১.
মোবারক সাহেব একটা শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বে আছেন। অনেকদিন পর আজকে তার ভিতরে এক ধরনের আত্মতৃপ্তির বোধ কাজ করছে।
তার বোর্ডে পাসের হার অন্য বোর্ড থেকে কম। তাতে অবশ্যি অবাক হবার কিছু নেই, ফলাফল প্রকাশ করার আগেই তিনি সেটা জানতেন। এখানে অনেক গরিব মানুষ, বাবা-মা লেখাপড়া জানেন না, লেখাপড়ার গুরুত্ব বোঝেন না। মাঝখানে বন্যায় বই পত্রসহ সবকিছু ভেসে গেল। হরতালে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। ইংরেজি প্রশ্নটাও মনে হয় একটু বেশি কঠিন হয়েছিল, সব কিছু মিলিয়ে পাসের হার একটু কম হতেই পারে। আস্তে আস্তে পাসের হার বাড়বে, দেশ এগিয়ে যাবে। দেশের এতো বড় একটা কাজে সাহায্য করার সুযোগ পেয়েছেন তাতেই মোবারক সাহেব খুশি।
কয়েকদিন পর মোবারক সাহেবকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডেকে পাঠানো হল। কি জন্যে ডাকা হয়েছে সেটা অনুমান করতে পারছেন, তারপরেও তার ভেতরটা কেন জানি খচখচ করতে লাগল। সারারাত জার্নি করে সকালে ঢাকা পৌঁছেছেন। ঢাকায় ছোট শ্যালিকার বাসায় উঠেছেন। সবাই তার খুব যত্ন করল, তবুও তার ভেতরে কেমন যেন অশান্তি খচখচ করতে লাগল। মন্ত্রণালয়ে আগে সবাই তাকে খুব সমাদর করতেন, এবারে কেমন যেন সবাই দূরে দূরে থাকলেন।
তাকে অনেকজন অপেক্ষা করতে হল। শেষে একজন তাকে ডেকে পাঠালেন। বয়স মোবারক সাহেবের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু এই সরকার আসার পর প্রমোশনের পর প্রমোশন পেয়ে ধাই ধাই করে ওপরে উঠে গেছেন।
মোবারক সাহেব বসায় আগেই মানুষটি খেকিয়ে উঠলেন, “আপনি এইটা কী করেছেন?”
মোবারক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “কী করেছি?”
“আপনার বোর্ডে সব ছাত্রদেরকে ফেল করিয়ে রেখেছেন, ব্যাপারটা কী? ছাত্র-ছাত্রীরা কী ফেল করার জন্য লেখাপড়া করতে আসে? পেয়েছেন কী আপনি?”
মোবারক সাহেব এতো অবাক হলেন যে অপমানিত বোধ করার সময় পেলেন না। সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন। একটা ছাত্র কখন পাস করে, কখন ফেল করে সেটা তার চেয়ে ভালো করে কেউ জানে না। একজন ছাত্রকে শিক্ষক কখনো পাস করান না, কখনো ফেলও করান না। ছাত্র নিজে পাস করে, না হয় ফেল করে।
মোবারক সাহেবকে সামনে বসে থাকা কমবয়সী উদ্ধত বড় কর্তা রীতিমতো হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “আপনার এতো বড় সাহস, আপনি এই সরকারকে অপদস্ত করার চেষ্টা করছেন? আপনি দেখানোর চেষ্টা করছেন, এই সরকারের আমলে লেখাপড়া হয় না। অন্য সব বোর্ডে পাসের হার বেড়ে যাচ্ছে, আর আপনি আপনার বোর্ডে সবাইকে ফেল করিয়ে দিচ্ছেন? আপনি জানেন না, এই সরকার শতভাগ পাস করানোর টার্গেট নিয়েছে? আপনার মতো মানুষের কারণে আমাদের মুখে চুন-কালি পড়ছে? নিশ্চয়ই আপনি রাজাকারদের দলে-”
মোবারক সাহেব থ’ হয়ে বসে রইলেন, একটা কথাও বলতে পারলেন না। মাথা নিচু করে অফিস থেকে বের হয়ে এলেন।
বাসায় ফিরে আসার পর মোবারক সাহেবের স্ত্রী তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? তোমার এ কী চেহারা হয়েছে?”
মোবরক সাহেব বললেন, “আমি চাকরি ছেড়ে দেবো। ”
মোবারক সাহেবের স্ত্রী চমকে উঠে বললেন, কেন?”
“আমাকে বলেছে সবাইকে পাস করাতে হবে। বলেছে, কেউ ফেল করার জন্য পরীক্ষা দেয় না, পাস করার জন্য পরীক্ষা দেয়। পাস না করলে দোষ আমার। ”
মোবারক সাহেবের স্ত্রী বুঝতে না পেরে বললেন, “কিন্তু এই লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়েকে তুমি কেমন করে ঠিক করে লেখাপড়া করাবে।
মোবারক সাহেব মাথা নাড়লেন। বললেন, “না, না, লেখাপড়া করে পাস করানোর কথা বলেনি। ”
“তাহলে?”
বলেছে, খাতায় একটু আঁকি-বুকি করলেই মার্ক দিতে হবে। পাস করাতে হবে। যতো বেশি পাস, সরকারের ততো বেশি ক্রেডিট। ততো বেশি সোনার বাংলা। ”
মোবারক সাহেবের স্ত্রী তবুও বুঝতে পারলেন না। বললেন, “কিন্তু”
“এর মাঝে কোনো কিন্তু নাই। একজন মাস্টার হয়ে আমি এটা করতে পারবো না। হাঁটুর বয়সী ছেলে বড় অফিসার হয়ে আমাকে ধমকা ধমকি করে, আমার পক্ষে এই অপমান সহ্য করা সম্ভব না। ’’
মোবারক সাহেবের স্ত্রী তার স্বামীক ভালো করে চেনেন। একবার মাথায় ঢুকে গেলে আসলেই চাকরি ছেড়ে ছুড়ে দিতে পারেন। স্বামীর গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, “প্লিজ তুমি মাথা গরম করো না। চাকরি ছেড়ে দিলে আমরা খাব কী? থাকবো কোথায়, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার কী হবে? তুমি যেহেতু চাকরি করছো, উপরের নির্দেশ তো মানতে হবে। ”
মোবারক সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, “উপরের নির্দেশ লিখিত দেয়ার সাহস নাই। শুধু মুখে বলে। আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি চাকরি ছেড়ে দেবো। ”
২.
মোবারক সাহেব অবশ্যি শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়লেন না, ছাড়া সম্ভব না। তাই তার সব সহকর্মীদের ডেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের কথা জানালেন। বললেন, ছেলে-মেয়েরা ফেল করার জন্যে লেখাপড়া করে না, পাস করার জন্যে লেখাপড়া করে। ছেলে-মেয়েরা যেহেতু পাস করার জন্যে লেখাপড়া করে, তাই কেউ যদি নিজে থেকে পাস করতে না পারে, তাহলে তাকে পাস করিয়ে দিতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্ব। তার সরকারি কর্মচারী তাদের দায়িত্ব সরকারের ইচ্ছা পূরণ করা। মোবারক সাহেবের কর্মীরা বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। তারা পুরো ব্যাপারটা বুঝে গেলেন, তারপর কাজ শুরু করে দিলেন। পরীক্ষার সাথে যুক্ত সবাইকে নিয়ে মিটিংয়ের পর মিটিং করতে লাগলেন। ডিসিদের সাথে কথা বললেন, স্কুলের হেডমাস্টারদের ডেকে পাঠালেন, পরীক্ষকদের ডেকে পাঠালেন।
মোটামুটি কোনো ঝামেলা ছাড়াই সবাইকে সরকারের ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেয়া হল। ছাত্র-ছাত্রীরা যেহেতু পাস করার জন্যে লেখাপড়া করতে এসেছে, তাই তাদের পাস করার ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে।
শুধু একটা মিটিংয়ে খিটখিটে বুড়ো মতো একজন মানুষ ঝামেলা শুরু করলেন। তেড়িয়া হয়ে বললেন, “আমি ঠিক বুঝবার পারলাম না। পোলাপান পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখলেও তাগো পাস করাইতে হবে?”
যিনি মিটিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “কিছু না লিখা মানে কী? পরীক্ষায় খাতায় সবাই কিছু না কিছু লিখে। ”
“উল্টা-পাল্টা ছাতা মাতা যাই লিখে, তাতেই নম্বর?”
“এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা। সৃজনশীল মানে বোঝেন তো? নিজের মতো করে লেখা একটু ভুল ত্রুটি তো হতেই পারে, দোষ তো ছেলে-মেয়েদের না। দোষ সিস্টেমের, ছেলে-মেয়েদের ভিক্টিমাইজ করে লাভ কী? তাই বলছি উদারভাবে মার্ক দেবেন। বুঝেছেন?”
খিটখিটে বুড়ো বললেন, “না, বুঝি নাই। পাস মার্ক না পাইলে আমি পাস করাবার পারুম না। ”
মিটিংয়ের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি এবার রেগে উঠলেন, বললেন, “আপনি কি চান আপনাকে পরীক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেই? সরকারের একটা শুভ উদ্যোগকে এরকম নেগেটিভভাবে দেখছেন কেন?”
খিটখিটে বুড়ো টেবিল থেকে তার ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। মিটিংয়ের পরিচালক আরো রেগে উঠলেন। বললেন, কী হল? আপনি কই যান?”
“আমি মাস্টার মানুষ। নিজের হাত ছেলে-মেয়েদের সর্বনাশ করবার পারমু না। আপনারা করেন। আল্লাহ্ যেন আপনাদের মাপ কইরে দেয়। ”
খিটখিটে বুড়োটা চলে যাবার পর মিটিংয়ের পরিচালক মেঘ স্বরে বললেন, ‘‘কে? কে এই বেয়াদব মানুষটা? কতো বড় বেয়াদব। ”
একজন বলল, “মডেল স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। ”
“কী রকম শিক্ষক?”
“খুব ভালো। তবে ঘাড় ত্যাড়া, প্রাইভেট পড়ালে লাখ টাকা কামাতে পারে, পড়ায় না। তাই নিয়ে বউয়ের সাথে রাত দিন ঝগড়া। সংসারে অশান্তি-”
“কতো বড় সাহস। আমাকে জ্ঞান দেয়। নিশ্চয়ই রাজাকার।
“জ্বে না। মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ”
“এই রকম মুক্তিযোদ্ধা আমার অনেক দেখা যাচ্ছে। ”
মিটিংয়ের পরিচালক গজ গজ করতে লাগলেন।
তবে “ঘাড় ত্যাড়া” শিক্ষক খুব বেশি পাওয়া গেল না, বিষয়টা নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও প্রায় সবাই এই নতুন পদ্ধতি মেনে নিলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের যেভাবে সম্ভব পাস করাতে হবে।
৩.
সবুজ মুখে সিগারেটটা চেপে রেখে তার চুলে জেল দিচ্ছিল। তখন তার মা ঘরে এসে ঢুকলেন। মা’কে দেখে সবুজ তাড়াতাড়ি তার সিগারেটটা হাত দিয়ে ধরে পিছনে লুকিয়ে ফেলল। মা দেখেও না দেখার ভান করলেন। বললেন, “বাবা, তোর পরীক্ষা তো এসে গেল। একটু বই নিয়ে বসবি না?”
সবুজ উদাস মুখে বলল, “নাহ্ আম্মু। ঠিক করেছি, এই বছর পরীক্ষা দেবো না। ”
“কেন? পরীক্ষা দিবি না কেন?
সবুজ বিরক্ত হয়ে বলল, “পরীক্ষা দিতে হলে লেখা-পড়া করতে হয়। আমি কোনো লেখাপড়া করি নাই। ইন্টারের সিলেবাস কতো বড়, তুমি জানো?”
মা ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “তোর বাবা শুনলে খুব রাগ করবে। ”
সবুজ আরো বিরক্ত হয়ে বলল, “বাবার শোনার দরকার কী? থাকে সউদি আরবে, মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে তার দায়িত্ব শেষ। আমি পরীক্ষা দিলাম,ে কি না দিলাম তাতে বাবার কী আসে যায়?”
মা আরেকটু কাছে এসে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, “প্লিজ বাবা, প্লিজ! পরীক্ষাটা দে। ”
সবুজ মায়ের হাত সরিয়ে বলল, আহ্ মা! তুমি বড় বিরক্ত কর। যাও দেখি। ”
মা কাতর গলায় বললেন, “বাবা, আমি তো বলি নাই, তোর পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন ফাইভ পেতে হবে। শুধু বলেছি, পরীক্ষাটা দে। ”
“পরীক্ষা দিলে ফেল করবো। ”
“তবু পরীক্ষাটা দে। ”
“আমার কোনো বইপত্র পর্যন্ত নাই। কোনো কোচিং করি নাই। ”
“তোকে সব বই কিনে দেবো। ”
“কিন্তু খাতায় আমি কী লিখব? আউল ফাউল জিনিস?”
“যা ইচ্ছে তাই লিখবি বাবা। তবু পরীক্ষাটা দে। তোর বাবাকে বলতে পারবো, তুই পরীক্ষা দিয়েছিস। রেজাল্ট খারাপ হলে কিছু একটা বলা যাবে। ”
শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে সবুজ পরীক্ষা দিতে রাজি হল। তবে এক শর্তে সে কোনো লেখাপড়া করতে পারবে না।
৪.
রনি রাত নয়টার সময় বাসায় ফিরে এল, তখন তার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নাই। প্রথমে কোচিং, তারপর গণিত স্যারের কাছে প্রাইভেট, তারপর ফিজিক্স স্যারের কাছে ব্যাচে পড়া। বাসায় ফিরে আসতে প্রত্যেকদিনই দেরি হয়। স্যার সাজেশন দিয়েছেন, আজকে রাত জেগে মুখস্ত করতে হবে, চিন্তা করেই রনির মনটা খারাপ হয়ে গেল।
মা রনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আয় বাবা হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়। মুখটা শুকিয়ে দেখি এতোটুকু হয়ে গেছে। ”
রনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার ইচ্ছা ছিল বাংলা কিংবা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার। সেটা যদি না হয় তাহলে সাংবাদিকতা পড়া। ঘাড়ে ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিক হয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে, সব সময়েই সে এরকম একটা স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু রনির বাবা-মা তার স্বপ্নের কোনো দাম দেননি। জোর করে তাকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়িয়েছেন। তাকে জোর করে ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। বাধ্য হয়ে সে গণিত পড়ছে, ফিজিক্স পড়ছে, কেমেস্ট্রি পড়ছে। বুঝতে খুব কষ্ট হয়, তাই সে সবকিছু মুখস্ত করে ফেলার চেষ্টা করে। মুখস্ত করতে কী কষ্ট! রাতের বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন সে একা একা বই মুখস্ত করে। মনে মনে ভাবে, তাদের জীবনটা এতো কষ্টের কেমন করে হল?
খাবার টেবিলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “রনি, তোমার পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে?”
রনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সত্যি কথাটাই বলল, “ভালো না আব্বু। ”
বাবা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন ভালো না?”
“আমার সায়েন্স বুঝতে কষ্ট হয়। তাই না বুঝে সবকিছু মুখস্ত করতে হয়। ”
“লেখাপড়া করলে তো একটু আধটু মুখস্ত করতেই হয়। ”
“একটু আধটু নয় আব্বু, পুরো বই মুখস্ত করতে হয়। আমার সায়েন্স নেওয়াটা ভুল হয়েছে। তোমরা জোর করে সায়েন্সে ঢুকিয়ে দিলে। ”
মা রনির প্লেটে মুরগির একটা রান তুলে দিয়ে বললেন, “কোনো চিন্তা করিস না বাবা, দেখিস তোর পরীক্ষা খুব ভালো হবে। নির্ঘাত গোল্ডেন ফাইভও। ”
রনি দুর্বল ভাবে হাসল। বলল, “গোল্ডেন ফাইভ না আরো কিছু। শুধু কোনোভাবে টেনে টুনে পাস করলেই আমি খুশি।
৫.
প্রিয়াঙ্কা পড়ার টেবিলে বসে তার বইটির দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সত্যিকার অর্থে কিছু সে কিছু দেখছিল না। পাশে তার মা হাতে কয়েকটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রিয়াংকাকে বললেন, “মা। একবার দেখ। ”
প্রিয়াংকা কঠিন গলায় বলল, না। দেখবো না। ”
“দেখ মা। সবাই দেখছে তুই কেন দেখবি না?”
“না মা। তুমি আমাকে দেখতে বলো না। আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দেবো না। ”
মা বললেন, “সবার পরীক্ষা ভালো হবে, গোল্ডেন ফাইভ পাবে, শুধু তুই পাবি না। তখন তুই মন খারাপ করবি। ”
“করলে করবো। কিন্তু আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখবো না, দেখবো না, দেখবো না। আমাকে তুমি অন্যায় কাজ করতে বলো না। ”
“এটা তো অন্যায় না, মা। সবাই যেটা করে, সেটা অন্যায় হবে কেমন করে? এটাই তো নিয়ম। ”
“আমি এই নিয়ম মানি না। ”
প্রিয়াংকা দুই হাত দিয়ে তার চোখ বন্ধ করে টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ল। মা দেখলেন, তার দুই হাতের ফাঁক দিয়ে চোখের পানি ফোটা ফোটা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
পৃথিবীর সব ছেলে-মেয়ে একরকম, কিন্তু তার মেয়েটি কেন অন্যরকম হয়ে জন্ম নিল? মা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো হাতে নিয়ে নিঃশব্দে দাড়িয়ে রইলেন।
৬.
পরীক্ষার হলে সবুজ প্রথম এক দুইদিন প্রশ্নটা একটু পড়ার চেষ্টা করলেও শেষের দিকে সেটাও ছেড়ে দিল, প্রশ্ন পড়ে সে আগা-মাথা কিছুই বোঝে না, তাহলে শুধু শুধু পড়ে কী লাভ? শুধু মা’কে খুশি করার জন্য যে পরীক্ষা দিতে এসেছে। তাই পরীক্ষার খাতায় সে যা মনে আসে তাই লিখে এল। কোনো মাথা-মুণ্ডু নেই, সেই রকম অবান্তর কথা। পরীক্ষার প্রশ্নে যে শব্দগুলো আছে সেসব শব্দ দিয়ে তৈরি একটা দুইটা বাক্য, কখনো আস্ত প্যারাগ্রাফ। যিনি পরীক্ষায় খাতা দেখবেন, তার কাছে যেন মনে হয়, আসলেই বুঝি পরীক্ষার উত্তর লিখছে। এক ধরনের তামাশা বলা যায়।
রনির পরীক্ষা যতোটা খারাপ হবে বলে ভেবেছিল, ততোটা খারাপ হল না। প্রশ্নগুলো ফাঁস হয়েছিল বলে রক্ষা। কিন্তু তবুও খুব লাভ হয়নি। ফাঁস হয়ে পাওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর সে প্রাণপণে মুখস্ত করে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এতো কিছু তার মনে থাকে না। তবুও সে লিখে এসেছে। হিসেব করে দেখছে, টেনে টুনে জিপিএ ফোর হয়ে যাবে। তার জন্য জিপিএ ফোরই অনেক।
প্রিয়াংকার জন্য পরীক্ষাগুলো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। সে ভালো স্কুলে পড়ে, তার ক্লাসের সবাই ভালো ছাত্রী। সবাই ফাঁস হয়ে আসা প্রশ্নগুলো দেখে এসেছে। প্রশ্নটা হাতে পেয়েই সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠেছে, শুধু সে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। সবাই যখন টানা মুখস্ত লিখে যাচ্ছে সে তখন চিন্তা করে করে লিখেছে। মনটা ভালো নেই, ভেতরে উৎসাহ নেই। তা না হলে পরীক্ষা আরো ভালো হত। পরীক্ষার উত্তর দিতে দিতে মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে, পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আসে। নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করে সে দাঁতে দাঁত চেপে পরীক্ষা দিচ্ছে।
প্রশ্নটা হাতে নিয়ে তার চোখে পানি এসে যায়, এতো বড় একটা অন্যায়। কিন্তু দেশে কোনো প্রতিবাদ নেই। মন্ত্রী বলছেন, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, এগুলো সাজেশান। সাজেশান? প্রিয়াংকার ইচ্ছা করে টেবিলে মাথা কুটে রক্ত বের করে ফেলে। খোদা তাকে কেন এমন একটা দেশে জন্ম দিল? কেন?
৭.
পরীক্ষার ফল বের হয়েছে, সবার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা। শুধু সবুজের পরীক্ষা নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা নেই, তার নিজের ফলাফল জানারও কোনো আগ্রহ নেই। সৌদি আরবে বাবাকে কিছু একটা জানাতে হবে। পরীক্ষার আগে ডেঙ্গু হয়ে গিয়েছিল তাই ভালো করে পরীক্ষা দিতে পারেনি, এরকম একটা গল্প বলা যাবে।
দুপুরের দিকে সবুজের একজন বন্ধু তাকে ফোন করে জানাল, সবুজ নিশ্চয়ই পরীক্ষায় পাস করেছে, কারণ তার কলেজে শত ভাগ পাস! তার এই বন্ধু একটু ঠাট্টা-তামাশা বেশি করে। তাই ইয়ার্কি করছে ভেবে সবুজ ফোন রেখে দিলেও তার ভেতরটা খচ খচ করতে লাগল। সে সাহস করে মোবাইলে খোঁজ নিয়ে দেখে, সে সত্যিই পাস করে ফেলেছে। জিপিএ খুবই খারাপ, কিন্তু পাস! সবুজ একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল এবং সেই চিৎকার শুনে মা ভয় পেয়ে ছুটে এলেন।
সবুজ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আম্মু আমি পাস করেছি। ”
মায়ের মুখ একশ’ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি জানতাম তুই পাস করবি! তোর মতো ছেলে কয়টা আছে, একেবারে না পড়ে পরীক্ষা দিয়ে তুই পাস করে ফেলেছিস। একটু যদি পড়তি, তাহলে কী হতো চিন্তা করতে পারিস?”
সবুজ আসলেই চিন্তা করতে পারে না। সে কেমন করে পাস করেছে, সেটাও বুঝতে পারে না। নিশ্চয়ই পরীক্ষার খাতায় সে যেগুলো লিখেছিল, সেগুলো খুবই সৃজনশীল লেখা ছিল। সে জন্যেই তাকে পাস করিয়ে দিয়েছে।
মা ছেলের হাতে সৌদি আরবে থাকা বাবার পাঠানো টাকা থেকে এক হাজার টাকা বের করে দিয়ে বললেন, ‘‘যা বাবা মিষ্টি কিনে আনে। ”
সবুজ মিষ্টি কিনতে গিয়ে দেখে, সব মিষ্টি বিক্রি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কিছু নিমকি কিনে আনল। পাস করলে শুধু মিষ্টিই খেতে হবে, কে বলেছে? মাঝে মাঝে নোনতা জিনিসও খাওয়া যায়।
৮.
রনি গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে। আব্বু-আম্মু খুব খুশি। কিন্তু রনি নিজে হিসাব মিলাতে পারছে না। সে অনেকবার হিসেব করে দেখেছে, সেখানে কিছুতেই জিপিএ ফাইভ হওয়ার কথা না। কিন্তু হয়ে গেছে, সে নিজের চোখে দেখেছে।
বাবা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “দেখেছিস? আমি বলেছিলাম না, তুই পারবি! এই দেখ, তুই পেরেছিস। ”
আম্মু বললেন, “মানত করেছিলাম, পাগলা বাবার মাজারে এক হাজার টাকা দেবো। এক্ষুণি টাকাটা পাঠাতে হবে। ”
শুধু ছোট বোনটা ঠোঁট উল্টে বলল, “গোল্ডেন ফাইভ এমন কী ব্যাপার, সবাই পায়!”
আম্মু ধমক দিয়ে বললেন, ‘‘চুপ কর পাজী মেয়ে। তুই এমন হিংসুটে হলি কেমন করে?”
রাতে ঘুমানোর সময় রনির মনে হতে লাগল, আসলে এতোদিন সে নিজের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখেছে। সে আসলে অসম্ভব প্রতিভাবান। বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবীদের একজন। এখন ইচ্ছা করলে সে বাংলাদেশের যেকোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারবে। সে ইচ্ছা করলে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে, না হলে ডাক্তার হতে পারবে। বিশাল একটা ইঞ্জিনিয়ার না হয়, বড় একজন ডাক্তার হয়ে সে তার মতো আরেকজন মেধাবী মেয়েকে বিয়ে করবে! ফুটফুটে চেহারার সুন্দরী একটা মেয়ে।
রনি বিছানায় এ পাশ ও পাশ করে, আনন্দে চোখে ঘুম আসতে চায় না।
৯.
প্রিয়াংকার গোল্ডেন ফাইভ হয়নি। ফিজিক্সে একটুর জন্যে ছুটে গেছে। তার ক্লাসের সব মেয়ের গোল্ডেন ফাইভ হয়েছে। হাবাগোবা যে মেয়েটা কিছু পারে না, যে সব সময় প্রিয়াংকার কাছে পড়া বুঝতে আসতো, সেও গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে। শুধু সে পায়নি। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন না দেখলে এরকম তো হতেই পারে। প্রশ্ন তো যথেষ্ট কঠিন হয়েছিল। এই প্রশ্নে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ তোলা তো সোজা কথা নয়।
প্রিয়াংকা স্কুলের সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। অন্যরা সবাই চেচামেচি করছে। হঠাৎ করে দরজা খুলে টেলিভিশন ক্যামেরা হাতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এসে ঢুকলেন। একজন ক্যামেরা তাদের দিকে তাক করে বললেন, “তোমরা কী খুশি?”
সবাই চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ, খুশি”।
তাহলে আনন্দ করছ না কেন?”
সবগুলো মেয়ে তখন আনন্দে চিৎকার করতে লাগল একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরতে লাগল, লাফাতে লাগল নাচতে লাগল।
শুধু প্রিয়াংকা একা চুপচাপ সিড়িতে বসে রইল।
১০.
সবুজ একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। এই ইউনিভার্সিটি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় মাঝে মাঝেই লেখালেখি হয়। কাউকে লেখাপড়া করতে হয় না, ক্লাসে যেতে হয় না, প্রতি সেমিস্টারে গ্রেড চলে আসে। কয়েক বছর নিয়মিত টাকা দিয়ে গেলেই সার্টিফিকেট। সবুজ একটা বিবিএ’র সার্টিফিকেট নিয়ে নেবে।
রনি যতোগুলো সম্ভব সবগুলো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে, কোথাও টিকতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কী, কোথাও পাস করতে পারেনি। প্রথম দিকে বাবা-মা উৎসাহ আর সাহস দিয়েছেন। শেষের দিকে তারা প্রথমে হতাশ, তারপর বিরক্ত এবং শেষে কেমন যেন ক্ষেপে উঠলেন।
একদিন খাবার টেবিলে বাবা বলেই বসলেন, “তুই কী রকম ছাত্র? ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়া তো দূরের কথা, কোথাও পাস পর্যন্ত করতে পারিস না!”
রনি দুর্বল গলায় বলল, “আমি তো চেষ্টা করছি। ”
“এই চেষ্টায় নমুনা?” বাবা হুঙ্কার দিলেন, “এই গোল্ডেন ফাইভ? এর জন্য আমি মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে তোদের জন্য পরিশ্রম করি? সামান্য একটা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাস না?”
রনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমি কী করবো?”
“দূর হয়ে যা, আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। ”
রনি খাবার টেবিল থেকে উঠে গেল। রাতের বেলা বাথরুমে রাখা এক বোতল হারপিক খেয়ে ফেলল। মাঝরাতে হাসপাতালে দৌঁড়াদৌঁড়ি। জানে বেঁচে গেল, কিন্তু ভেতরটা ঝলসে গিয়ে খুব খারাপ অবস্থা।
প্রিয়াংকা খুব শক্ত মেয়ে ছিল। কিন্তু এক সময় সেও ভেসে পড়ল। একদিন হাউমাউ করে কেঁদে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দাও, এই দেশে আমি আর থাকতে পারছি না। ”
মা অবাক হয়ে বললেন, “সে কী? তুই না তোর দেশকে এতো ভালোবাসিস। সব সময় বলেছিস, দেশের জন্য কিছু একটা করবি?”
“হ্যাঁ মা বলেছিলাম। ”
“তোর না দেশ নিয়ে এতো স্বপ্ন ছিল?”
“ছিল মা। এখন আর কোনো স্বপ্ন নাই। ’’
মা অবাক হয়ে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েটির চোখে এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই?
১১.
গল্পটা এখানেই শেষ। এটা কাল্পনিক গল্প, নামগুলো বানানো, কিন্তু ঘটনাগুলো সত্যি। প্রিয়াংকার ই-মেইলটা আমার কাছে আছে। যাদের দায়িত্বে এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, তারা কী জানেন এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এখন কী ভয়ঙ্কর অবস্থা! শতভাগ পাস করিয়ে দেওয়ার এই মহা পরিকল্পনায় সবচেয়ে এগিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা, তারা ৯৫ শতাংশ পাস করেছে। ৯৫ শতাংশ? আমাকে চোখ কচলে দুইবার দেখতে হয়েছে বিশ্বাস করার জন্যে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নিজে এই সংখ্যাটি বিশ্বাস করেন? ঢাকা বোর্ড ৮৫ শতাংশ, যশোর বোর্ড ৬০ শতাংশ। যশোরের বাতাস কী বিষাক্ত? কেন এতো কম ছেলেমেয়ে পাস করল? আমি কী বাজী ধরে বলতে পারি না যে, সামনের বছর একলাফে যশোর বোর্ড এগিয়ে যাবে, যেভাবে সিলেট বোর্ড এগিয়ে গিয়েছিল? ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে কার জন্য এই প্রহসন? দেশ ধ্বংস করার কার এই মহা পরিকল্পনা?
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ালে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদর হিসেবে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি সেগুলো ছিল “সাজেশান’’। আমি যখন প্রশ্ন ফাঁসের কথা বলেছি তখন সেটা নিশ্চয়ই ছিল “বিভ্রান্তি ছড়ানো”। আমার নিশ্চয়ই শাস্তি পাওনা হয়েছে। আমার ভাগ্যে কী শাস্তি রয়েছে?
বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৪