১৯৯১ সালের জানুয়ারি। সে সময় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডিক চেনির প্রবল আপত্তির মুখে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে কংগ্রেসের অনুমোদন চান প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডাব্লিউ বুশ।
কিন্তু এত দ্রুত যুদ্ধ শেষ করে ফেলাটাকে মেনে নিতে পারেননি ডিক চেনি। তিনি যথেষ্ট নিরাশ হয়েছেন। কারণ চেনি চেয়েছিলেন, বুশের শুরু করা এ যুদ্ধ যেন বেশ দীর্ঘ হয়। যাতে এর মধ্য দিয়ে বাগদাদের নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায় এবং সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। এ যুদ্ধের পর ১৯৯১ সালের বসন্তে এসে বুশের জনপ্রিয়তা তুমুল উত্তুঙ্গে উঠে যায়। এরপর দেড় বছরের মাথায় পুননির্বাচিত হওয়ার জন্য বুশের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে যায়।
মজার বিষয় হল, কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটের মধ্যে যারা প্রেসিডেন্ট হওয়ার বাসনা রাখেন তাদের মধ্যে জো বাইডেন এবং জন কেরিসহ অনেকেই তখন বুশের বিরুদ্ধে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। এতে বুশকে তাদের কাছে অসহনীয় মনে হয়নি। বরং প্রথমে যুদ্ধ শুরু করতে তারা বিরোধিতা করলেও পরে যখন দেখা গেল মার্কিন সেনারা বিজয়ী হতে যাচ্ছে তখন তারা যুদ্ধ দীর্ঘ সময় চালিয়ে যাওয়ার দাবি করেন। এ ধরনের বক্তব্যকে নিছক প্রচারণা হিসেবে চালিয়ে গেলেও এড়ানো যায়নি।
কেউ কেউ মনে করেন, কংগ্রেসের কাছে যুদ্ধ শুরু করার যে অনুমতি চেয়েছেন বুশ তাই ডেমোক্র্যাট নেতা বিল ক্লিনটকে প্রেসিডেন্ট করে তোলে। কারণ সে সময় ক্লিনটন বুশের অনুমোদন প্রস্তাবের পক্ষ বা বিপক্ষে কোনো ভোটই দেননি। ক্লিনটন তখন আরকানাস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন পাবার জন্য একটি ভালো সমঝোতা হয়েছে।
২০০২ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয়বার ইরাকে হামলার জন্য বাবার মতো ছেলে জর্জ ডাব্লিউ বুশও কংগ্রেসে অনুমোদনের প্রস্তাব তোলেন। বাবা বুশ যখন প্রথম ইরাক যুদ্ধ শুরুর অনুমতি চান, তখন ডিক চেনি বিরোধিতা করেছিলেন। এবার এই চেনি ছেলে বুশের অনুমোদন প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও দাঁড়ান। ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার কোনো সুযোগ পেয়ে যাবে মনে করে বিরোধিতা করতেন চেনি। ১৯৯১ সালেও ঠিক একই চিন্তা করে বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
এগারো সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এখনো দেশব্যাপী উচ্চ সতর্কতায় আছে। ধারণা করা হয়, এ ঘটনার পর আমেরিকায় এ ধরনের যেকোনো হামলার অনুমোদন প্রস্তাবে ‘না’ ভোটের কোনো উপযুক্ততা নেই।
নিউইয়র্ক থেকে তখন হিলারি ক্লিনটন জুনিয়র সিনেটর। সে সময় ২০০২ সালের গরমের মৌসুমের শেষের দিকে দ্য নিউ ইয়র্কার-এ আসেন সাক্ষাৎকার দিতে। এ সময় তিনি কয়েকটি মন্তব্য করেন এবং কিছু প্রশ্ন রাখেন। হিলারি ঠিক কি নিয়ে কথা বলেছিলেন আমি ভালোমত মনে করতে পারছি না। তবে আমি তাকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম সেটা মনে আছে। প্রশ্নটি হল, ‘সিনেটর ক্লিনটন, আপনি কি মনে করেন, যেসব ডেমোক্র্যাট সিনেটর প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারত, তাদের জন্য ইরাকের বিরুদ্ধে হামলার অনুমোদন প্রস্তাবের বিষয়টি কি বুশ প্রশাসনের পাতানো ফাঁদ? প্রশ্নটি শুনে ক্লিনটন হেসে দিলেন। এই ফাঁকে আমি বেশ নিরিহ গোছের লোকের মতো ডেবডেবে চোখে তাকিয়ে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম। একটু থেমে ক্লিনটন বললেন, ‘পাতানো ফাঁদ? আমি দুঃখিত। এই শব্দটির সাথেই আমি পরিচিত না। আপনার পরের প্রশ্নটি করুন। ’
ডেমোক্র্যাটদের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ থাকার পরও ইরাকে হামলার জন্য কংগ্রেসে অনুমোদন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়ার ঘটনা শেষ পর্যন্ত একটি পাতানো ফাঁদে রূপ নেয়। ক্লিনটনও এই হামলা চেয়েছিলেন। ফলে হামলার জন্যই ওই অনুমোদন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সবশেষে মানে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর তিনি এ যুদ্ধের ঘটনা এবং তার পক্ষে ভোট দেয়াকে খারাপ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। অথচ ২০০৮ সালে তিনি বারাক ওবামার সাথে তাল মিলিয়েছেন। সে সময় বুশের মেয়াদ শেষ হওয়ার মুহূর্তে এই ওবামাই তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দিকের প্রচারণায় ব্যাপকভাবে বুশের ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। সাথে সাথে ক্লিনটনও যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। এ ধরনের প্রচারণা কৌশল ব্যবহার করেই প্রথমবার বাবা জর্জ বুশের সময় বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হন। একইভাবে দ্বিতীয়বারও একই কৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট হন বারাক ওবামা। যদিও হিলারি প্রেসিডেন্ট নন।
ডেমোক্র্যাটদের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ থাকার পরও ইরাকে হামলার জন্য কংগ্রেসে অনুমোদন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়ার ঘটনা শেষ পর্যন্ত একটি পাতানো ফাঁদে রূপ নেয়। ক্লিনটনও এই হামলা চেয়েছিলেন। ফলে হামলার জন্যই ওই অনুমোদন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সবশেষে মানে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর তিনি এ যুদ্ধের ঘটনা এবং তার পক্ষে ভোট দেয়াকে খারাপ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। অথচ ২০০৮ সালে তিনি বারাক ওবামার সাথে তাল মিলিয়েছেন। সে সময় বুশের মেয়াদ শেষ হওয়ার মুহূর্তে এই ওবামাই তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দিকের প্রচারণায় ব্যাপকভাবে বুশের ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। সাথে সাথে ক্লিনটনও যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। এ ধরনের প্রচারণা কৌশল ব্যবহার করেই প্রথমবার বাবা জর্জ বুশের সময় বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হন। একইভাবে দ্বিতীয়বারও একই কৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট হন বারাক ওবামা। যদিও হিলারি প্রেসিডেন্ট নন।
দ্য আলটান্টিকেও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ক্লিনটন। সাময়িকীটির সাংবাদিক জেফারি গোল্ডবার্গের নেয়া ওই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে বুঝা গেল, ক্লিনটন ওবামার চেয়েও অনেক বেশি হকারগিরি করেন। তবে এর জন্য তাকে কোনো ভোট সংগ্রহ করতে হয়নি। মানে বুশ হামলার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন চেয়ে প্রস্তাব আনলেও ওবামাকে দেখে কেউ মনে করবে না যে, তিনি কংগ্রেসের অনুমতি চেয়েছেন। কোনো সন্দেহ নেই, ক্লিনটন আসলেই একজন হকার-ফেরিওয়ালা। তবে তিনি যাকিছুই করছেন, তার সবই করছেন তার রাজনীতির মধ্যে থেকে। মানে রাজনীতির মধ্যে সবই আছে। কিন্তু অবশ্যই তার একটা হিসাব নিকাশ তো থাকা উচিত। তাহলে তার হিসাব নিকাশটা কি? মনে করা হয়, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ক্লিনটনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যেমন, ব্যতিক্রমভাবেই ২০০৮ সালে দেখা যায় তার দলের ভেতরের শান্তিপ্রিয় শিবির তার মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। যেকারণে ২০১৬’র নভেম্বরের নির্বাচনেও ডেমোক্র্যাটরা এক হয়ে বলতে পারে যে, ওবামার চেয়ে আমাদের আরো বড় হকার দরকার।
এই সমীকরণের প্রথম অংশটাই কার্যকর হয়ে আসছে। ফলে দ্বিতীয় অংশটা বাদ। অর্থাৎ, আজকের দিনে মার্কিন রাজনীতি যে ‘হাইপার পার্টিজান’ বা অতিমাত্রায় দলীয় হয়ে গেছে এটা যথেষ্ট সত্য। তারপরও এটা ঠিক নয়। কারণ প্রতিটা পার্টিরই একটি স্থায়ী ও গভীর চিন্তাভাবনা আছে—যেটা সবধরনের দোষের ঊর্ধ্বে কাজ করে। একদিকে থেকে এটাও কোনো ঘটনা নয়। মানে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের স্বাতন্ত্র্যবাদী ঐতিহ্য রয়েছে, উচ্চ বিনিয়োগের ব্যাপারে সংশয় আছে—এমনকি অন্যদেশে যুদ্ধ-সংঘাতে মার্কিন সেনাবাহিনীর সম্পর্কের ব্যাপারে ওবামার অমীমাংসিত ইস্যুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঘাত করা না করার ঘটনা। মাত্র দুবছরের একজন জনপ্রিয় রিপাবলিকানও এসব ইস্যুতে আঘাত করতে পারত। একইসাথে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপারেও আমরা ক্লিনটনের ব্যাপারে যেভাবে সাধারণত ধারণা করি সেটাকেও আঘাত করা সম্ভব। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
ক্লিনটন যে পর্যায়ের রাজনীতি করেন তার সবেচেয়ে ভয়াবহ দিক হল, বর্তমানকে উতরে গিয়েও তার সম্ভাবনা। এটি এমন এক সম্ভাবনা, যেটাকে যুক্তিহীন একটি অবস্থান মনে হবে। এ ধরনের সম্ভাবনা বা অবস্থান শেষ পর্যন্ত ধ্বংসাত্মক হয়ে হয়ে উঠতে পারে।
ক্লিনটনের লেখা ‘হার্ড চয়েস’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থার ঘটনা নিয়ে তার এই বই। জুলাইয়ে বের হয়েছে বইটি। বইটির প্রথম দিকে তার সিদ্ধান্ত হল, তিনি খুব অকপট হবেন না। বইটির পাঠ বেশ বিরক্তিকর। আবার শেষ দিকে বলছেন, তিনি অনেক বেশি অকপট হবেন। এই দুইরকম সিদ্ধান্তের একটিই মূলত আগে তাকে দ্রুত সফল করে তুলেছে। কিন্তু এখন দুইরকম সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে। তবে এই দুই সিদ্ধান্তের কোনটি ভুল হবে সেটা বলাটা খুবই কঠিন।
লেখক: নিকোলাস লিম্যান। ১৯৯৯ থেকে দি নিউইয়র্কার এর নির্ধারিত লেখক
অনুবাদক: শাহাদাৎ তৈয়ব
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৪