সরকারের একগুঁয়েমির সঙ্গে খাটাশ ধরার ফাঁদ। নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থতার সঙ্গে ওই ফাঁদে বিএনপি।
‘৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা ফিরে এলেও সংসদ কখনোই পুরোপুরি কার্যকর হয় নি। তারপরও মানিক মিয়া এভিনিউয়ের অসাধারণ স্থাপত্য নির্দশনের ওই ভবনে বিরোধীকণ্ঠ উচ্চকিত ছিলো। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এখন সেখানে শুধুই সরকারের গুণকীর্তন। বিরোধীদলে থেকেও সরকারের অংশীদার হওয়া জাতীয় পার্টির এমপিদের বক্তব্যে স্বভাবতঃই বোঝা যায় না তাদের আসল পরিচয়।
রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের একটি আইনসভা এভাবে আসলে এখন পুরোপুরিই অন্য স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগের অঙ্গুলি হেলনে চলা এক রোবট।
অন্য যে স্তম্ভ বিচার বিভাগ, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই বিচার বিভাগকেও পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের কড়া পাহারায় রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে।
আর যে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়, তার একটি সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য সম্প্রচার নীতিমালা করে দেখানো হচ্ছে রক্তচক্ষু। সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের পত্রিকা বন্ধের ক্ষমতা দিয়ে সংবাদপত্রকেও ভয়ের রাজত্বে ভীত রাখার চেষ্টা আছে। অনলাইনের জন্যও তৈরি হচ্ছে নীতিমালা।
এটি এখন পরিষ্কার যে, সবগুলো বিষয়ই একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত। যার লক্ষ্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তাঁর যে দলকে ২১ বছর ক্ষমতা থেকে বাইরে রাখা হয়েছিলো, সেই দল যেনো এখন যেভাবেই হোক দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারে তার ষোল আনা যোগাড়-যন্তর।
সবকিছুর শুরুটা নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে। এর প্রাণপুরুষ সেসময়ের প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
বিচারপতি খায়রুল হক এখন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। মন্ত্রিসভায় ষোড়শ সংশোধনী প্রস্তাব পাস হওয়ার পর তিনি সংশোধনী উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন। এ সংশোধনী পাস হলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা পাবে জাতীয় সংসদ। জিয়ার আমলে করা পঞ্চম সংশোধনীর ফলে এ ক্ষমতা এখন বায়বীয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের।
অথচ ওই সংশোধনীকেই অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তারপরও কিভাবে সেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা থেকে গেলো! এর কারণ জিয়ার সবকিছু অবৈধ ঘোষণা করলেও অভিশংসনের বিষয়ে জিয়ার করা সংশোধনীটিই রেখে দিয়েছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক। জেনারেল জিয়া অভিশংসনের ক্ষমতা যে জাতীয় সংসদের পরিবর্তে বায়বীয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে দিয়েছিলেন, তা তিনি বাতিল করেন নি।
তখন বিচার বিভাগের লোক হিসেবে তিনি হয় তো আইনসভার নামে নির্বাহী বিভাগকে তাঁর চাকুরি খাওয়ার ক্ষমতা দিতে চান নি। এখন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি আর তাতে সমস্যা দেখছেন না।
সমস্যা না দেখার কারণ, সংসদীয় ব্যবস্থায় এরকমই হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৭২’র সংবিধানেও তাই ছিলো। তবে এখন নিয়ে এ বিতর্কের কারণ, সংসদীয় ব্যবস্থা হলেও বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগের মতো সংসদও এক ব্যক্তির ইচ্ছায় চলে, দু’ক্ষেত্রেই শীর্ষ মানুষটি একজন। তার উপর আছে কথিত ফ্লোর ক্রসিং ঠেকানোর ৭০ বিধি। আমাদের সংসদ তাই আসলে নির্বাহী বিভাগ, আরো স্পষ্ট করলে, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর অধীনস্ত একটি প্রতিষ্ঠান।
এটা ঠিক যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দেয়া মানে প্রকারান্তরে তা নির্বাহী বিভাগের হাতেই তুলে দেয়া। তাই ষোড়শ সংশোধনী পাস হলে এখন বিচারপতিদের নিয়োগের মতো তাদের থাকা না থাকার সিদ্ধান্তের মালিকও হবে নির্বাহী বিভাগ।
তাই বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, সকাল-বিকাল বিচারপতিদের চাকরি নট করে দেবে জাতীয় সংসদ। অথবা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো বিচারপতিদের চায়ের নিমন্ত্রণ জানিয়ে তাদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।
তা হলে কেনো এ সংবিধান সংশোধন উদ্যোগ?
এটা অন্য কিছুর জন্য নয়। শুধু এ জন্য যে, সর্বোচ্চ আদালত যেনো মনস্তাত্ত্বিকভাবে সারাক্ষণ মনে রাখে যে, তাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় সংসদের নামে সরকার অর্থাৎ সরকার প্রধানের খুশি-অখুশির উপর নির্ভরশীল।
একই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার ঘটেছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের একটি সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য সম্প্রচার নীতিমালায়।
দূরবর্তী লক্ষ্য বিচারপতিদের এক ধরনের মানসিক চাপে রাখা হলেও, ষোড়শ সংশোধনী উদ্যোগের পক্ষে আপাতঃ চোখে যেমন অনেক যুক্তি আছে, সম্প্রচার নীতিমালার পক্ষেও যুক্তি কম নয়।
সবচেয়ে বড় যুক্তি যে, বাংলাদেশের সম্প্রচার মাধ্যমে কিছুটা হলেও নৈরাজ্য চলছিলো। লাইসেন্স থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই নিয়মের কোনো বালাই ছিলো না। এজন্য সাংবাদিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও কেউ কেউ নীতিমালার কথা বলেছিলেন। সম্প্রচার মাধ্যমের লাইসেন্স বিষয়টা আসলে সরকারের কাজের অংশ। এখন সরকার যদি সেজন্য কোনো নীতিমালা করতে চায়, সেটা সম্প্রচার মাধ্যমের লাইসেন্স নীতিমালা হতে পারে।
কিন্তু তার সঙ্গে সরকার আরো অনেক কিছু জুড়ে দিয়েছে। আপাতঃ চোখে তার অনেক কিছুই খুব স্বাভাবিক এবং নিয়মতান্ত্রিক। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন নীতিমালার অংশটুকু বিটিভি থেকে কাট-পেস্ট হলেও তা অসাধারণ। কিন্তু সাধারণ যেসব নীতিমালা, যা আসলে সাংবাদিকতার সাধারণ নীতি-নৈতিকতারই অংশ এবং সরকার চাপিয়ে না দিলেও যার চর্চা অবশ্যই গণমাধ্যমকে করতে হবে; সেসবের সঙ্গে কয়েকটি ধারাতেই সরকারের ভবিষ্যৎ ইচ্ছা সম্পর্কে সন্দেহ অনেক।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশবিরোধী এবং জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। দেশবিরোধী বক্তব্য প্রচার করলে অবশ্যই লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু জনস্বার্থ বিষয়টা আপেক্ষিক। সেটা সরকারের কাছে একরকম, বিরোধীদলের কাছে অন্যরকম; আবার বাস্তবতায় তা হতে পারে একেবারেই আলাদা।
বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত পরিহার করার কথাও বলা হয়েছে নীতিমালায়। গণমাধ্যমকে অবশ্যই তা করতে হবে। কিন্তু কোনটা বিভ্রান্তিকর, কোনটা না; সেই বিষয়টাই তো বিভ্রান্তিকর।
নীতিমালায় আছে, কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বা মর্যাদাহানিকর তথ্য প্রচার করা যাবে না। এটাও আপেক্ষিক বিষয়। এরশাদ বিয়ে করলে কেনো প্রচার হবে না! বনখেকোর বালিশের ভেতর টাকা পাওয়া গেলে কেনো না! আর যেটা মর্যাদাহানিকর, সেটা রাজনীতিকরাই একে অন্যের বিরুদ্ধে বলেন। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন ‘গোলাপি’ আর ‘গোপালি’ বলা হয়, তখন মিডিয়া সেখান থেকে বের হবে কিভাবে!
নীতিমালায় একথাও বলা হয়েছে যে, সশস্ত্র বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থার প্রতি কটাক্ষ বা বিদ্রুপ কিংবা তাদের পেশাগত ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে পারে এমন কোনো দৃশ্য প্রদর্শন কিংবা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। শুধু সশস্ত্র বাহিনী কেনো, কারো ভাবমূর্তিই তো নষ্ট করা উচিত নয়। কিন্তু কোনো বাহিনীর কেউ সাত খুন করে ফেললে! কোনো গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিজেই ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকলে! অথবা পুলিশ প্রধান বা গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কেউ শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার নেপথ্যে থাকলে!
নীতিমালা অনুযায়ী, বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন প্রচার করা যাবে না যাতে সুসম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। এ বিষয়টাও খুবই আপেক্ষিক। সুসম্পর্ক নষ্ট না হওয়ার যে নির্দেশনা, সেটা কি দেশের স্বার্থের বিনিময়ে হলেও?
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় এরকম আরো কিছু বিষয় আছে।
কিন্তু নীতিমালায় যে বলা আছে, ‘অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন দেশের প্রচলিত আইন, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে’-- এটাই আসলে মূল কথা।
দেশের মূল আদর্শ না মেনে কোনো কিছুই করা উচিত নয়, গণমাধ্যমেও তাই হওয়া উচিত। কিন্তু কারো সমাজতান্ত্রিক বা নতুন অন্য কোনো সমাজ ব্যবস্থার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বক্তব্য দেয়ার অধিকার থাকতে পারবে না, সেটা ঠিক নয়।
এরকম কিছু বিষয় ছাড়া সম্প্রচার নীতিমালার শব্দের পর শব্দ কিংবা বাক্যের পর বাক্য গ্রহণযোগ্যই মনে হবে। কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্যও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী উদ্যোগ চেষ্টার মতোই। সেটা হলো, সম্প্রচার মাধ্যমকে সবসময় এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকির মধ্যে রাখা। ‘অনেক কথা যাও যে বলে, কোনো কথা না বলি’র মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা।
গণমাধ্যমের পর বিচার বিভাগ, এর আগে সংসদ। গণজাগরণের অভিজ্ঞতায় নতুন কোনো গণজাগরণ আগাম ঠেকাতে আগাম বিভক্তি। এভাবে সবকিছু সরকার একাই নিয়ন্ত্রণ করলে রাষ্ট্রের মূল তিন এবং চতুর্থ স্তম্ভের মধ্যে শুধু একটি স্তম্ভই থাকবে। সেটা হচ্ছে সরকার। তবে তাতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যত কি হবে, সেটা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারে।
জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই
বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৪