এই মুহূর্তে লেখালিখি হচ্ছে যে, পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ অবরোধ করে ফেলছে তেহরিক-ইনসাফ নেতা ইমরান খানের ‘আজাদি’ বিক্ষোভ মিছিল আর তাহিরুল কাদরির ‘ইনকিলাব’ বা অভ্যুত্থান মিছিল। এ আন্দোলন বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ, বর্তমান আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৩-এর সাধারণ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে জবাবদিহিতা, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও আইনের সংস্কার এবং নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি অরাজনৈতিক সরকার গঠনের দাবি তুলছেন পাকিস্তানের ক্রিকেটের সাবেক এই তারকা।
চলমান এই দুই বিক্ষোভ মিছিলে প্রায় দশ লাখ কিংবা তারও বেশি মানুষ একযোগে এসব দাবি উচ্চারণ করছে। এ বিক্ষোভের ফলে রাজধানী ইসলামাবাদের পুরো শহর কানায় কানায় ভরে গেছে। বিক্ষোভের মাত্রা ও চাপ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিক্ষোভে এমন বিপুল জনস্রোত যদি ঠেকানো না যায়, তবে শহরজুড়ে বড় ধরনের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই অস্থিতিশীলতা ইমরানের আজাদি নাকি তাহির কাদরির ইনকিলাব ঘটাবে সেটা বলা একটু মুশকিল। বিক্ষোভরত এই দুই দলের অভিমুখ কোন দিকে যাবে তার বাইরে গিয়ে বলা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কারণে ইমরানের ‘আজাদি’ বিক্ষোভ থেমে যেতে পারে। এর মধ্যেই পাক সেনাবাহিনী পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যেকোনোভাবেই হোক পাল্টা বিপ্লবীর ভূমিকায় হাজির হবে। কারণ, সেনাবাহিনীই পাকিস্তানের সবগুলো দলের প্রধান প্রতিক্রিয়াশীল পক্ষ।
হতে পারে আর্মি একটা সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখে যাবে। মানে আর্মি কাউন্টার রেভুলুশনারি ভূমিকায় যাবে। যেহেতু তারা ইমরান আর কাদরিকে নওয়াজ শরিফের সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। মানে সেনাবাহিনী ইমরান আর কাদরির এ বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে মারাত্মকভাবে উল্টো চাপে ফেলবে নওয়াজকে। এতে যা আর্মির নগদ ফায়দা হবে, তা হল, পাক সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠিত কাঠামো ও সিস্টেমের দাসত্ব বরণ করে নিতে বাধ্য হবে নওয়াজ সরকার। পরিস্থিতি এমন জায়গায় যাচ্ছে যেখানে আর্মি সরাসরি ক্ষমতাগ্রহণের দিকে যে যাচ্ছে, তা নিয়ে ইমরান, কাদরি বা সরকার কেউই মাথায় নেয়নি। অথচ ইসলামাবাদ ও লাহোরে ধারাবাহিকভাবে ভুল নিয়ন্ত্রণ ও ভুল রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করে যাচ্ছে সরকার ও তার প্রশাসন।
ইসলামাবাদ ও লাহোর এই দুই শহর যুগপৎভাবে ইমরান ও কাদরির মারাত্মক ও নিয়মিত অবস্থান হয়ে উঠেছে। তাদের এই বিক্ষোভময় অবস্থান রাষ্ট্রের পরিস্থিতি ও প্রক্রিয়াকে এখন এমন জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখানে নওয়াজ ও তার অনুগত মন্ত্রীঅমাত্যদের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার জন্য সম্মানজনক যেকোন পথই যেন অসম্ভব হয়ে উঠছে।
এর মানে, যখন মূল হোতাদের ক্ষমতা ভেঙে পড়ছে তখন এই বিক্ষোভকারী নেতারা মনে করছেন, তারা তাদের প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে পেরেছে। অথবা মারাত্মকভাবে ভোগাইতে পেরেছে। তাদের রাজনীতির ক্ষতি এতে হয়ত পুষিয়ে নেয়া যাবে না। এমনকি এই রক্তহীন লড়াই থেকেও তাদের কাউকে বের হয়ে আসতে হবে না। কিন্তু এ লড়াইয়ের আসল বিজয়ী হল বিড়াল—মানে পাক আর্মি। বিড়াল বেশে এই আর্মি পাকিস্তানের রাজনৈতিক শ্রেণীকে বানরে পরিণত করেছে। তবে বানরমার্কা রাজনৈতিক শ্রেণী ক্ষমতার জন্য লড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার ফল কেড়ে নিচ্ছে সেনাবাহিনীই। মোটকথা, পাকিস্তান বিশ্বে
একমাত্র বিরল ঘটনা, যেখানে আদালত পর্যন্ত সামরিক অভ্যুত্থানকে, মানে অবৈধ সেনা অভ্যুত্থানকে বিপ্লব ঘোষণা দিয়ে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে।
এটা খুবই পরিষ্কার যে, ইমরান খান কিংবা তাহিরুল কাদরি তারা নিজেরা যে দাবি তুলেছেন সেগুলো কোন যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় তুলেছেন তা নিয়ে তারা মোটেও ভাবেননি। এমনকি কেউ তাদের চিন্তা-ভাবনার কাজটাও করে দিচ্ছে কিনা সেটা নিয়েও অবাক হতে হয়। তারা যে দাবি তুলছেন, এর দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াটা হল, নওয়াজ যদি বহাল তবিয়তে থাকেন (যদিও বর্তমানে এটা খুবই অসম্ভব), তবে সেক্ষেত্রে তাদের জন্য একমাত্র যে পথটি খোলা থাকে সেটা হল, সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখল। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, তারা দুদলই যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সুনিশ্চিতভাবে অবস্থান নিয়েছে। অথচ এমন একটা পরিস্থিতিতে এ দুটি দল তাদের আন্দোলন ও তৎপরতায় এমন কিছু জিনিস ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, এমন কিছু সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন যেখানে রাজনৈতিক বাধা একমাত্র এ ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই ভাঙ্গা সম্ভব। অন্য কোনো উপায়ে নয়।
এ পরিস্থিতিতে নওয়াজ শরিফ তার দিক থেকে সুনির্দিষ্ট না হলেও উল্লেখযোগ্য মনোভাব দেখিয়েছেন। এমনকী ইমরান খান ও কাদরির এসব অবৈধ এবং অযৌক্তিক দাবির ব্যাপারেও তিনি যথেষ্ট ছাড় দেয়ার মানসিকতা দেখিয়েছেন। এতো কিছুর পর খুব দ্রুত হোক আর দেরিতে হোক, নওয়াজ তার জায়গাটা ঠিকই তৈরি করে নেবেন।
ইতিমধ্যে নওয়াজকে জানানোর জন্য তার কয়েকজন উপদেষ্টাকে বলে দেওয়া হয়েছে যে, অস্থিশীলতা সৃষ্টিকারীদের দাবিগুলোর সাথে কোনো ধরনের আপোষ রফা করলে রাষ্ট্রের স্থায়ী ক্ষতি হবে। এমনকি আন্দোলনকারীদের এসব দাবির সাথে আপোষ করার মানেই হল, রাষ্ট্রের জাতীয় নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুর ক্ষেত্রে অনির্ধারিত বা অদৃশ্য একজন উত্তরসূরীর কাছে ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া। এখন কথা হল, যদি এই আপোষের ঘটনা ঘটে, তাহলে শরিফের ক্ষেত্রে যেটা ঘটবে সেটা হল, তিনি হয়ে যাবেন নামেমাত্র একজন প্রধানমন্ত্রী। মানে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন বটে, তবে বড়জোর তার হাতে শুধু মহানগরীর মিউনিসি্প্যালিটির ক্ষমতাটুকু থাকতে পারে। এই হল একটি শাসকদলের সংকট। অর্থাৎ খুব সুনির্দিষ্টভাবে অল্পকথায় এর মানে হল, নওয়াজ শরিফকে যদি ক্ষমতায় থাকতে হয় তবে পাক আর্মি যেভাবে চায় সেভাবেই তাকে ক্ষমতায় থাকতে হবে।
তার মানে এতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান আর্মি নওয়াজ শরিফকে সুন্দর এবং যথাযথভাবেই ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছিল। এখন এই পরিস্থিতিতে একথা আরো পরিষ্কার হয়ে গেল যে, শরিফ যদি সেনাবাহিনীর অানুগত্য গ্রহণ করে, তবেই তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন। না হয় সম্ভব না। তবে চলমান রাজনৈতিক সংকট থামিয়ে দেয়ার বা আর বাড়তে না দেয়ার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা এখন পর্যন্ত তা পরিষ্কার না। অতএব যখন সবকিছুর গোড়ার ইস্যুই হল সেনাবাহিনী, তাহলে কি ইমরান খান সেনাবাহিনীর ডিক্টেট মেনে নেবে? খান যে আন্দোলন চালিয়েছে তাতে করে যখন সেনাবাহিনীর হাত কি সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠল তখন খানের জন্য কী পরিণতি হবে—যেটা পেয়ে খান তার সমর্থকদের কাছে মুখ দেখাতে পারবে? ইতিমধ্যে তো তিনি তার সমর্থকদেরকে একটি অস্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে তাদের মাঝে যথেষ্ট আবেগ-উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। বিশেষত নির্বাচনী সংস্কারের দাবি ছাড়া ইমরানের আর এমন কি আছে যেটা শরিফের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? এরপরও যদি ইমরান পিছু হটতে অস্বীকার করে, তবে কি আর্মি প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে দেবে?
এখন যদি এই রাজনীতির নাট্যমঞ্চে উল্টা খান আর কাদরিকে সাইজ করা হয়, তবে সেক্ষেত্রে আর্মির জন্য এটি হবে শরিফকে চাপে রাখার একটি শক্তিশালী অস্ত্র হাতছাড়া করা। যেটা করাটা আর্মির জন্য ভাল কিছু হবে না, বরং প্রতিকূল কিছু হয়ে যেতে পারে।
অপরদিকে শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। কারণ নব্বইয়ের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রবণতার মধ্যেই এই সমস্যার বীজ নিহিত। যেটা এখনো চলমান। এমনকি শরিফ যদি পাতানো এই টোপও গিলে ফেলেন, সেইসাথে এই মুহূর্তে ইমরান খানও পিছু হটেন তবু এই সরকার তার বাকি মেয়াদ পর্যন্ত এ সমস্যার মধ্যেই থাকবে। তবে এতে করে এই সরকার তার উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক কর্মসূচির গতিপথ থেকে কিছুটা সরে যেতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, রাজনীতির খেলাখেলির এই পর্ব যদি একটি ড্রয়ের মধ্য দিয়ে এখন শেষ হয়ে যায়, তবে এটি পরবর্তী পর্বের মঞ্চ গড়ে তুলেই শেষ হবে—যেখানে সিভিল আর সেনাবাহিনী মারাত্মকভাবে মুখোমুখি হবে। সিভিল বনাম মিলিটারির এই লড়াই শুরু হতে বেশি দেরি নাই। এর মানে, পাকিস্তানের পথে পথে গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য চূড়ান্তরকম যে ত্রাহী ত্রাহী প্রার্থনা চলছে, তার মৃত্যুর জন্য এখন শুধু শোকগাথা গাওয়া জরুরি।
*লেখাটি ১৮ আগস্ট ভারতের দিল্লি ভিত্তিক আইপিসিএস (ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ) এর নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক: সিনিয়র গবেষক, বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন
অনুবাদ: শাহাদাৎ তৈয়ব
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৪