ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জাতীয় শোক দিবসে—

বঙ্গবন্ধুর কাব্যভাষণ ।। মুহম্মদ সবুর

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪
বঙ্গবন্ধুর কাব্যভাষণ ।। মুহম্মদ সবুর

১৯৪৭ সালে দেশ যখন ভাগ হলো, তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব উপলব্ধি করলেন, এক উপনিবেশ থেকে বাঙালি আরেক উপনিবেশের অধীন হলো। কলকাতা ছেড়ে আসার আগে ঘরোয়া বৈঠকে সহকর্মী ছাত্রনেতা কয়েকজনকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন, আমরা শেষ হয়ে গেছি, নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হবে।

ঢাকায় এসে রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বুঝতে পারলেন যে, বাঙালি জাতি শেষ হয়ে গেছে, সেই দিনই শপথ নিলাম, বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে।

তার কিছুদিন পরই দেখলেন বাঙালির ভাষা ও কৃষ্টির উপর পাকিস্তানের নেতা জিন্নাহ্সহ শাসকগোষ্ঠীর আঘাত। থেমে থাকেননি। প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। ১৯৪৮ সালে গঠন করেন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এই সংগঠনের নেতৃত্বেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে শুরু করেন আন্দোলন। বাঙালি জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার প্রশ্নটি ছিল তীব্র। রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আন্দোলন করতাম— কী কঠিন অবস্থা ছিল। জনগণের ঘোর কাটানো ছিল প্রধান দায়িত্ব। ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ আন্দোলনে সামিল হলেও জনগণ ছিল নির্জীব।

সেদিন অক্টোপাসের মতো চারদিক থেকে বাংলাকে এবং বাঙালিকে শেষ করতে ষড়যন্ত্র চলছিল। ঠিক সে সময়ই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। বাংলাভাষা রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদেরসহ জেলে আটক থাকা অবস্থায় সংকল্পে আরো দৃঢ় হন যে, বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে, নতুবা ব্রিটিশদের নির্মম শোষণ শেষে পাকিস্তানি প্রভুদের শোষণে ত্রাসনে জনজীবন অতীষ্ট হয়ে দাঁড়াবে। বাঙালি জাতি বলে কিছুই থাকবে না। যে জাতি কিছুদিন আগেই ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলে আন্দোলন করেছে, তাদেরকে জাগিয়ে তুলতে হবে বাংলা ও বাঙ্গালিকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গবন্ধুর জানা ছিল সংস্কৃতির বাহন হিসেবে ভাষা হচ্ছে জাতির সামগ্রিক ঐতিহ্যের ধারক। কায়মনে বাঙালি হবার জন্য শেখ মুজিব তার জীবন সাধনা ও সংগ্রাম শুরু করেন সেই ১৯৪৮ সালেই।

বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকে বাঙালীর মুক্তিসনদ হিসেবে— আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এটি ছিল ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালির পাঠ্য রাজনৈতিক দলিল। যে দলিলের ভিত্তিতে বাঙালি সত্তরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল বঙ্গবন্ধু ও তার দলকে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফায় প্রচারণার জন্য ষাটের দশকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন; নাম ‘নতুন দিন’। সম্পাদক ছিলেন নজরুলের অনুরাগী এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ জন সুফী জুলফিকার হায়দার। পত্রিকাটি অবশ্য দীর্ঘায়ু হয়নি। বঙ্গবন্ধু কঁচিকাচার আসর ও সুরল ভৌমিক-এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের বাঙালি গড়ে তোলার জন্য নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছিলেন। ষাটের দশকে যারা কঁচিকাচার আসর করতেন। তাদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বক্তৃতায় কাব্যভাষার প্রয়োগ মেলে। উদাহরণ হিসেবে ৭ মার্চের ভাষণের কথা বলা যায়। কিন্তু এটি কেবল ৭ মার্চ ভাষণেই নয়, তাঁর অতীতের অনেক ভাষণে কাব্য ভাষা, ছন্দ, মাত্রা, অনুপ্রাসের অনুরণন মেলে। ১৯৭০ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের দিকে তাকালে দেখা যায় তার কাব্যভাষা। এই ভাষণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ছোট ছোট বাক্য। কিন্তু অর্থের দ্যোতনা অনেক বেশি। হুমকির ভাষা যখন, তখন আঞ্চলিক বা উপজাতিকে সামনে এনেছেন, যা শ্রোতা-উদ্দীপক বৈকি। ১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বর বেতার টিভিতে সাধারণ নির্চাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ভাষণ দেন, সেখানেও তার ভাষা-সৌকর্য উল্লেখ করার মতো। সাড়ে সাতকোটি নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে সহজ সংযোগ সাধন করার ভাষাই তিনি ব্যবহার করেছেন ভাষণে, বলেছেন, “২৩টি বছরের অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও শাসনে বাংলার মানুষ আজ নিঃস্ব, সর্বহারা। ক্ষুধায় তাদের অন্ন নেই, পরনে নেই বস্ত্র, সংস্থান নেই বাসস্থানের। বাঙলার অতীত আজ সুপ্ত, বর্তমান অনিশ্চিত, ভবিষ্যত অন্ধকার। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ঢেলে দিয়ে আজও যারা ঘুমিয়ে আছেন, তাদেরকে এবার ডাক দিয়ে কেবল বলে যেতে চাই, জাগো, বাঙালি জাগো। তোমাদের জাগরণেই এদেশের সাত কোটি মানুষের মুক্তি। ” এই ভাষণে প্রতিটি শব্দ ও বাক্য একসূত্রে গ্রথিত। অনুপ্রাস এসেছে। বিপ্লবী চেতনা জাগাতে মানুষের মধ্যে, সহজ সরল ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রতিটি বাক্য নানা দ্যোতনা বহন করে। শ্রোতা তার বোধ দিয়ে উপলব্ধি করে নিতে পারে। কবিতার অনুরণন এখানে সহজেই মেলে। জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে তাদের ভেতরে জাগিয়ে তোলার জন্য সংঘবদ্ধ করার কাজটি এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি করেছেন।

স্বাধিকার আদায়ে ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন, তাতে আবেগপূর্ণ ভাষার আড়ালে প্রতিরোধী হবার, কঠিন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবার আহ্বান জানান। ৭ মার্চ ভাষণের পটভূমি এই ভাষণে মেলে— “প্রয়োজনে বাঙালি আরো রক্ত দেবে, জীবন দেবে, কিন্তু স্বাধিকারের প্রশ্নে কোনো আপোস করবে না। বাংলার মানুষ যাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে, বরকত সালাম রফিক শফিকরা নিজেদের জীবন দিয়ে সেই পথ দেখিয়ে গেছেন। বাহান্ন সালে রক্তদানের পর বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তরে— বারবার বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু আজও সেই স্বাধিকার আদায় হয়নি। আজও আমাদের স্বাধিকারের দাবি বানচাল করে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য বাংলার ঘরে ঘরে প্রস্তুত হতে হবে। এবার চূড়ান্ত সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে আমরা গাজী হয়ে ফিরে আসতে চাই। চরম ত্যাগের এবং প্রস্তুতির বাণী নিয়ে আপনারা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ুন। বাংলার প্রতিটি ঘরকে স্বাধিকারের এক একটি দুর্গে পরিণত করে দেখিয়ে দিন; বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার শক্তি পৃথিবীতে কারো নেই। ” এই দাবিয়ে রাখা বাক্য তো মার্চের ভাষণে ‘দাবায়ে রাখবার পারবা না’ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের শেষে কবিতার অনুরণন মেলে, অথচ এই কবিতার অন্তর জুড়ে রয়েছে একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশিকা ও করণীয়। বললেন তিনি, “সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি হয়তো আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে মরতেই হয়। জানি না, আবার কবে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারবো। তাই আজ আমি আপনাদের এবং বাঙলার সকল মানুষকে ডেকে বলছি, চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হন— বাংলার মানুষ যেন শোষিত না হয়। বঞ্চিত না হয়। বাঙালি যেন আর অপমান লাঞ্ছিত না হয়। দেখবেন, শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, যতদিন বাংলার আকাশ-বাতাস, মাঠ-নদী থাকবে, ততদিন শহীদরা অমর হয়ে থাকবে। বীর শহীদদের অতৃপ্ত আত্মা আজ দুয়ারে দুয়ারে ফরিয়াদ করে ফিরছে: বাঙালি তোমরা কাপুরুষ হইয়ো না। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও স্বাধিকার আদায় করো, বাংলার মানুষের প্রতি আমার আহ্বান— প্রস্তুত হোন। ” এই ভাষণে বাঙালির জাতিসত্তার জাগরণের দরোজা খুলে দিয়েছিল। মুক্তিকামী মানুষের জন্য প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি ভাষণ দ্রুত সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষা এবং ভাষা ব্যবহারের সৌন্দর্য ছিল গণমানুষের সহজবোধ্যতাকে ধারণ করে। ভাবীকাল যখন এই ভাষণগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে যাবেন, দেখা মিলবে, সময় এবং স্থান কাল পাত্রকে সামনে রেখে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মেলে ধরেছেন। একটি জাতি, তার ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর কাজটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার নিজস্ব চর্চার মধ্য দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

বাংলাদেশ সময়: ১৯২১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।