ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘নিজেকে জানো’- একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ

শাখাওয়াৎ নয়ন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১৪
‘নিজেকে জানো’- একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অস্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি পুস্তক বিতরণ করা হয়েছে। বইটির নাম, ‘নিজেকে জানো’।



বইটি নিয়ে জামায়াতপন্থি দৈনিক পত্রিকা নয়াদিগন্ত বিষোদগারমূলক সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাদের সংবাদ শিরোনাম হলো ‘যৌনতায় ভরা বই বিতরণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে’। উক্ত রিপোর্ট আবার কয়েকটি পত্রিকা পূনর্মুদ্রণ করেছে।

প্রবাসে থাকি তাই এখনো বইটি সংগ্রহ করতে পারিনি। যতখানি জেনেছি, তা হলো, ১৪-১৮ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের জন্য বিজ্ঞান ভিত্তিক যৌন শিক্ষামূলক নির্ঘণ্ট বইটিতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। উক্ত বইতে ১৪-১৮ বছর বয়সের মানুষের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন এবং একই সাথে সামাজিক প্রভাব বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবন-যাপনের বিষয়েও উপদেশ দেওয়া হয়েছে।   

প্রসঙ্গত, উল্লেখ করছি, কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় শিক্ষানীতি, কতিপয় বিষয়ের অনুপস্থিতি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। উক্ত নিবন্ধে স্কুলপড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তনসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে পাঠদান করার ব্যাপারে আলোকপাত করেছিলাম। নিজ উদ্যোগে সংশ্লিস্ট মহলের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের কাছে লেখাটি পৌঁছানোরও ব্যবস্থা করি। একই সাথে তখন অত্যন্ত হতাশার সাথে লক্ষ্য করেছি, দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীরা পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিবর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের স্থান পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে পত্র-পত্রিকায় এবং টেলিভিশন মিডিয়ায় যথারীতি বুদ্ধি খরচে ব্যস্ত। ফলে-ফসলে এই বিষয়ে আর কোনো লেখা প্রকাশিত হয়নি।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানতে পারলাম, আমার নিবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য সফল হতে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যরক্ষা, বয়ঃসন্ধি এবং প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক কয়েকটি প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়াও গ্রহণ করা হচ্ছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প এবং সময় সাপেক্ষ। উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে পুস্তক রচনা থেকে শুরু করে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। চার বছরের মাথায় ঈদের কিছুদিন আগে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘নিজেকে জানো’ নামের পুস্তকটি নির্ধারিত ছাত্র-ছাত্রীদের মুখ দেখেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

জাতি গঠনে এই উদ্যোগ সুদূর প্রসারী ভ‍ূমিকা রাখবে। এটা এখন গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত সত্য যে, স্বাস্থ্য সচেতন শিক্ষিত বাবা-মায়ের ঘরে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, পুষ্টিহীনতা, সংক্রামক ব্যাধি, এমনকী দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কম।

অন্যদিকে তাদের মধ্যে মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু অনেক বেশি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কলেরা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, পোলিও, যক্ষ্মা, গুটি বসন্ত এবং বিভিন্ন রকম সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীতে এখন একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ এখনো অর্জন করতে পারেনি। শ্রীলংকার পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সংক্রামক রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে সফলতা লাভ করে এখন অসংক্রামক রোগ-ব্যাধি (নন-কমিউনিকেবল ডিজিজেস) নিয়ন্ত্রণের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য গবেষণার ক্ষেত্রে দ্য ল্যাঞ্চেট ( The Lancet) পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় বৈজ্ঞানিক জার্নালের একটি। ল্যাঞ্চেট ইতোমধ্যে, বাংলাদেশের উপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ওই সংখ্যায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ পৃথিবীখ্যাত স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের উপর নিবন্ধ লিখেছেন।

 ব্র্যাকের ড. মোশতাক রাজা চৌধুরী এবং আইসিডিডিআরবি’র প্রধান ড. আব্বাস ভুইয়ার নিবন্ধও স্থান পেয়েছে। Lancet & বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে ‘অলৌকিক’ বলে অভিহিত করেছে।

আমরা জানি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সব দেশেই কার্যকরী। এ প্রসঙ্গে স্পস্টভাবে বলা যায়, ‘নিজেকে জানো’ পুস্তকটি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়াবে, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার কমাবে এবং বিভিন্ন ধরনের চর্ম ও যৌণ রোগ প্রতিরোধ করবে। একই সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ব্যক্তির এবং রাস্টের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় কমাবে। ব্যস্টিক এবং সামস্টিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির যোগান দিবে।         

পুস্তকটির নামকরণে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্ত ‘Know thyself’ এর ব্যবহার দেখে অভিভূত হয়েছি এবং কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাষ! পুস্তকটি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই একটি গোষ্ঠী বিরুদ্ধাচরণে তৎপর হয়ে উঠেছে। উক্ত বইয়ের মধ্যে যৌনতা এবং অশ্লীলতা আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

এ প্রসঙ্গে একটি পুরানো গল্প মনে পড়ছে, একজন মানসিক রোগীকে একটা কাগজের মাঝখানে একটা সরল রেখা একে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন,
-এখানে কী দেখতে পাচ্ছেন?
রোগী এক ঝলক তাকিয়েই জিহবায় কামড় দিয়ে শরমে চোখ ঢেকে ফেলেন। ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
-কি ব্যাপার? আপনি এমন করছেন কেন?
-বড়ই শরমের ব্যাপার।
-আচ্ছা, শরমের ব্যাপারটি কি?
-একটা যুবতী মেয়ে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ডাক্তার সাহেব আরো অবাক হলেন। এবার তিনি উক্ত কাগজে সরল রেখাটির পাশে আরেকটি সরল রেখা একে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-এখন কি দেখতে পাচ্ছে?
-বলবো?
-বলুন
-একজন যুবতী মেয়ে এবং একজন যুবক ছেলে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ডাক্তার সাহেবের রোগ ধরতে কস্ট হলো না। কিন্তু গল্পের ঐ রোগী শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছিল কি না জানা নেই।

তেমনি আমাদের দেশে অনেক অসুস্থ ব্যক্তি আছেন। তাদের কোনো দিন সুস্থ করা যাবে কি না, আপনারা কেউ জানেন?   

লেখক: কথাসাহিত্যিক এবং পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।