ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শিশুবিবাহ: দুষ্ট প্রথার ভূত তাড়াতে হবে ।। আহমদ রফিক

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৪
শিশুবিবাহ: দুষ্ট প্রথার ভূত তাড়াতে হবে ।। আহমদ রফিক

বাল্যবিবাহের দুষ্টপ্রথা বন্ধে বাংলাদেশ কি এখনো উনিশ শতকের বঙ্গদেশে অবস্থান করছে! উনিশ শতকের বঙ্গীয় সমাজে এ অনাধুনিক প্রথা অবশ্য ব্যাপকভাবে বিরাজ করছে। হিন্দু সমাজে ‘গৌরীদান’ অর্থাৎ বালিকা বিয়ে রীতিমতো গর্বের বিষয়ই ছিল এই ভেবে যে, সমাজটা শাস্ত্রমতে চলছে।

এ প্রথার অনিষ্টকর ও অভিশপ্ত দিকগুলোর প্রতি নজর দেবার মতো সুবুদ্ধি অন্ধ সমাজপতিদের ছিল না। তারা শাস্ত্র মেনেই খুশি।

বাঙালি মুসলমান সমাজও এদিক থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। আট-দশ বছর বয়সী বালিকার বিয়ে হরদম চলেছে। উনিশ শতকে হিন্দু সমাজে দুচারজন মনীষী, সমাজ সংস্কারক এ কুপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেও মুসলমান সমাজে তেমন ঘটনা বড় একটা দেখা যায়নি। এ ব্যবস্থাকে বাল্যবিবাহ না বলে শিশুবিবাহ বলাই বোধহয় সঙ্গত।

সত্য বলতে কি বাংলাদেশে এ বর্বরতার অবসান বিশ থেকে একুশ শতকে পৌঁছেও পুরোপুরি ঘটেনি। প্রামাঞ্চলে সমাজপতিদের কল্যাণে এ কুপ্রথা এখনো সচল। যদিও আইন রয়েছে বাল্যবিবাহ রোধে তবু সে আইনের থোড়াই তোয়াক্কা করে থাকে গ্রাম বা ছোটখাট শহরের রক্ষণশীল সমাজপতিগণ। অন্যদিকে সামাজিক সংস্কার, ধর্মাচরণের বিকৃত ব্যাখ্যা, কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র পিতা, সমাজপতিদের প্রভাব সব কিছু মিলে গ্রামাঞ্চলে শিশুবিবাহকে জায়েজ করে তুলেছে, রীতিমত আইন অমান্য করে।
আর সেজন্য বর্তমান অবস্থান পরিপ্রেক্ষিতে দরকার শিশুবিবাহ-বিরোধী কঠোর আইন, আইন অমান্যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা। তা না হলে এ কুপ্রথা সমাজে বহাল তবিয়তে বজায় থাকবে। এর কুফলগুলো কারো চোখে পড়বে না। এক কথায় মনে রাখা দরকার বা শিশু-বিবাহের প্রধান কুফলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জন্মহার তথা অবাঞ্চিত জনসংখ্যা  বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার বৃদ্ধি বিকলাঙ্গ বা অপুষ্ট শিশুর জন্ম ইত্যাদি। এসবই আধুনিক সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষতির প্রভাব ছড়িয়ে যাবে রাজনীতিতে অর্থনীতিতে। আধুনিক সমাজ গঠন বহুল পরিমাণে ব্যাহত হবে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আরো একটি বিষয় বিবেচনা রয়েছে। আর তা হল, শুধু আইন করে সমাজ সংস্কার বা সমাজ-পরিবর্তন করা যায় না, যদি সমাজে সুশিক্ষার প্রসার পুরোপুরি ঘটানো না যায়, সমাজকে আধুনিকতার স্বাস্থ্যসচেতন করে তোলা না যায়, সর্বোপরি সমাজচেতনাকে আলোকিত করতে পারা না যায়। সংস্কারবদ্ধ সমাজ বদ্ধপচা ডোবার মতন, সেখানে শুদ্ধ চেতনা, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।

তাই যে কোনো ভালো আইন যতই প্রণয়ন করা হোক না কেন সমাজকে যদি তা গ্রহণের যোগ্য ও সচেতন করে তোলা না যায় তাহলে সে আইন বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যাসাগরের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রণীত বিধবা বিবাহের সমকালীন পরিণতি তার এক জলজ্যান্ত উদাহরণ।

আর একালে ছোট একটি উদাহরণ ষাটের দশকের জন্ম নিয়ন্ত্রণ আইন। বিশ শতকের আধুনিক পরিবেশ পার হয়ে একুশ শতকের অত্যাধুনিক পরিবেশেও জন্ম হার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনা গেল না, মূলত গ্রামীণ ও আধা শহুরে সমাজে। তাই শিশুবিবাহ আইন প্রণয়ণের পাশাপাশি সমাজচেতনা বিকাশের দায়টি রাষ্ট্রযন্ত্র ও শিক্ষিত সমাজকে গ্রহণ করতে হবে। এবং শিশুবিবাহ নামক দুষ্ট প্রথার ভূত সমাজ থেকে তাড়াতে হবে।



লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, ভাষাসৈনিক



বাংলাদেশ সময়: ১০৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।