ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে গোয়েন্দা চাষাবাদ

জাহিদ নেওয়াজ খান, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৪
ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে গোয়েন্দা চাষাবাদ ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানি গোয়েন্দা চাষাবাদে জঙ্গিবাদি খুনে মানসিকতা, সঙ্গে সুবিধাবাদি রাজনীতির ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা। এ দুয়ে মিলেই ২১ আগস্ট, গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা।

সেই হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা যার পিতা, এ জাতির জনক, সামরিক ক্ষমতা আকাঙ্খা আর সুবিধাবাদী রাজনীতির রক্তাক্ত এক অধ্যায়ের শিকার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।

শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা এটাই অবশ্য প্রথম আর শেষ না। বোন শেখ রেহানাসহ বিদেশে থাকায় ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গেলেও ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফেরার পর থেকে এরকম চেষ্টা হয়েছে বারবার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিরাই বারবার এ চেষ্টা চালিয়েছে।  

এসব ঘটনার কোনো বিচার না হওয়ায় এটা স্পষ্ট, ওইসময়ের শাসক এরশাদ এবং তার গোয়েন্দা বাহিনীর অজান্তে কিছুই হয় নি। সেই এরশাদ অবশ্য এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত, কথিত বিরোধীদল হয়েও সরকারের অংশী তার জাতীয় পার্টি।

১৯৯০ সালে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হয়েছিলো। কিন্তু জিয়ার সময় দেশে-বিদেশে পুনর্বাসিত বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তখনও বহাল তবিয়তে থাকায় তারা শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা থেকে সরে আসে নি। কারণ শেখ হাসিনা পরে ক্ষমতায় এলে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছিলো তাদের। খালেদা জিয়ার সময় শেখ হাসিনার উপর হামলাগুলোরও বিচার না হওয়ায় এটা বোধগম্য, হামলার নেপথ্যে ছিলো রাষ্ট্রীয় আশ্রয়-প্রশ্রয়।

তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার ঠেকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র সফল হয় নি। শেখ হাসিনা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক বললেও, তার আন্দোলনের ফসল হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কারণেই ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করেন।

বেশিরভাগই বিদেশে পালিয়ে থাকলেও, দেশ থেকে তখন গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হওয়া খুনিদের অবশ্য এজন্য শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, তিনি দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন নি। খুনিদের এটা প্রাপ্য হলেও শেখ হাসিনার সময় নিয়মতান্ত্রিক বিচার আর পরে খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মতান্তরে তৃতীয় এবং ওয়ান ইলেভেন আমলে ইচ্ছা করে দেরি করার প্রক্রিয়ায় খুনিরা বেঁচেছিলো প্রায় এক যুগ।

দ্রুত বিচার না হওয়ার কারণ জানা যায় মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের একটি বক্তব্যে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিশেষ এজলাসে (বিশেষ আদালত নয়, নিরাপত্তাজনিত কারণে বিশেষ এজলাস) বিচার চলার সময় তিনি আমিসহ কয়েকজন সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘এরকম বিচারে দীর্ঘসময় লেগে যেতে পারে। হাসিনাকে বলেছিলাম, বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত বিচার হোক। কিন্তু হাসিনা রাজি না। বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ যাতে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে, সেজন্য প্রচলিত আইনের প্রতিটি অক্ষর ফলো করার পক্ষে সে (শেখ হাসিনা)। ’

শেখ হাসিনা এভাবে আইনের শাসনের প্রতি তাঁর সম্মান রাখলেও খুনিরা যে সবসময়ই খুনি  সেটার প্রমাণ তাঁর পুরো আমল জুড়েই ছিলো। ফারুক-রশিদদের কথিত ফ্রিডম পার্টি তখন নেই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার জন্যও তখন নিরাপত্তা বেষ্টনি অনেক শক্তিশালী। সেসময় তাই পাকিস্তানি আইএসআই-এর নেটওয়ার্কে গঠিত হুজির মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোকে শেখ হাসিনাকে হত্যার মিশনে জড়িত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে থাকায় এসব চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

কিন্তু ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর! শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলে। জাতির জনকের কন্যা হিসেবে তার বিশেষ নিরাপত্তার জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে যে আইন তা বাতিল হয়ে গেছে। আর সে সুযোগটাই নেয় আগের হত্যা চেষ্টা চালানো বিভিন্ন নেটওয়ার্ক। এবার তারা এক হয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায়। শেখ হাসিনার জন্য এটা ছিলো সবেচেয়ে ‘ক্লোজ কল’। তিনি বেঁচে গেলেও নিহত হন আইভি রহমানসহ ২৪ জন।

সকলের নিশ্চয়ই মনে আছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তখন এনএসআই তদন্তকারীদের ঘটনাস্থল এবং শেখ হাসিনার গাড়ির কথিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে বাধা দেয়া হয়। বাইরে  থেকে তখনই বোঝা যাচ্ছিলো, শুধু জঙ্গিবাদি গ্রুপ কিংবা বঙ্গবন্ধুর যে খুনিরা বিদেশে থেকে তাদের নেটওয়ার্ক তখনও রক্ষা করতে পারছিলো; এ ঘটনায় শুধু তারাই জড়িত নয়, রাষ্ট্রশক্তির কিছু অংশও আছে নেপথ্যে। জজ মিয়া কাহিনীতেই তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ওয়ান ইলেভেন তত্ত্বাবধায়ক আমলে নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ধারণা আরো স্পষ্ট হয়। পরে তো বোঝা গেলো, ক্ষমতার রাজনীতির একটি অংশও এর সঙ্গে জড়িত।

ক্ষমতার এ রাজনীতি আর ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা হিসেবে হত্যা এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলছে সেই ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকেই। সে কারণেই বারবার শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা। জাতির সৌভাগ্য যে, অন্ততঃ শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে কোনো মিশনেই ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয় নি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ ১৯টি হত্যা চেষ্টা থেকে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ছলে-বলে-কৌশলে নিজেরাই এখন ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চায় শেখ হাসিনার দল।

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।