ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সবুজকে কেন্দ্রে রাখতে হবে ।। নজরুল ইসলাম

. | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৪
সবুজকে কেন্দ্রে রাখতে হবে ।। নজরুল ইসলাম

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে আমরা বুঝে গেছি, ঢাকা শহর এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যা অনেকাংশেই বসবাসের অযোগ্য। সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়নি, তা হলে মানুষ এখানে থাকত পারত না।

আসলে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে এটা আপেক্ষিক কথা। সবার জন্য অযোগ্য নয়। বিত্তবানদের জন্য ঢাকা বসবাসের খুবই যোগ্য। কারণ তার বাড়িটা বিশাল, বাড়িতে ছোট-বড় বাগান আছে। বাড়িতে ফুলের গাছ আছে। এমনকি, বাড়িতে গরম নাই, ঠাণ্ডাও নাই। গরমের সময় এয়ারকন্ডিশন, ঠাণ্ডার সময় হিটিং। একেবারে রাজপ্রাসাদের মতো একটা ব্যাপার নিয়ে থাকে এই শহরে। হয়তো আছে তিন-চার-পাঁচটা গাড়ি—মার্সিটিজ, বিএমডব্লিউ কতকিছু। তাদের কাছে এটা স্বর্গ।

মধ্যবিত্তরা আগের চেয়ে ভালো আছে, তবে কষ্টে আছে। নিম্নবিত্ত দরিদ্র, বস্তিবাসী আগের চেয়ে একটু ভালো আছে। কিন্তু খারাপই বলব। এ শহরে ১৯৭১-এ ছিল নয় লক্ষ মানুষ, এখন হয়েছে ৯০ লক্ষ বা তারও বেশি। শহরটা এতো বেশি মানুষ ধারণ করে আছে। এই কষ্ট, দুঃসহ অবস্থা, এটা আরো কম দুঃসহ হতো যদি সুন্দরভাবে, পরিকল্পিতভাবে দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করা যেত। তবে পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে গতি শ্লথ হয়ে যায়। সেটা আরেক সমস্যা। সেটাকে আবার দ্রুত করা যায় অধিকতর বিনিয়োগ, অধিকতর দক্ষ লোক ও অধিকতর শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে। দুবাই যেমন করে। শ্রমিক যেখান থেকে পাও, নিয়ে আসো। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসো, ফিলিপাইন থেকে নিয়ে আসো। প্রকৌশলী নিয়ে আসা হয়, শ্রমিকও নিয়ে আসা হয়। তারপরও একটা কথা থাকে—আমাদের জনসংখ্যা এতো দ্রুত বাড়ে, দুবাই হলেও সেটা কন্ট্রোল করতে পারত না। বাংলাদেশ বলেই পারছে। সবাইকে সহ্য করে নেয়া, গ্রহণ করা—এসব মানসিকতা আমাদের ভেতর রয়েছে। এখন বসবাস যোগ্যতা বা শহরটাকে ঠিক করা এখনও সম্ভব। তবে দেরিতে শুরুর ফলে খরচ বাড়বে অনেক।

শহরের যদি উন্নতি করতে হয়, তাহলে যেটা আগে বলেছি পরিকল্পনা ও  বাস্তবায়ন সঠিক হতে হবে। শাসন ব্যবস্থা বা প্রশাসন সঠিক-সুদক্ষ এবং সুচারু হতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা, দক্ষভাবে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। না হলে সব প্রজেক্টই উল্টাপাল্টা হয়ে যাবে।

ঢাকা শহর ৪৭ সাল থেকেই বেড়ে চলেছে। স্বাধীনতার পর সে বৃদ্ধি ও প্রবণতা আরও বেড়েছে। দেশে জনসংখ্যা যেহেতু বৃদ্ধি পেয়েছে, সুতরাং ঢাকার জনসংখ্যা বাড়ছে। প্রতি বছর যদি ঢাকায় ৪/৫ লক্ষ নতুন লোক আসে, প্রতি ১০ বছরে ৫০/৬০ লক্ষ লোক যুক্ত হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার প্রশাসন বা অন্যসব কিছুর ব্যবস্থা করা কঠিন। তার জন্য জাতীয় নগরায়ণ নীতিমালায় বলা আছে, ‘ঢাকা শহরের জনসংখ্যার হার হ্রাস করতে হবে। ’ সেটা কিভাবে হবে, অন্যান্য শহরের দিকে যদি মানুষের যাওয়ার প্রবণতা বাড়ানো যায়। অন্যান্য শহরে যাওয়ার প্রণোদনা দেয়া যায়, আর তা করতে গেলে বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া উপায় নাই। তাছাড়া অন্যান্য শহরের উন্নয়ন করতে হবে। পুরো দেশের জন্য নগরায়ণ পরিকল্পনা করতে হবে। পুরো দেশের জনবসতি বা জনপথ পরিকল্পনা করতে হবে।



আমরা যদি বাস্তবিকই নগরায়ণের চিন্তা করি তাহলে, আমাদের যে ছোট বড় সাড়ে পাঁচ’শ শহর রয়েছে, সবগুলোর জন্যই কাজ করতে হবে। ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিও প্রবণতা আটকাতে হবে। এর জন্য বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা শহরের দিকে অধিকতর নজর দিতে হবে। ঢাকার চারপাশে যে শহরগুলো আছে, যেমন— মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ইত্যাদির দিকে নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে নতুন উপশহর তৈরি করতে হবে। যেমন— পূর্বাচল, ওটাতো হয়েই যাচ্ছে। রাজউক-এর আরেকটা প্লান ছিল ঝিলমিল প্রকল্প। তার আবার বিছুটা বেআইনি ছিল, কিছুটা পড়েছিল ঝিলের মধ্যে, জলাশয়ের মধ্যে। আর প্রাইভেট যেগুলো হচ্ছে তার অনেকগুলোই নিয়ম মেনে গড়ে ওঠেনি। যারা নিয়ম মানেনি, তাদের নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

আইনের মধ্যে এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কৃষি জমি সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, বনভূমি সংরক্ষণ, জলাশয় সংরক্ষণের পর জায়গা বেশি থাকে না। যেটুকু থাকে সেখানে বৃহত্তর পরিবেশ পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় রেখে এগুলো করতে হবে। তবে একেবারেই জরুরি হলো বাংলাদেশ যেহেতু ভবিষতে নগরায়ণের মধ্যেই থাকবে। ফলে নগরায়ণ প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত সুন্দরভাবে পরিকল্পিত হতে হবে। আমাদের সমস্যা পৃথিবীর অন্য দেশের মত নয়। বরং অন্যদের থেকে সমস্যাটা যথেষ্ট কঠিন। এতো ছোট একটা দেশে এত মানুষ! এটা চিন্তাও করা যায় না। সে অবস্থাটা মাথায় রেখেই যাবতীয় উন্নয়ন করতে হবে। তার জন্য নগরজুড়ে বহুতল ভবন হবে অথবা বাড়িঘর ছোট ছোট হবে, অথবা মানুষের মুভমেন্ট কমাতে হবে। খামাকা দৌড়াদৌড়ি করবে না। শুধু ভর্তি পরীক্ষার জন্য হাজার হাজার ছেলে মেয়ে লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে ছোটাছুটি করছে। এমন একটি পদ্ধতি হলেই হতো যে যার বাড়িতে বসে পরীক্ষা দিবে বা নিকটস্থ কলেজে পরীক্ষা দিবে। এইগুলিতো আধুনিক চিন্তা। আমেরিকায় যাবে—পরীক্ষা দেয় ঢাকায়। ইংল্যান্ড যাবে—পরীক্ষা দেয় ব্রিটিশ কাউন্সিলে। আমাদের ছেলেমেয়েরা কেন একবার নিজের শহরে একবার ঢাকায় ঘুরে বেড়াবে? এই যে মোহাম্মদ জাফর ইকবাল এতকিছু করে দিচ্ছেন, এটা আধুনিক চিন্তা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই সেটা মেনে নিতে পারছেন না।

তাহলে কি তারা প্রাচীনপন্থীই থেকে যাচ্ছে। নগরায়ণের চিন্তাও আধুনিক ও পরিবেশসম্মত হতে হবে। সবুজ নগরের চিন্তা বারবার আসতে হবে। আমাদের মতো এতো সবুজ গ্রাম পৃথিবীতে কোথায় ছিল। দূর থেকে গ্রামের বাড়ি-ঘর দেখাই যায় না। শুধু দেখা যায় গাছ আর গাছ। ভিতরে ঢুকে টের পাওয়া যায় এখানে ঘর-বাড়ি আছে। বহুকাল ধরে আমাদের এই বসবাস সবুজের সঙ্গে। এর মধ্যে দেখা যায় একটা বিল্ডিং উঠে যাচ্ছে। বাড়ি-ঘর ওঠে ঠিক আছে । কিন্তু সবুজকেও রাখতে হবে। সবুজকে কেন্দ্রে রাখতে হবে।  

              
                                





বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।