ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কর্পোরেশনের পুকুর ।। আহসান হাবীব

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৪
কর্পোরেশনের পুকুর ।।  আহসান হাবীব

কায়সার সাহেব নাগরিক কর্পোরেশনের একজন পদস্থ কর্মকতা। ভালোই ছিলেন কিন্তু তাদের কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বদল হওয়ায় হঠাৎই তার প্রেসার বেড়ে গেছে।

শোনা যাচ্ছে তাদের নতুন চেয়ারম্যান সৎ লোক এবং কঠিন ধরনের। তিনি যদি আগের ফাইলপত্র নিয়ে টান দেন তাহলে খবরই আছে। বলতে না বলতেই পিয়ন এসে ফিস ফিস করে বললো
- চেয়ারম্যান স্যার  ডাকে
পিয়নের ভাব ভঙ্গিতে কায়সার সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। হারামজাদা ফিসফাসের কী আছে? চুরি কি আমি এখানে একাই করেছি? টাকা সবাই খেয়েছে... এই পিয়নহারাম জাদাও ভাগ পেয়েছে। কর্পোরেশনরে প্রতিটা ইট টাকা খায় এটা সবাই জানে... ওপেন সিক্রেট। চা-টা শেষ করতে পারলেন না। গেলেন চেয়ারম্যান সাহেবের রুমে।
- স্যার ডেকেছেন?
- হ্যাঁ বসুন
কায়েস সাহেব নিঃশব্দে বসলেন ভিতরে ভিতরে তিনি ঘামছেন।
- আচ্ছা বছর খানেক আগে একটা কাজ হয়েছে দেখলাম আপনাদের ফাইল পত্রে
- স্যার কোন কাজটার কথা বলছেন?
- ঐ যে মুগদা পাড়ায় পুকুর খনন বাবদ ৫০ লাখ টাকার প্রকল্প
- জ্বি স্যার। ঢোক গিললেন কায়েস সাহেব। সর্বনাশ! আসল জায়গায় হাত দিয়েছেন তিনি।
- ঐ পুকুর প্রকল্পের কাগজপত্র বের করুন। আর আমি কাল এই পুকুর পরিদর্শনে যাবো এত বড় কাজ হলো একটু সারেজমিনে দেখা দরকার। কি বলেন?
- জ্বি স্যার জ্বি স্যার। কায়েস সাহেব টের পেলেন তার গলা শুকিয়ে গেছে, ঢোক গিলতেও সমস্যা হচ্ছে।
- আর হ্যাঁ... চেয়ারম্যান সাহেব একটু পজ দিলেন, তারপর সরু চোখে তাকিয়ে বললেন ‘কাল আপনিও আমার সঙ্গে যাবেন’
- জ্বি স্যার। ‘জ্বি স্যার’ যদিও বললেন কিন্তু কায়েস সাহেবের মনে হলো তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুলো না।

কোনোমতে টলতে টলতে  কায়েস সাহেব নিজের টেবিলে এসে বসলেন।
- স্যারের কি শরীর খারাপ?
পাশ থেকে জুনিয়র অফিসার মতিন জিজ্ঞেস করে। কায়েস সাহেব জবাব দেন না। তবে মনে মনে বললেন ‘হারামজাদা সব কটা এবার ফাঁসবে... আমিতো সবার আগে!’ মুখে পিয়নকে একটা চা দিতে বললেন। তবে চায়ে চুমুক দিয়ে কোনো স্বাদ পেলেন না। বিষের মতো লাগলো।

সে রাতে কায়েস সাহেবের চেখে ঘুম এলো না। খালি এপাশ ওপাশ করলেন। স্ত্রী একসময় খেকিয়ে উঠলেন ‘লাট্টুর মতো ঘুরছ কেন বিছানায়, স্থির হয়ে শুতে পারো না?’ মনে মনে কায়েস সাহেব বললেন লাট্টু কত প্রকার ও কী কী কালই টের পাবে।

পরদিন আশ্চর্যের ব্যাপার চেয়ারম্যান সাহেব তাকে না নিয়ে কাগজ পত্র নিয়ে মুগদাপাড়ার সেই পুকুর পরিদর্শনে একাই গেলেন। সঙ্গে অবশ্য জুনিয়ার অফিসার মতিনকে নিলেন। সাথে যাওয়ার জন্য বলেও কেন নিলেন না— পরিষ্কার বুঝে গেলেন কায়েস সাহেব। সকালে একটা প্রেসারের অষুধ খেয়েছেন। কী মনে করে টপ করে আরেকটা খেয়ে ফেললেন। সিগারেট বহু আগেই ছেড়েছেন যদিও, কিন্তু আজ বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। এতক্ষণে নিশ্চয়ই চেয়ারম্যান সাহেব মুগদা পাড়ায় পৌঁছে গেছেন। পুকুর...। আর ভাবতে পারেন না কায়েস সাহেব। আক্ষরিক অর্থে তিনি টপ টপ করে ঘামতে লাগলেন।

মুগদা পাড়ায় নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব কোনো পুকুর খুঁজে পেলেন না। এলাকার লোকজনও অবাক হলো, কই তারাতো এখানে পুকুর কাটার বিষয়ে কিছু জানেন না। একটা পুকুর থাকলে অবশ্য ভালোই হতো। এলাকায় পানির সমস্যা অনেক দিনের। আর পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হতো। চেয়ারম্যান সাহেব জুনিয়ার অফিসার মতিনের দিকে তাকালেন।
- ইয়ে স্যার পুকুরটা আসলে কাটা হয়নি।
- কিন্তু সরকার তো কর্পোরেশনকে এ কাজের জন্য ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে?
- জ্বি স্যার। আমতা আমতা করে কোনোমতে বলে জুনিয়ার অফিসার মতিন।

চেয়ারম্যান সাহেব আর কোনো কথা বললেন না। গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি ফিরে চললো কর্পোরেশনের দিকে।

চেয়ারম্যান সাহেব ফিরেছেন দুটোর দিকে। চারটার সময় কায়েস সাহেবের ডাক পড়লো তার রুমে। কায়েস সাহেব দুর্বল পায়ে হেঁটে গেলেন চেয়ারম্যানের রুমে।
- স্যার
- বসুন।
চেয়ারম্যান সাহেব সই করে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন
- এই চিঠিটা মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সম্ভব হলে আপনি নিজে গিয়ে হাতে হাতে দিয়ে আসুন।
কম্পিত হাতে চিঠিটা নিয়ে নিজের টেবিলে ফিরে আসলেন কায়েস সাহেব। চিঠিটা খামে ভরার আগে এক নজর পড়লেন। সেখানে লেখা। মানে চিঠির ভাষায় যা বলা হয়েছে তা এরকম... ‘মুগদা পাড়ার পুকুরটি এলাকাবাসির অপব্যাবহারে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। পুকুরটি মারাত্মকভাবে পরিবেশ নষ্ট করছে।   জন-জীবন সম্পূর্ণ হুমকির মুখে। এমতাবস্থায় পুকুরটি  দ্রুত মাটি ফেলে বন্ধ করা দরকার, এ বাবদ কর্পোরেশনকে ষাট লাখ টাকা বরাদ্দ অতিব জরুরি। ’  নিচে চেয়ারম্যান স্যারের সাইন।

কায়েস সাহেব কিপ্টে টাইপের মানুষ কিন্তু সেদিন কী মনে করে বাসায় দুই কেজি মিষ্টি নিয়ে ফিরলেন। এক কেজি সন্দেশ আর এক কেজি টাঙ্গাইলের চমচম।

লেখক: কার্টুনিস্ট, সম্পাদক— উন্মাদ

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।