সকলকে স্নিগ্ধ শরতের কাশফুল শুভেচ্ছা! মেঘ মাধুর্যে পরিপূর্ণ বর্ষার আকাশকে এবং শ্রাবণের সজল মেঘের বারিধারাকে ‘যেতে নাহি দিব’ বলে শিশির সিক্ত শিউলিঝরা শরৎ প্রাতের সমীরণে নরম সুরেলা সুরের মূর্ছনা উঠিয়ে- শুভ্র কাশবনে মৃদু দুলুনি দিয়ে নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে সবার মনে পুলক জাগিয়ে কোমল শান্ত সিগ্ধ শরৎ এর আগমন ঘটেছে ১৬ আগস্ট ২০১৪, ১ ভাদ্র ১৪২১ বঙ্গাব্দ শনিবার।
শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা।
ভাদ্র-আশ্বিন দু্ই মাস শরৎকাল- অর্থাৎ আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত। তখন প্রকৃতি হেসে উঠে- তাই কবি গুরু গেয়ে উঠেন, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি’- কিন্তু “মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’, রাত বলেছে ‘যাই’,/সাগর বলে ‘কুল মিলেছে- আমি তো আর নাই। ”
-তারপরও মেঘ যাচ্ছে না। শরতের ভোরের স্নিগ্ধতায় এ অপরূপ ঋতু শরৎকে দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে। ’
শরৎ হল প্রকৃতির ঋতু- তাই এই ঋতুতে প্রকৃতির শোভা বৃদ্ধি করতে ফুটে উঠে শিউলি, শাপলা, পদ্ম, টগর, কামিনী, মালতি, জবা, হাসনাহেনা এবং শুভ্র কাশফুল। কাশফুল শরতের আগমনের প্রতীক।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘দুই ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। ’ কাশফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি প্রেমীরা ভিড় করেন কাশবনে এবং শরতের মৃদু হাওয়ায় মোহনীয় রূপে দুলে ওঠা শুভ্র কাশফুলের মধ্যদিয়ে ঝকঝকে নীলাকাশে সাদা মেঘ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন শরৎ প্রেমীরা। শরতের আরো একটি প্রতীক শিশির সিক্ত শিউলি ফুলের সৌরভের কথা উল্লেখ না করলে শরতের অপরূপ প্রকৃতির বর্ণনাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
শুভ্র শিউলি ফোটে শরতের নির্জন রাতে এবং মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে দিয়ে নিশির শিশির সিক্ত শিউলিতলা সাদা করে দিয়ে ঝরে যায় খুব ভোরে সূর্য উঠার আগেই। শিউলি ফুলের অপূর্ব মালা গাঁথা নিয়ে বাংলা কাব্যে কত কবিতা, কত গান, কত ছড়া রয়েছে তার হিসেব নেই এবং অনেক উপন্যাস-উপাখ্যানেও শরতের শিউলি ফুলের মালার কথা উল্লেখ রয়েছে। নজরুল গীতিতেও শিউলি ফুলের মালার কথা উল্লেখ রয়েছে- ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ। ’ ‘শিউলি মালা গেঁথে ছিলাম তোমায় দেবো বলে। ’
তাই শরৎ হল একটি শিল্পী ঋতু- বাংলার প্রকৃতি তার অপার রূপ বিলিয়ে দিয়েছে এই ঋতুতে। বাংলার ষড়ঋতুতে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ঋতুরাজ্যে চলছে নানা অনিয়ম -তারপরও শারদ প্রাতের স্নিগ্ধতায় যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। তাইতো রবীন্দ্রনাথের শরৎ মুগ্ধতা আবারও প্রকাশ পায় তার সঙ্গীতে- ‘তোমায় দেখেছি শারদ প্রাতে’।
‘কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই’- বর্ষার একটানা মেঘ-বাদলের পর নীল আকাশে রৌদ্রোজ্বল ঝলমল দিনের আগমনে কবির মনে ছুটির ঘণ্টা বেজে ওঠে এবং মেঘ কেটে যাওয়ায় সকলকে নিয়ে রোদমাখা খুশি উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে মন চায়।
শরৎ এর মত এমন শুভ্র-স্নিগ্ধ-শান্ত মৌসুম আর নেই। শরতের মোহনীয় অপরাহ্ন, শরতের স্বপ্নীল সাদা মেঘ, শুভ্র কাশবন, শরতের স্বচ্ছ জ্যোৎস্নায় মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে এবং প্রিয়জনকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। নীল আকাশে সাদা তুলোর মত মেঘগুলোকে উড়ে যেতে দেখে মন উদাসীন হয়ে উঠে- মনের কিনারা ছুঁয়ে যায় কী সব অজানা অনুভূতি! তাইতো শরৎ প্রেমী রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- 'শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি/শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুণ্ডলে/বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/আজ প্রভাতের হৃদয় উঠে চঞ্চলি’
বিশ্ব পরিবেশ পরিক্রমায় বাংলার শরৎ প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা-এরকম স্নিগ্ধ-শান্ত ঋতু পৃথিবীর আর কোথাও নেই- তাই এ যেন বাঙালির একান্ত নিজস্ব ঋতু। বিশ্বের অন্যান্য দেশে শরতে পত্রপতনশীল গাছ-পালার রং বদলাতে থাকে- কিন্তু বাংলার গাছপালা থাকে চিরহরিৎ। তাই শরতের রং-বেরঙের পাতার বৈচিত্র আমাদের চোখে পড়ে না। স্নিগ্ধ শরতের পূর্বাহ্ন-মধ্যাহ্ন-অপরাহ্ণ-রাত সবগুলোই উপভোগ করার মত। তাই আজ বাংলার শরতের শান্ত-স্নিগ্ধ কোমল মোহনীয় অপূর্ব রূপ ছড়িয়ে যাক বাঙালির মত সবার চোখে-মুখে, সবার অন্তরে।
ফারুক ওয়াহিদ: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, মুক্তিযোদ্ধা
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৪