খুন হওয়া, নিহত হওয়া, মারা যাওয়া ইত্যাদি কথাগুলো মূলত একই ভাববাচক, কিন্তু সমার্থক নয়। তবে খুন ও নিহত এবং মারা যাওয়া কথাগুলোর পরিণতি এক এবং অভিন্ন।
কোন ব্যক্তি যখন পরিকল্পিতভাবে অন্যের হাতে প্রাণ হারায় তখন সেটি হল খুন (মার্ডার)। যেমন প্রতিদিন সন্ত্রাসী, ডাকাত এবং পেশাদার খুনিদের হাতে অনেকে প্রাণ হারায়। কোন ব্যক্তি অপরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে অজ্ঞাতে অজান্তে যদি কারো অসাবধানতার কারণে প্রাণহারায়, সেটিকে নিহত হওয়ার ঘটনা বলা যায় (প্রিমেচার ডেথ)। যেমন সড়ক পথ, জলপথ এবং আকাশপথে গাড়ি, লঞ্চ, বিমান ইত্যাদি দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়।
অবশ্যই এক্ষেত্রে আমি শুধু নিজের ইচ্ছা এবং চেষ্টাকে বিচার করছি। কোন ব্যক্তি বয়সের কারণে মারা গেলে সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু (ন্যাচারাল ডেথ) বলে বিবেচনা করা হয়। আরেক ধরনের মৃত্যু আছে যা শুধু নিজের ইচ্ছা এবং চেষ্টাতেই হয়। নিজের চেষ্টা এবং ইচ্ছাতেই হয় বলে এর নাম আত্মহত্যা (সুইসাইড)। এই ধরনের মৃত্যুকে বলা হয় অপমৃত্যু (আনন্যাচারাল ডেথ)। তাই দেশের প্রচলিত আইনানুসারে কোন ব্যক্তি খুন কিংবা নিহত হলে সেই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি সাহায্য নেওয়ার এখতিয়ার আছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি বা দণ্ড দিতে পারেন আদালত। আর যদি আত্মহত্যার কোন ঘটনা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কাউকে দণ্ডারোপ করতে পারে না। অবশ্যই আত্মহত্যায় কেউ প্ররোচিত করেছে বলে আলামত থাকলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা যায়। রাষ্ট্র তখন অভিযোগটি আমলে নিয়ে তা খতিয়ে দেখবে।
যেমন ধরুণ, দুই বন্ধু বাজি ধরেছে দুইতলা দালানের ছাদ থেকে একজন নিচে লাফ দেবে। লাফ দেওয়ার মত সাহস তার মধ্যে আছে। অপর বন্ধু তাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ যুগিয়েছে। তুমি ভীতু, কাপুরুষ ইত্যাদি বলে তাকে ক্ষেপিয়েছে। এক পর্যায়ে সে ছাদ থেকে লাফ দিতে বাধ্য হয়েছে। লাফ দেওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় প্ররোচনা দেওয়ার দায়ে তার বন্ধু অভিযুক্ত হতে পারে। অথচ সে তার বন্ধুকে নিজ হাতে ছাদ থেকে ফেলে দেয় নি। তার বন্ধু নিজেই লাফ দিয়ে মরেছে। ইদানিং আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। কিছু মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অর্থ বিত্ত সব উজাড় করে দিচ্ছে। মানুষ নিজের শরীরকে বাঁচানোর জন্য সমস্ত ধন ব্যয় করে প্রয়োজনে ঋণ করে। আবার নিজের জীবনকে বাঁচাতে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ত্যাগ করে। আর কিছু মানুষ অর্থবিত্ত, আশা, শরীরের মায়া সব ভুলে নিজেই নিজের জীবন নাশ করে। এই জগতে মানুষতো যুগ যুগ ধরে বাঁচতে চায়। কেউ মরতে চায় না।
রোগব্যাধি, অভাব অনটন, এমনকি বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও মানুষ আরো বাঁচতে চায়। বাচাঁর স্বাদ কখনো মেটে না। প্রয়োজনে অক্সিজেন দিয়ে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষকে অমর করে রাখার জন্য বিজ্ঞান কি চেষ্টাই না করছে।
এক বুড়ি তার পরিবার নিয়ে যন্ত্রণায় ছিলেন। ঘরে ছেলের বউ, নাতী-নাতনী সবাই খুব উৎপীড়ন করত। তিনি প্রতিদিন মন্দিরে এসে দীর্ঘ উপাসনা করতেন। উপাসনা শেষে আবার একান্ত প্রার্থনাও করতেন। প্রার্থনায় বলতেন, ‘হে ভগবান; তুমি এত মানুষকে মৃত্যু দাও তবু আমাকে ডেকে নিচ্ছ না কেন! আমি আর বাঁচতে চাই না। আমাকে ডেকে নাও, মৃত্যু দাও। প্রতিদিন এভাবে প্রার্থনা করতেন। এক দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে তার সব কথা দূর থেকে শুনত। আরেকদিন বুড়ি মা আসার আগে সে মন্দিরে ঢুকে লুকিয়ে থাকল। বুড়ি প্রতিদিনকার মত লাঠিতে ভর দিয়ে মন্দিরে এলেন। এসে পূর্বের মত উপাসনা করে আবারও একই প্রার্থনা শুরু করলেন। তখন লুকিয়ে থাকা ছেলেটি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে, তুমি যখন এত কষ্টে আছো বলছো আমি তোমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেব আজ। আমি তোমাকে এখুনি মৃত্যু দেব। চল আমার সাথে। একথা শুনা মাত্র বুড়ি আঁতকে উঠলেন। মাথা তুলে চারদিকে এক নজর দেখে নিলেন। তারপর এক দৌড় .... । লাঠি ফেলে দৌড়াচ্ছেন আর শুধু বলছেন, আমি এখন যাব না। আমি মরার কথা এমনি বলেছি যে, আমি মরতে চাই না। ঘরে পৌঁছে ধুম করে পড়ে বেহুঁশ হয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে চেতনা ফিরলে বাড়ির সবাই জানতে চাইলেন কি হয়েছে আপনার। বাইরের দিকে তাকিয়ে বুড়ি বললেন, সর্বনাশ হয়ে যেত আরেকটু হলে। ভাগ্যিশ! আমি দৌড়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিলাম। আজকে আমাকে যমরাজ নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি আর কখনো মন্দিরে যাব না। এর চেয়ে বরং তোমরা অনেক ভাল।
অর্থাৎ মনের দুঃখে কিছু কিছু মানুষ মৃত্যু কামনা করলেও প্রকৃতপক্ষে কেউ মরার পক্ষে নয়। আর যারা মরার নামে আত্মহত্যা করছেন তারা ভুল করছেন। এটা এক ধরনের ক্রাইম। পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় ফেল, ব্যবসায়িক ক্ষতি, আশার অপূর্ণতা ইত্যাদি কারণে সম্প্রতি আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। সব ধর্মে পরকালের কথা উল্লেখ আছে। স্বর্গ-নরক বিশ্বাস সর্বধর্মে আছে। যারা আত্মহত্যা করে মারা যায়, ধর্মবিশ্বাস মতে তাদের পারলৌকিক গতি তেমন ভাল হয় না। ইহকালেও আত্মহত্যার ঘটনাকে মানুষ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। জীবনে অনেক ধরনের দুঃখ কষ্ট থাকে। আর জীবনে যদি সুখ দুঃখের পালাক্রম না থাকত মিশ্রণ, না থাকত তাহলে জীবন এতটা মধুর ও উপভোগ্য হত না।
জীবনে দুঃখ কষ্ট না থাকলে মানুষ দুঃখ মুক্তির পথ অনুসন্ধান করত না। দুঃখকে জয় করার জন্য এত সাধনা করত না। যদিওবা মরতে চায় না কেউ বাঁচতে চায় সবাই তথাপি, জীবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে মরাটা সহজ বাঁচাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে থাকটাই মানব জীবন। মানুষের মন যখন সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় তখন মানুষ আত্মহত্যার মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে বুঝতে হবে মনটা আমার। আমার মনটা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আমার নিজের উপর। নিজ হাতে পরহত্যা যেমন পাপের কাজ, তেমনি আত্মহত্যাও একটি পাপের কাজ। বীরযোদ্ধা যেমন রণক্ষেত্রে বিনাযুদ্ধে শত্রুর কাছে মাথা নত করেন না তেমনি জীবন সংগ্রামী মানুষ কখনো আত্মহত্যা করে জীবনযুদ্ধে হেরে যান না। আত্মহত্যায় সমস্যার সমাধান হয় না। সমস্যা কেবল বাড়ে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৪