন কুলাঙ্গার। পিতার পরিচয়ে, পূর্বসুরীদের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করার জন্য চেষ্টা করেন কিন্তু নিজের কোনো পরিচিতি নেই। কোনো গুণধর বংশ কিংবা পিতার পরিবারে জন্ম নিয়েছেন কিন্তু নিজে তাদের একজন হতে পারেনি।

আমাদের মনে রাখতে হবে গুণধর বংশে জন্ম নিলেও যদি নিজের সৎ গুণাবলী এবং প্রতিভা না থাকে তাহলে অন্যের কাছ থেকে শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান, পূজা আশা করা যায় না। একইভাবে ধর্ম তার যতই মহান হোক তিনি যদি ধর্ম আচরণ না করেন, মানুষ কখনো তাকে ধার্মিকের আসনে, পুজার আসনে কিংবা মনের মন্দিরে স্থান দেবেন না। অন্যদিকে জন্ম যেখানেই হোক নিজের কর্ম ভালো হলে অর্থাৎ নিজকে বিকশিত করতে পারলে সর্বস্তরের মানুষ তাকে ভালোবাসবেন, ভক্তি করবেন, শ্রদ্ধা করবেন, সম্মান করবেন।

ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুবই ক্ষতিকারক। একটি হলো ধর্মান্ধতা, অপরটি হলো অতি ধার্মিকতা। আমি যদি ভোগ-বিলাস, ধন-দৌলত, প্রভাব-পত্তিপত্তি, যশ-খ্যাতি লাভের জন্য ধর্ম করি, ধর্মের সাথে বিনিময়ের সম্পর্ক গড়তে চাই, ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা নিজের জীবনে প্রতিফলিত না করে কেবল বাহ্যিক আড়ম্বরতা নিয়ে মেতে থাকি তাহলে আমি কোনদিনও ধর্ম পালনে আত্মতৃপ্তি পাব না। এই যেমন ধরুন আমি আমার প্রতিবেশী বা পাশের বাড়ির লোকজন ভালোভাবে জীবন যাপন করুক সেটা মন থেকে মেনে নিতে পারি না। কিন্তু বিহারে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে জোর গলায় প্রার্থনা করলাম ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’। যেমন- কোন ব্যক্তি সংসার করেছে, তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আছে। কিন্তু পরিবারকে দেখাশুনা করেন না, পরিবারের ভালো-মন্দ নিয়ে কোনো দায়িত্ববোধ থাকে না। কিন্তু সারাক্ষণ ধর্মের ঘরে বসে দোয়া-দরুদ করেন। তাহলে তিনি ধর্ম পালনের যে একটা মানসিক শান্তি তা পাবেন কি? মানসিক শান্তি এবং নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য যদি কেউ ধর্ম করেন তাহলে তিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ধর্মের সাক্ষাৎ পাবেন। মানবিক সকল সেবা কর্মের মধ্যেও তিনি ধর্মকে উপলব্ধি করবেন। তখন মানবতাকে অবলম্বন করে বাঁচা তার সবচেয়ে বড় ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়।

ধার্মিক কে? যিনি ধর্মের পথে চলেন কিন্তু ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে থাকেন, তিনি প্রকৃত অর্থেই ধার্মিক। ধার্মিক ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য কী? লজ্জাবতী লতার মতো বিনীত স্বভাবের হবেন তিনি। আচার আচরণে কোনো ধরনের গোঁড়ামির ছাপ থাকবে না। নিরহংকারী, পরশ্রীকাতরতাহীন এবং সহজ সরল মনের মানুষ হবেন তিনি। পরনিন্দা, পরহিংসা এবং স্বার্থপরতা ইত্যাদি পরিহার করে অসম্প্রদায়িক চেতনাবোধ সম্পন্ন হয়ে থাকেন ধার্মিক ব্যক্তি। লোকদৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তি যদি নিয়ম মাফিক প্রতিনিয়ত প্রার্থনা কর্ম সেরে যান কিংবা ধর্মালয়ের সাথে একটি ওতপ্রোতভাবের সম্পর্ক রাখেন, দান-খয়রাত করেন আমরা তাকে ধার্মিক বলে অভিহিত করি। কিন্তু পরক্ষণে দেখা যায় উক্ত ধার্মিক ব্যক্তি যখন ধর্মান্ধ, স্বার্থপর, সাম্প্রদায়িক, অহংকারী, পরশ্রীকাতর এবং নিন্দুক স্বভাবের হয় তখন কেউ তাকে সহ্য করতে পারেন না। সবাই তাকে বিষ নজরে দেখেন এবং তার থেকে দূরে সরে থাকতে চান।

এমনটি হয় কেন? সংসারে এমনও কতগুলো মানুষ আছেন যারা সারা জীবন ধরে মন্দিরে যাচ্ছেন, মসজিদে যাচ্ছেন, পূজা-অর্চনা করছেন, ধর্মীয় উৎসব পালন করছেন কিন্তু ধর্মের আলোয় নিজকে একটুও পরিবর্তন করতে পারেননি। ধর্মবোধ মানে জীবনবোধ আর জীবনবোধ মানে ধর্মবোধ। তবে ধর্মবোধটা যাতে বাহ্যিক না হয়ে মনের হয়। জ্ঞানী মানুষেরা বাণীর চাইতে জীবন থেকে বেশি শিক্ষা চয়ন করেন। তাহলে আমরা যদি এমন জীবন গঠন করতে পারি যে, আমার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমার কাছে আসা মানুষটা কিংবা আমাকে অনুসরণকারী মানুষটা নিজকে নিজের মত করে সাজিয়ে নেবেন। এই কাজটা করতে পারলে ধর্ম আর মানবিকতা দুইয়ের মধ্যে একটুও ফারাক থাকবে না। তখন আমরা মানবতা লঙ্গন করে ধর্ম করার মতো গর্হিত কাজ থেকে দূরে থাকব। আর সেই কাজের কুপরিণতি থেকে পরিত্রাণ পাব। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। ধর্ম চর্চার করার আগে মনে রাখতে হবে মনুষ্যত্ব বিকাশে ধর্ম চর্চাই যথার্থ ধর্ম চর্চা।

পশু পশুত্ব নিয়ে জন্মায়। কিন্তু মানুষ মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মায় না। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। পশু জন্মসূত্রে পশুত্ব লাভ করে, যেমন করে কোনো বাঙালি শিশু জন্মসূত্রে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার এবং সুযোগ দুটোই লাভ করে। তাই সে অবচেতনভাবেই ভাষা প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু একটি বিশেষ ভাষা বলতে পারে না। বলতে গেলে আগে তাকে এটা সচেতন হয়ে শিখতে হয়। তদ্রুপ মনুষ্যত্ব জন্মসূত্রে লাভ করা যায় না। এমনকি কোনো মনুষ্যত্ববান পিতামাতার ঘরে মনুষ্যত্বসম্পন্ন শিশুর জন্মগ্রহণের নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তাই জন্মের পরপর একটা মানব শিশু পশুর সমান। পশুর কিছু বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে থাকে। এই পশুত্ব সম্পন্ন শিশু ধীরে ধীরে মনুষ্যত্ব লাভ করে এবং মানবে পরিণত হয়। পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে উত্তরণ হওয়ার জন্য তার প্রয়োজন হয় জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রজ্ঞার চর্চা। আবার মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা বা ধর্মচর্চা। পরিশুদ্ধ ধর্মচর্চা এবং ধর্মবোধ একজন মানুষের ভেতরের পাশবিক দিকগুলোকে সংহার করে তার ভেতরের মনুষ্যত্বকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। তখন তার উপাধি হয় মানুষ।

মান-অভিমান, লোভ, মোহ, হিংসা, ক্রোধ, পরশ্রীকাতরতা পশু ও মানুষ উভয়ের মধ্যে থাকে। তফাৎ হতে পারে অতিমান, অতিলোভ, অতিমোহ, অতিহিংসা, অতিক্রোধ, অতি পরশ্রীকাতরতায়। একটা পশু এগুলোর বলীয়ানে পশু হয়। কিন্তু এগুলোর বলীয়ানে মানুষ হওয়া যায় না। এগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারলে তবেই মানুষ হয়। পশু আহার নিদ্রা ও মৈথুন সেবন করে। মানুষও আহার নিদ্রা ও মৈথুন সেবন করে। মানবের ভোগ বিলাস, কামনা বাসনা এবং অন্তরের কালিমার বিচারে পশুর সাথে বেশি দূরত্ব নেই।

তাহলে মৌলিক দুরত্বটা কোথায়? মানুষের বিবেক থাকে যা পশুর থাকে না। মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে যা পশুর থাকে না। মানুষ ধর্ম পালন করে কিন্তু পশু ধর্ম-অধর্ম বোঝে না। মানুষ ত্যাগ করতে জানে কিন্তু পশু ত্যাগ বোঝে না। মানুষ চরিত্র বলে পূজার আসনে শ্রদ্ধার আসনে বসতে পারে, মানুষ সুউচ্চ পর্বত, মহাসমুদ্র, আকাশ ও চন্দ্র জয় করার ক্ষমতা রাখে যা পশুর পক্ষে সম্ভব নয়।

আজকে বিশ্বময় অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। ভাইয়ে-ভাইয়ে সংঘাত, পিতা-পুত্রে বিরোধ, বউ-শ্বাশুড়ি স্নায়ুযুদ্ধ, দেশে-দেশে যুদ্ধ, স্বামী-স্ত্রীর কলহ, গোত্রে-গোত্রে রক্তারক্তি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেন মানুষ মরণ খেলায় মেতে উঠেছে। একটি বিষয় স্বাভাবিকভাবে মনে এসে যায়। আগের চেয়ে বর্তমান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, ধর্মচর্চার পরিবেশ অনেকাংশে উন্নতি লাভ করেছে। ধর্মালয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক ও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু একই সাথে আমাদের মধ্যে দূরত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনাচার, ভ্রষ্টাচার, মিথ্যাচার, অবিচার, নির্যাতন, খুন, খারাবি, চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, দখল, দৌরাত্ম, হিংসা, হানাহানি, রক্তপাত, পরনিন্দা, পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা বহুলাংশে বলবৎ হয়ে উঠেছে। অথচ এমন হবার কথা নয়। এর কারণ হচ্ছে আমরা ধর্মের ভাষায় যা শুনছি তা মনে ধারণ করছি না, যা ধারণ করছি তা ব্যবহারিক জীবনে আচরণ করছি না। আর না হলে আমরা যদি নিজ নিজ ধর্ম যথাযতভাবে পালন করতাম তাহলে ধর্মের সুফল আমরা পুরো ষোল আনাই পেতাম।

একটা ছোট্ট গল্প বলি। এক ব্যক্তি প্রতিদিন সাঁকোর উপর দিয়ে পারাপার করতেন। সাঁকোটা ছিল বাঁশের তৈরি। আরেকদিন পার হবার সময় পা পিছলে সে খসে পড়ল বাঁশের উপর। সজোরে পড়ায় তার শরীরের হাত, পা, পিটসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষত হয়ে গেল। একইভাবে বাঁশের ও বিভিন্ন স্থানে ফেটে গেল।   রাত্রে খুব ব্যথা উতলে উঠল। সকালে ডাক্তারের কাছে গেলেন তিনি। ডাক্তারের কাছে সব কথা খুলে বললেন।
 
ডাক্তার তার কথা শুনে তাকে একটি মলম হাতে দিয়ে বলল এটি যেখানে যেখানে ফেটেছে সেখানে দিনে তিনবার করে মালিশ করবেন। সে মলম নিয়ে সোজা ঐ সাঁকোর উপর গেল। বাঁশের যে যে স্থানে ফেটে গিয়েছিল সে ঠিক সেই স্থান গুলোতে মলম মালিশ করা শুরু করলেন। ঐ দিন বরাবর তিন বার মালিশ করল। মলমের ছোট বোতলটি পুরো শেষ করে ফেললেন। রাত্রে তার যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেল। সকালে মলমের খালি বোতল সহ আবার উক্ত ডাক্তার এর আছে গেলেন।

এবারে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযোগ করলেন, ডাক্তার সাহেব আপনি এটি কেমন মলম দিলেন। ব্যথা তো একটুও কমেইনি উল্টো বেড়ে গেছে। আরেকটা ভালো দেখে মলম দেন না। ডাক্তার বাবু বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে ভাবছেন এমন তো হবার কথা নয়। ডাক্তার আবার জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মলম ঠিকভাবে লাগিয়েছেন তো?

আরে লাগিয়েছি মানে! আপনার কথা মতো পুরো তিনবার লাগিয়েছি। বিশ্বাস না হয় আপনি পরীক্ষা করে দেখে আসেন। এখনো বাঁশের উপর ঘ্রাণ পাবেন। মরেছে, ডাক্তার এবার ঘটনা বুঝতে পারলেন। তার রোগী মলম কোথায় লাগিয়েছে। ডাক্তার এবার চেচিয়ে উঠলেন; মরণ, আমি বলেছি মলম আপনার গায়ের ক্ষত স্থানে লাগাতে আর আপনি কিনা মলম লাগিয়েছেন বাঁশের ফাটা স্থানে। আপনার ব্যথা যাবে কি করে বলেন তো?

ওই সেইদিন আরেকটি মলম নিয়ে যখন তার গায়ে লাগায় তখন ব্যথা সেরে যায়। আমাদের ধর্মচর্চাও হচ্ছে ওই লোকটির মতো, তাই আমাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসছে না। তা না হলে মানুষ তার কর্মগুণে মহীয়ান হতে পারে। তবে সবার আগে মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে। আর মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটানোই হচ্ছে ধর্মের মূল লক্ষ্য। তাই মনুষ্যত্ব বিকাশে ধর্মের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।