ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিলুপ্তপ্রায় শকুনকে রক্ষা করবে কে? ।। মুকিত মজুমদার বাবু

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৪
বিলুপ্তপ্রায় শকুনকে রক্ষা করবে কে? ।। মুকিত মজুমদার বাবু ছবি : মুকিত মজুমদার বাবু

হাজার হাজার বছর ধরে শকুনই প্রকৃতি থেকে মৃতদেহ সরানোর কাজ করে রোগব্যাধি থেকে পরিবেশ সুরক্ষা করে আসছে। ফলে পরিবেশ থাকছে সুন্দর, নির্মল ও নিরাপদ।

আর এ কারণেই শকুনকে বলা হয় প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা প্রকৃতির ঝাড়ুদার। উচ্ছিষ্ট বর্জ্য যেমন রোগ-জীবাণু ছড়ায়, তেমনি দূষণের দোষে ভারী করে তোলে পরিবেশ। শকুনের অভাবে আমাদের দেশে গরু-মহিষ-ছাগলের মৃতদেহ থেকে অ্যানথ্রাক্স, কলেরা, যক্ষ্মা, ক্ষুরা রোগের মতো কঠিন অসুখের জীবাণু এখানে ওখানে বাসা বাঁধছে। এই জীবাণুগুলো একটি প্রাণীদেহ মরে গেলেও বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে। শকুনের অভাবে মৃতদেহ খাচ্ছে শেয়াল, কুকুর, কাক, ইঁদুরসহ অন্যান্য প্রাণী। এসব প্রাণীর সংস্পর্শে এসে আমরাও নানা কঠিন রোগের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছি। অথচ শকুন জীবাণু আক্রান্ত মরা-পচা খেলে তার কিছুই হয় না। কেননা, তার পেটে এমন এক ধরনের জারক রস থাকে যার মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স, কলেরা, যক্ষ্মা, ক্ষুরা রোগের মতো কঠিন রোগের জীবাণুও ধ্বংস হয়ে যায়, যা অন্যকোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

শকুন মানবজাতির রক্ষাকবজ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গরুর ব্যথানাশক ইনজেকশান ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার বেড়ে যাবার কারণে খুব দ্রুত মাত্র তিন দশকের মধ্যে বাংলা শকুন হারিয়ে যেতে বসেছে। অন্যান্য শকুনও ডাইক্লোফেনাক ওষুধ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে ডাইক্লোফেনাকের পরিবর্তে কিটোপ্রোফেন বাজারজাত হচ্ছে। ২০১০ সালে সরকার আইন করে ডাইক্লোফেনাক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করে। তখন বাজার দখল করে নেয় কিটোপ্রোফেন। কিন্তু কিটোপ্রোফেনও শকুনের জন্য ক্ষতিকর।

আইইউসিএন-এর সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশন উল্লেখ করেছে, কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সংকট, কবিরাজী ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, ইউরিক এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভৃতি কারণে শকুন আজ বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্তির আরেকটা কারণ হলো—শকুন বছরে মাত্র একটা ডিম পাড়ে। কোনোভাবে ওই ডিমটা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ওই বছর শকুনের বংশবৃদ্ধি দাঁড়ায় শূন্যের কোঠায়।

বাংলাদেশে একসময় ৬ প্রজাতির শকুন দেখা যেত। বাংলা, কালা, হিমালয়ী গৃধিনী, সরুঠুটি শকুন ছিল এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে প্রকৃতিতে শুধুই বাংলা শকুন ও কিছুসংখ্যক হিমালয়ী গৃধিনী দেখা যায়। অথচ অস্ট্রেলিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম বেশি শকুন আছে। তবে বাংলা শকুন (ওরিয়েন্টাল হোয়াইট-রাম্পড ভালচার) শুধু বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, লাওস, ক্যাম্বোডিয়া ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে দেখা যায়। বাংলা শকুন আমাদের দেশের স্থায়ী পাখি। প্রখর দৃষ্টিশক্তির কারণে এরা আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময় নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায়।

একটা শকুন মাটিতে খাবার দেখে নেমে এলে অন্যগুলোও তার দেখাদেখি দ্রুত নিচে নেমে আসে। মাত্র ২০ মিনিটে একদল শকুন বড় একটা মরা গরু শেষ করে ফেলে। এমনকি এরা ছোট ছোট হাড়ের টুকরোও আস্ত গিলে খেতে পারে। এরা মরা-পচা বিশেষ করে গরু-ছাগল-মহিষ ইত্যাদি খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে।

পৃথিবীতে ২২ থেকে ২৩ প্রজাতির শকুন দেখা গেলেও এর মধ্যে ১৪ প্রজাতির শকুনই বিপদগ্রস্ত। আশির দশকে সার্কভুক্ত দেশে শকুনের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি থাকলেও বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজারে। আর বাংলাদেশে এর সংখ্যা পাঁচ থেকে ছয়’শর বেশি হবে না, কমও হতে পারে।

প্রায় ৯৯ ভাগ শকুনই হারিয়ে গেছে বাংলার প্রকৃতি থেকে। অথচ স্বাধীনতার আগেও বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজার শকুন ছিল। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শকুন দেখা যায় বৃহত্তর সিলেটে। এছাড়া সুন্দরবনের আশেপাশে এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কোনো কোনো জায়গায় শকুনের দেখা মেলে। প্রাণী গবেষকরা বলছেন, শকুন না থাকায় গবাদি পশুর মৃতদেহ এখন শিয়াল, কুকুর, কাক, ইঁদুরসহ অন্যান্য প্রাণী খাচ্ছে। এতে অ্যানথ্রাক্স, কলেরা, যক্ষ্মা, ক্ষুরা রোগের জীবাণু এদের পেটে ধ্বংস না হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দেশের জীববৈচিত্র্য।

কয়েক যুগ আগেও বাংলাদেশের গ্রাম কিংবা শহরে গরু-ছাগল-মহিষসহ বিভিন্ন প্রাণী মারা গেলে মৃতদেহ ঘিরে বসত শকুনের উৎসব। বর্তমানে এই উপকারী পাখিটি মানুষের অসচেতনতা, অজ্ঞতা, অবহেলা আর অদূরদর্শিতার কারণে অতিবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রাণী গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীতে প্রায় ৯০ ভাগ শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) এর ক্রিটিক্যালি এন্ডেনজার্ড’ প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে শকুনের সব ক’টি প্রজাতিকে। প্রজাতিগুলো এখন অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শকুন বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন প্রাণী বিজ্ঞানীরা।

অজ্ঞতার কারণে মরাখেকো হিসেবে পূর্ব পুরুষ থেকেই শকুন নিয়ে আমাদের ভুল ধারণা রয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। শকুন নিয়ে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হয়নি। বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে শকুন বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যায় সেদিকে সচেষ্ট হতে হবে। ভারতে শকুনের ক্যাপটিভ ব্রিডিং শুরু হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে আমাদের দেশেও ক্যাপটিভ ব্রিডিং-এর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে ‘ডাইক্লোফেনাক’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ক্ষতিকর কিটোপ্রোফেনও নিষিদ্ধ করতে হবে। দেবদারু, বট, কড়ই, শিমুল, তেঁতুল, অর্জুন, পিপুল, নিম, তেলসুর প্রভৃতি বড় গাছ সংরক্ষণ করতে হবে যাতে শকুন তার আবাসস্থল না হারায়। শকুনের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য নেপাল সরকার যেমন ‘ভালচার রেস্টুরেন্ট’ ব্যবস্থা চালু করেছে তেমনি আমাদের দেশেও কোনো কোনো তৃণভূমিতে অসুস্থ, মৃতপ্রায় ও বুড়ো গরু রেখে শকুনের খাদ্যাভাব দূর করতে হবে। যেসব এলাকায় এখনো শকুন দেখা যায় সেসব এলাকাকে শকুনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করতে হবে। তৃর্ণমূল পর্যায়ে প্রকৃতিতে শকুনের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে, সম্মিলিতভাবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।