ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

তবু চন্দনের সাথে আর দেখা হবে না

সাইফুল্লাহ মাহমদুদ দুলাল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৪
তবু চন্দনের সাথে আর দেখা হবে না

চন্দন! ওবায়দুল গণি চন্দনকে আমি ‘গণি মিঞা’ বলে ডাকতাম। আর ওর সাথে দেখা হলে দূর থেকেই  মজা করে বলতো- ‘গণি মিঞা একজন কৃষক।

তার নিজের জমি নাই। তাই অন্যের জমি চাষ করে!’ আর কাছে এসে কানে কানে দুষ্টুমি করে বলতো- নিজের বউ নাই। তাই, অন্যের বউয়ের সাথে প্রেম কর। হাহাহাহাহা...’ সেই হাসিটা এখনো কানে বাজে।

তার সাথে এত মধুর ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব! দীর্ঘ দিন প্রায় একই পথের পথিক ছিলাম। আমি কবিতা লেখার পাশাপশি মাঝে মাঝে ছড়া লিখতাম। চন্দন বলতো, ‘বড় ভাই, আমাদের ভাত মারবেন না। প্লিজ। হাহাহাহাহা...’ এ রকম যৌথ কথা বা সমবেত কথা কাটাকাটির শেষ নেই। যা আজ শুধুই স্মৃতি।

ফেরুয়ারি মাস। বাংলা একাডেমিতে বইমেলা চলছে। তখন সে দৈনিক ইত্তেফাকের 'তরুণ কণ্ঠ' ফিচার পাতার প্রদায়ক। অফিসের কাজ শেষ করে মেলা শেষ হবার সময় এসেছে। আমরা বের হচ্ছি। চন্দন ভেতরে ঢুকতে গিয়ে পুলিশের বাঁধার সন্মুখিন হয়। চলে সাংবাদিক আর পুলিশের লড়াই। তার সাথে সাংবাদিকের আইডি নেই। পুলিশ বলছে- ভূয়া সাংবাদিক! চন্দন তো আরো ক্ষেপে গেছে। পরে যে যার ক্ষমতা দেখাচ্ছে! আমি কাছে গেলাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুবাদে আনসার-পুলিশ আমাকে চিনে ফেলে- বিষয়টি সুরাহা করে দিলে বল্লো- ‘দূর শালা, আর যাবোই না। চলো বাসায় চলে যাই’।

আমি প্রেসক্লাব থেকে মিরপুরের বাস নেবো। চন্দন বল্লো- ওস্তাদ, শাহবাগ থেকে উঠেন। আমিতো থাকি ফলপট্টি; মানে কাঠাল বাগান, কলা বাগান এলাকায়! এভাবেই ফান করে, মজা করে কথা বলত চন্দন।

চন্দনের বাড়ি নান্দাইল আর আমার হচ্ছে- নান্দিনা। আমরা মৈমন্সিঙ্গ্যা। মানে বৃহত্তর ময়মনসিংহ। এলাকা নিয়ে কথা হচ্ছে। বললাম, ময়মনসিংহের অনুবাদ করলে কি হয়, জানো। চন্দন দ্রুত বল্ল, ‘My men sing, আমার মানুষ গান করে’। উত্তরটা তার জানাই ছিলো। মনে পড়লো- মৈমনসিং গীতিকা! বলল, আমার একটা ছড়ার বইয়ের নাম রাখবো- ‘আমার মানুষ গান করে। হাহাহাহা...সে জন্যই মৈমনসিং গীতিকা বিখ্যাত! আমি কিন্তু অনেক আগে থেকেই আমার বইয়ের নাম ঠি করে রাখি বড় ভাই। প্রবাদগুলো কাজে লাগাবো। যেমন- ‘কান নিয়েছে চিলে, আঙুল ফুটে বটগাছ, তিন তিরিকে তিন, কি বলেন ওস্তাদ?

জানেন বড় ভাই, ‘চন্দন’ কে নিয়া প্রবলেমে আছি। অই আফলাতুন ‘আপা’ বানরের লেজ ছেঁটে দেয়। মিলন ভাই, রিটন ভাই আপনারা ফাইট করেন নি কেন? তাহলে আর আমার লেজ কাটত না। হাহাহাহা...

এ ভাবেই আবোল-তাবোল আলাপ করতে করতে শাহবাগে চলে এলাম। বলল- ‘চলেন, চা খাই। শালার বেটারা আমারে থানায় নিতে চাইছিলো। কত বড় বেয়াদপ! আজ আপনি না থাকলে ঝামেলা করতো। হাহাহাহা....

দারুণ, দারুণ ছড়া লিখতো। তার অনেক মজার মজার ছড়া আছে। তাকে দেখতে ম্যাগগাইভারের মতো। তাই নিজেকে নিয়ে ছড়া লিখেছে। বলেছে- ‘বড় ভাই, আফনেরে সোহেল রানার মতো লাগে। লিখবো নাকি- নকল এক সোহেল রানা?’

তুখোড় ছড়াকার চন্দনের ছড়ায় শুধু ছন্দমিলই নয়; বিষয় বৈচিত্রতা, উপস্থাপনায় সব দিক দিয়েই ছিলো আকর্ষণীয়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। টাইপের ছয় ধরনের ফ্রন্ট নিয়ে লিখেছিলো-‘ছয় বান্ধবী’ ছড়াঃ

সুলেখা আমার সবচেয়ে প্রিয় ভালোবাসি খুব তাকে,
তাইতো দেখি সে অনেক ব্যাপারে সঙ্গী হয়েই থাকে।
সুশ্রীকে লাগে মোটামুটি ভালো মেঘনাকে নয় মন্দ,
সুতন্বীর মুখ দেখা ইদানীং করেই দিয়েছি বন্ধ!
সাবরীনা খুব পপুলার নয় মাঝে মাঝে দেখা হয়,
চন্দ্রাবতীও নজর কেড়েছে মনকে করেছে জয়!

২০১২ সালে ঢাকায় গেলাম। আমার শাহবাগের অফিসে ছুটে এলেন চন্দন। বার বার একই কথা বল্লো, ‘ফিরে আসুন বড় ভাই। বিদেশে কি করবেন। দেশে আপনাদের দরকার!’

এতো আন্তরিক ছিলো চন্দনের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। অস্থির, আড্ডাবাজ, প্রাণবন্ত, পাগলাটে, চঞ্চল চন্দন হঠাৎ গত ফেব্রুয়ারিতে আমার উপর অনেকটা অকারণেই (তার কাছে কারণ থাকতে পারে) ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে আক্রমণ করলো।

আমি তার কাছে একজনের ফোন নম্বর চেয়েছি ফেসবুকের ইনবক্সে। কেনো চেয়েছি? তাই সে তার ওয়ালে ভালোমন্দ সত্যমিথ্যে মিলিয়ে একটা ‘বাঁশ’ দিলো! আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ! অনেকেই সেই স্ট্যাটাসের বিরোধিতা করে লিখলো। একজন তো ঘোর আপত্তি করে বলল যে, একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়টি ইন বক্সে অর্থাৎ ইন সাইডে রাখাই ভালো। তা বাইরের ওয়ালে জানানো কি ঠিক?

সেখানে অনেক কথাই ঠিক বলেন নি চন্দন। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, দেশে গিয়ে তার কাছে জানতে চাইতাম। কিন্তু তার আগেই চন্দন চলে গেলো। জানা হলো না অনেক কথা। যেমন একটি, সে যে লিখেছে- দুলাল ভাই, আমাকেও বিটিভিতে তার ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ ছড়া পড়ার সুযোগ দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে দাদা ভাইয়ের মুখ দিয়ে ভালো ছড়া লেখকদের সাথে আমার নাম বলিয়েছেন!

আমি নাকি সেই ক্যাসেট আমার আজিজ মার্কেটের অফিসে তাকে দেখিয়েছি। কথাটা আংশিক সত্য। কারণ, বিটিভির বেটাকম ক্যাসেট দেখানো কোনো মেশিন আমার অফিসে আজো নেই!

আমি কি করবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। কোনো জবাব না দিয়ে ঘটনাটা তার বন্ধু শহিদুল ইসলাম মিন্টুকে বল্লাম এবং খুব কষ্টে আমি তাকে আমার বন্ধুর তালিকা থেকে বাদ দিলাম।

আজ চন্দন আরো বেশি কষ্ট দিয়ে তার বন্ধন থেকে আমাদের সবাইকে বাদ দিয়ে ছুটির দিনে ছুটি নিয়ে দ্রুত চলে গেলো দূরদেশ, পরবাসে। আমিও তো আরেক পরবাসে থাকি। তবু চন্দনের সাথে আর দেখা হবেনা।

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: প্রবাসী কবি, লেখক, saifullahdulal@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ২১২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।