সাম্প্রতিক লঞ্চ দুর্ঘটনার দিকে তাকানো যাক। এটাকে কি আসলে দুর্ঘটনা বলা যাবে? প্রকাশ্য অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার পরিণতিকে কি দুর্ঘটনা বলে দায়িত্ব এড়াতে পারি আমরা? দিনের পর দিন চলে আসা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা-অবহেলার পরিণতি এই ধরনের দুর্ঘটনা।
এখন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময়, ঈদের বাড়তি চাপ— এরকম একটা সময়ে মাওয়া ঘাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে কেন আপদকালীন কোনও প্রস্তুতি থাকবে না? দুর্ঘটনাটি ঘটার ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগলো উদ্ধার কাজ আরম্ভ করতে করতেই! সরকারি কর্মকর্তাদের কে বোঝাবে যে, হেলিকপ্টারে প্রমোদ ভ্রমণ নয় প্রয়োজন দুর্ঘটনার পরে ত্বড়িৎ সাড়া দেওয়ার সরঞ্জামাদি!
সাম্প্রতিক আরও দু'টি দুর্ঘটনা: একই কারণ, একই পরিণতি
এ বছর নৌ-নিরাপত্তা সপ্তাহটা পালিত হলো বেশ করুণ একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। গত ৪ মে যখন নৌ-নিরাপত্তা সপ্তাহ উদ্বোধন করা হলো ঠিক এর আগের দিন পাওয়া গেল একটি নৌ-দুর্ঘটনার খবর। ৩ মে পটুয়াখালির গলাচিপা উপজেলার কলাগাছিয়া নদীতে ঘটে এই দুর্ঘটনা। কালবৈশাখির কবলে পড়ে এমভি শাথিল-১ নামের লঞ্চটি ডুবে গিয়ে অন্তত ১৫ জনের প্রাণহানির কারণ হয়। আবার নৌ-সপ্তাহটি শেষ হতে না হতেই, গত ১৫ মে মুন্সিগঞ্জে দুর্ঘটনায় পতিত হয় আরেকটি লঞ্চ। মিরাজ-৪ নামের লঞ্চটি ডুবে যাওয়ায় প্রাণ হারান অন্তত ৫৫ জন যাত্রী।
গত ৩ মে পটুয়াখালিতে এমভি শাথিল-১ নামের যে লঞ্চটি ডুবে যায় তাতে কারিগরি ও কাঠামোগত ত্রুটি ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। এর আগেও এই একই লঞ্চ একবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। জানা যায়, যে নকশায় লঞ্চটি তৈরি সে রকম নকশার লঞ্চ ২০০৬ সালের পর থেকে চলাচলের উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে না।
২০০২ সালে নির্মিত এমভি মিরাজ যে নকশায় নির্মিত হয়েছে সে নকশাও বর্তমান সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। লঞ্চটির দৈর্ঘ্য ৩৫.৬৭ মিটার এবং প্রস্থ ৭.০৩ মিটার এবং গভীরতা ১.৯০ মিটার। অথচ দৈর্ঘ্য অনুযায়ী এর গভীরতা হওয়া উচিৎ ছিল ৩ মিটার।
এমভি মিরাজ যে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলছিল তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। লঞ্চটির যাত্রী ধারণের অনুমোদিত ক্ষমতা ২০২ জন থাকলেও লঞ্চটির রেজিস্ট্রার অনুযায়ী দুর্ঘটনার দিন তাতে মোট যাত্রী ছিল ৩৬৫ জন।
দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান
একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৪ সালের ১৫ মে পর্যন্ত ৪১৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। নৌ-দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ২০০৩ সালে। ওই বছর তিনটি নৌ-দুর্ঘটনায় মারা যায় ১ হাজার ১০৫ জন। এছাড়া, ২০১২ সালে তিনটি দুর্ঘটনায় ১৫০, ২০১৩ সালে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় ৩৯, ২০০৯ সালে চারটি দুর্ঘটনায় ২৩২, ২০০৮ সালে তিনটি দুর্ঘটনায় ১১২, ২০০৭ সালে ১০টি দুর্ঘটনায় ২৫৩, ২০০৪-০৬ সাল পর্যন্ত ১১টি দুর্ঘটনায় ৫০৩, ২০০২ সালে তিনটি দুর্ঘটনায় ৬০, ২০০১ সালে সাতটি দুর্ঘটনায় ৪০, ২০০০ সালে ছয়টি দুর্ঘটনায় ১০৪ এবং ১৯৯৯ সালে ২৯টি দুর্ঘটনায় ১০৪ জন মারা যায়।
ফিটনেসবিহীন নৌ যান ও অদক্ষ চালক
দেশের বিভিন্ন নৌপথে চলাচলকারী ৩৫ হাজার অভ্যন্তরীণ নৌযানের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন রয়েছে মাত্র ১৩ হাজারের। এর মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযান দুই হাজার ২২৫টি। যাত্রীবাহী নৌযানের মধ্যে বার্ষিক ফিটনেস পরীক্ষা বা সার্ভে করা হয় মাত্র ৮৫০ থেকে ৯০০টির। এ বিপুল পরিমাণ নৌযানের সার্ভে ও ফিটনেস পরীক্ষা করার দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র পাঁচজন ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার। ফলে ফিটনেসবিহীন লঞ্চের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫২৭২টি লঞ্চকে ফিটনেস পরীক্ষার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০৮২টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কাগজপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে ১৩৫৪টি লঞ্চকে ত্রুটিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করে এগুলোর রুট পারমিট বাতিলের সুপারিশ করা হয়, কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।
দক্ষ চালকের অভাবও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল রুটে মাত্র ১৩ জন সার্টিফিকেটধারী চালক আছেন। অথচ এই রুটে লঞ্চ চলে ১০০-র বেশি।
লঞ্চ দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হচ্ছে চালকের গাফিলতি, অদক্ষতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। অধিকাংশ লঞ্চে কোন দক্ষ চালক নেই। লঞ্চ মাস্টারদের অদক্ষতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। পাশাপাশি তারা কর্তব্যেও অবহেলা করে থাকে এবং নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থা মানে না। যেসব মাস্টার বিভিন্ন ধরনের নৌযান পরিচালনা করছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো-তাদের আবহাওয়া সম্পর্কে ভাল জ্ঞান নেই, কোন সময় কোন দিক দিয়ে গেলে ভাল হবে তা তারা জানেন না, নৌযান চলাচলের সংকেত সম্বন্ধে তাদের স্পষ্ট এবং সঠিক ধারণা নেই, নদী ও মোহনার বিভিন্ন পয়েন্টে ¯্রােত ও ঘূর্ণীর তীব্রতা, গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত ধারণার অভাব রয়েছে। তাছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় এবং কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় তা তাদের অনেকের জানা নেই, যারা জানেন তারাও আবার নানা কারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন না। এছাড়া নৌ- নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে মাস্টার-ড্রাইভারদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি কেউ মানছেন না। এক্ষেত্রে মাস্টারদের যারা পরীক্ষা নেন, পরীক্ষক বোর্ডের ওপরও এই দায়িত্ব বর্তায়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় এসব অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান যাচাই করা হয় না বলেই লঞ্চ দুর্ঘটনা কমছে না।
দেশের পরিবহন খাতে সবসময়ই নৌ পথ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট যাত্রী সংখ্যার শতকরা ৩৫ ভাগ নৌ পথে চলাচল করে। মালামালের ৭০ শতাংশ এবং তেলজাত দ্রব্যের ৯০ শতাংশ এই পথে পরিবহণ করা হয়ে থাকে। অন্য একটি হিসাব থেকে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৯ কোটি মানুষ দেশের নৌপথে যাতায়াত করে। নানা যৌক্তিক কারণেই নৌপথ দেশের জনপ্রিয়, সহজলভ্য এবং আরামদায়ক ভ্রমণ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। অথচ এই নৌপথ কারণ হচ্ছে নিয়মিত প্রাণহানিরও।
লেখক : উন্নয়কর্মী
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৪