আমরা অনেক সময়ই খেয়াল করি না, কে কার সম্পর্কে বলছি। বক্তার গ্রহণযোগ্যতার একটা ব্যাপার তো রয়েছে।
খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপি নেতা, বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের বেলায় কথাটা ভালোভাবে প্রযোজ্য। এ নিবন্ধ তৈরির সময় মিডিয়ায় আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তার কিছু বক্তব্য রয়েছে। আওয়ামী লীগারদের মতো করে বলব না, তার বক্তব্যে কোনোরকম সত্যতা বা ভেবে দেখার মতো কিচ্ছু নেই। তবে এটা বলতেই হবে, তার মুখে এসব মানাচ্ছে না। বরং বিরক্ত লাগছে।
মানানোর একটা ব্যাপার রয়েছে। জাসদ এবং এর প্রয়াত ও জীবিত নেতাদের সম্পর্কে তারেক যা বলেছেন, অনেকটা একই কথা একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে সম্প্রতি লিখেছেন একজন গবেষক। এ নিবন্ধ যেদিন লিখছি, সেদিন অপর এক দৈনিকে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জাসদের রাজনীতি নিয়ে বিরাট নিবন্ধ লিখেছেন এর একজন সাবেক কর্মী (ও সাংবাদিক)। তার বক্তব্যের সঙ্গেও তারেকের কথায় কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। তবু দেখা যাবে, লোকে এসব নিবন্ধ মনোযোগ দিয়ে পড়লেও তারেক রহমানের বক্তব্য পছন্দ করছে না।
আমি সব দল-মতের মানুষের কথা বলছি। দলনিরপেক্ষ মানুষও দেশে কিছু আছে; তাদের কথা বলছি। বিএনপির পাঁড় সমর্থকদের কথা বলছি না। তারা তারেক রহমানকে এসব বলা এবং এভাবে বলার জন্য হয়তো পছন্দই করবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনতির দায় এ সমর্থক গোষ্ঠীকেও নিতে হবে বৈকি। এ কথাটি আমরা কেন জানি বলি না।
বিএনপির প্রতিপক্ষ দলটিতেও এরা আছে। তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীনদের উচ্চ ও মধ্য স্তরের নেতারা গলা চড়িয়ে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, সেগুলো এর পাঁড় সমর্থক গোষ্ঠীর অপছন্দ হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের এক আলোচিত নেতা খুব সম্প্রতি প্রতিপক্ষের ‘পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেয়ার’ কথা বলেছেন শোকের মাসে তাদের কোনো এক কর্মসূচির প্রসঙ্গ টেনে এনে। এতে আমরা আতঙ্কিত হলেও এমন বক্তব্য পছন্দ করার মতো লোক দেশে কম নেই। এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার জন্য দলে তারা সমালোচিতও হচ্ছেন না। এটা খুব দুশ্চিন্তার বিষয়।
ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেত্রী বিদেশে বসে তারেক রহমানকে ‘লম্বা কথা’ না বলে দেশে এসে মামলা মোকাবেলার আহ্বান জানিয়েছেন। তারেকের বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। এর কিছু সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে দেয়া হয়েছিল। ওই সময়ে তারেককে জেলে যেতে হয় এবং তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চলে বলে বিভিন্নভাবে জানা যায়। পাঁড় সমর্থকদের বাইরে এজন্য তিনি সহানুভূতি লাভ করেছেন কিনা, এ প্রশ্ন নিজেকে করে দেখতে পারেন।
দলের অনেকে কিন্তু মনে করে, বিএনপির ওই পরিণতির জন্য তারেক গংই দায়ী। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীও দায় এড়াতে পারবেন না, যেহেতু পুত্রকে সামলে রাখতে পারতেন একমাত্র তিনি। এখনও তিনি তারেক রহমানকে সামলাচ্ছেন না বলে রাজনীতিসচেতন মানুষ বলে থাকেন। ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনা থেকে তাদের কেউ কোনো শিক্ষা নেননি বলেও কথা চালু আছে।
আগস্ট তো শোকের মাসই। ১৫ ও ২১ আগস্ট আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে বড় শোকের দিন। ১৫ আগস্টের মতো ২১ আগস্টের ঘটনাও এখন বহুলভাবে আলোচিত। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে তার দলের সিনিয়র নেতাসহ মেরে ফেলার একটা ভয়াবহ চেষ্টা হয় সেদিন। আর সেটা ঘটে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে এবং তাতে বেশ কিছু লোক হতাহত হন। এ অবস্থায় ঠিক আগস্ট মাসে লন্ডনে বসে লাগামহীন কথাবার্তা বললে তা বিএনপির রাজনীতির পক্ষে যাবে কিনা, তারেক রহমানের সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়ারও এটা ভেবে দেখা দরকার।
২১ আগস্টের ঘটনায় তো তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও উঠেছে। হতে পারে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এতে জড়ানো হয়েছে তাকে। কিন্তু দেশের এক বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ইমেজ তিনি নিজে সৃষ্টি করেছেন, তাতে অভিযোগটাকে হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তারেক ওটায় সরাসরি জড়িত না থাকলেও তৎকালীন সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশের সংশ্লিষ্টতা বা ইন্ধন যে ছিল, সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয় তাদের ওই সময়কার কার্যকলাপে। নিকট অতীতের ঘটনা হওয়ায় ওসব কেউ ভুলে গিয়েছে বলে মনে হয় না।
যে প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসুক না কেন, তারা এখন দেশটা চালাচ্ছেন। বিএনপির দুর্বলতাসহ নানা কারণে কম দাপটের সঙ্গে তারা দেশ পরিচালনা করছেন না। বিএনপির বোদ্ধারা কিন্তু মনে করছেন, তারেক রহমানের সামনে আরও ঝুঁকি রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তীকালে (সাবেক সেনাপ্রধানের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও) যারা তারেককে কোনোভাবে রেহাই দেননি, তারাও চাইবেন না তিনি রাজনীতিতে স্বরূপে ফিরে আসুন। কে জানে, সে কারণেও তারেক হয়তো অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছেন।
১৫ আগস্টে মর্মান্তিকভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও বলিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন, এটা খালেদা জিয়া না পারলেও অন্য উপদেষ্টারা যেন তারেককে বোঝান। শুধু পাঁড় সমর্থক গোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে বক্তব্য দিলে তো চলবে না। এদিকে ভিন্নভাবে তার জন্মদিন পালনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারছেন না খালেদা জিয়া। যে ধরনের দল এরা গড়ে তুলেছেন, তাতে ওই দলভুক্ত কেউ এসব পরামর্শ তাদের দেবেন না। আত্মপোলব্ধি থাকলে সেটাই কেবল তাদের পথ দেখাবে। সেটি না ঘটলে হতাশাও বিএনপি নেতৃত্বকে গ্রাস করবে হয়তো। সম্প্রতি একটি দলীয় সভায় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিত থাকার খবর অনেককে কৌতূহলী করে তুলেছে।
দলটির নেতারা মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে হয়রান হচ্ছেন, এটা কোনো গোপন বিষয় নয়। নির্বাচন বর্জন করায় তারা এখন সংসদেও নেই। রাজনৈতিক জোট নিয়ে মোটেও স্বস্তিতে নেই বিএনপি। প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামী বিষয়েও তার অস্বস্তি প্রবল। সরকার তাকে জামায়াত থেকে দূরে এবং পারলে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না। সবচেয়ে বড় কথা, পরপর দুই মেয়াদে বিরোধী অবস্থানে থেকে সরকারের চাপ ও তাপ মোকাবেলা খুব কঠিন হবে বিএনপির পক্ষে। লন্ডনে বসে তারেক রহমান এসব উপলব্ধি করতে পারছেন বলে তার কথাবার্তায় মনে হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু কোন পরিস্থিতিতে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন, সে বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষকদের বলতে দিন। যত দিন যাবে, এসব নিয়ে একাডেমিক আলোচনা বাড়বে বৈকি। এখন কারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে আছেন, সেটাও দেশের মানুষ তারেক রহমানের মুখে শুনতে চায় না। তার বলার ধরন আর ভাষাও যথাযথ নয়। কোনো সন্দেহ নেই, প্রতিপক্ষও আপত্তিকরভাবে কথা বলে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। কিন্তু তারেক একাই যেন সেটা মোকাবেলা করতে চাইছেন আর ভাবছেন, এটা তিনি পারবেন। এর বদলে তিনি এমন কিছু করার কথা ভাবুন, যাতে তার ইমেজ বদলায় এবং দলে তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠা কমে।
খালেদা জিয়ার দুই পুত্রই বিদেশে অবস্থান করছেন এবং তাদের একজন ইতোমধ্যে আদালতে দণ্ডিত। রাজনীতিতে নতুনভাবে অবস্থান করে নিতে চাইলে তাদের কিন্তু দেশে ফিরে আসতে সচেষ্ট হতে হবে। খালেদা জিয়াও তাদের বিষয়ে এমন কিছু ভাবছেন বলে মনে হয় না। আর তারেক রহমানের বক্তব্য শুনে মনে হয়, দেশে একটা গণঅভ্যুত্থানের অপেক্ষায় আছেন তিনি। সেটি যেন ঘটবে আপনাআপনি এবং এর পিঠে চড়ে তিনি বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরবেন। আর পুরনো ধারাতেই চলবে সব কিছু। কারণ নিজ শাসনামলে তারা তো অন্যায় বা ভুল কিছু করেননি! এ থেকে ভিন্ন কানাকড়ি উপলব্ধি থাকলেও কথাবার্তায় তার প্রতিফলন মিলত।
বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মীর জন্য এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি যে, সংসদ নির্বাচনে জিতে যাওয়ার মতো অবস্থা থাকা সত্ত্বেও তারা এখন কোনঠাসা অবস্থানে। দু’পক্ষে অনেক রক্ত ঝরলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের আন্দোলনটাও জামায়াতের নিজস্ব লড়াইয়ের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। খালেদা-তারেকসহ বিএনপি নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের হারানো আবেগ ফিরে এসেছে প্রবলভাবে। ধর্মীয় মৌলবাদও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে একসঙ্গে। বিএনপির মতো ‘মডারেট’ দল এখন দ্বিতীয়টার সঙ্গে একাত্ম বলে পরিচিত হতে চায় কিনা, সেটাও ঠিক করতে হবে তাদের। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিও মাথায় রাখতে হবে। তারেক রহমান তো নয়ই, খালেদা জিয়ারও এসব ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
‘লম্বা কথা’ বলে আসলেই লাভ নেই। সরকার যেনতেনভাবে একটা নির্বাচন সেরে ফেলে এখন বলছে, মেয়াদ শেষেই নির্বাচন হবে। ততদিন অপেক্ষা করতে হবে বিএনপিকে। এতটা সময় তারা রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন কিনা, তার আগে নিজেদের কারণেই ডুববেন কিনা—এসব প্রশ্ন বোদ্ধাদের মধ্যে রয়েছে অবশ্য। এদিকে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মী ভাবছেন, এ সরকার পাঁচ বছর বহাল থাকলে এতদিন টিকে থাকব কীভাবে? নীতিহীনভাবে দলবল জোগাড় করে সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে বলে ঘৃণা প্রকাশ করলেই তার ভিত্তি কিন্তু নড়বড়ে হয়ে যাবে না।
খালেদা জিয়া কিছুদিন আগে বলেছিলেন, সরকারকে ‘পচতে’ দেবেন তিনি। সেটাই দিন তাহলে। একাত্তর, পঁচাত্তর আর বঙ্গবন্ধু নিয়ে লন্ডন থেকে নতুন বা পুরনো তত্ত্বকথা প্রচারেরও দরকার নেই। তারেক রহমানের মুখে এসব শুনতে ভালো লাগছে না, যদিও কথাগুলো একদম ফেলে দেয়ার মতো নয়। এগুলো তারা বলুন, যাদের কোনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে হয় না।
আমাদের রাজনীতি ক্লেদাক্ত বটে। বিএনপি, বিশেষত খালেদা-তারেক নেতৃত্বও এতে কম অবদান রাখেনি। তাদের কৃতকর্মই মূলত একটা অদৃষ্টপূর্ব পরিবর্তন অনিবার্য করে তুলেছিল দেশে। তারা আবার বলছেন, ওটারই ‘এক্সটেনশন’ চলছে এখন। তাহলে তো আরও সতর্কভাবে কথাবার্তা বলে পথ চলতে হবে বিএনপি নেতৃত্বকে। আমাদের দেশে ব্যর্থ নেতৃত্বে বদল আনার সংস্কৃতি প্রবর্তিত হয়নি। সহসা হবে বলেও মনে হচ্ছে না। সে সুবাদে এত কিছুর পরও দলে যারা টিকে থাকছেন, তাদের নতুন করে ভাবা অন্তত দরকার। তারেক রহমানের মধ্যে এটা একেবারেই দেখতে পাচ্ছি না। খালেদা জিয়াও কি বোধ করছেন না এর প্রয়োজনীয়তা?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৪