সাইন্স এন্ড আর্টস অব ওকলাহোম বিশ্ববিদ্যালয়টি ওকলাহোমা রাজ্যেও মূল শহর থেকে প্রায় ষাট মাইল দক্ষিণে চিকাশা নামের একটা গ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পা রেখেই আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাওয়ার অবস্থা আর কি! এ আমি কোন পথের পথিক! আমেরিকার অন্যান্য আধুনিক শহরের তুলনায় যাকে বলে অজপাড়া গাঁ।
কিন্তু কি আর করা! এর আয়োজক তো আমি নিজেই। হাজার রকম আকাশ-কুসুম চিন্তা করে আমার খালাতো ভাই শিবলীর বাসায় যখন ঘুমাতে যাই তখন দুচোখ ভরা শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন। কিন্তু হঠাৎ করে ঘরে বাজ পড়ার মত শব্দে খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেল। ‘ইয়ো ম্যান, ওয়েক আপ! ওয়েক আপ!’ আমিতো এক আধা কাউলা আর আধা ভারতীয় জীবটার দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শিবলী আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে পরিচয় করিয়ে দিল। ‘দেব কুমার, আমার রুমমেট। অসম্ভব ভালো একটা মানুষ। ’
দেব কুমার আক্ষরিক অর্থেই যে অসাধারণ এক মানুষ তার প্রমাণ পাওয়া গেল তাকে দেখেই। আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে এক কাপ লাল চা নিয়ে আমার সামনে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। কথা শুরু হল তার সাথে। দেব এসেছে ভারতের কেরালা রাজ্য থেকে। ওর কাছ থেকেই জানা গেল যে আমরা কিছুক্ষণ পরেই নাস্তা সেরে সবাই দল বেঁধে বের হব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখতে। বিশাল ক্যাম্পাস। তাই অনেক সময় লাগবে। তারপর ক্যাম্পাসদর্শন শেষ করে দেখা করতে যাব আমাদের পুরানো দোস্ত ফারুকের (আসল নামটা গোপন থাকল) বাসায়। ওর বাসায় আমাদের নেমন্তন্য।
ফারুকের বাসায় যখন কলিং বেলের বুতাম টিপলাম তখন বাজে প্রায় ৭.৩০। হাসিমুখে এক শেতাঙ্গিনী দরজা খুলে দিতেই আমি যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। ‘শুভ সন্ধ্যা’। ফারুক আমাদের মনের অবস্থা আঁচ করেই হয়তো বললো, ‘সিন্ড্রি, আমার বউ’। আমি যথারীতি বাঙালি কায়দায় অভিবাদন জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিন্ড্রি আমাদের খুবই আপন একজন মানুষ হয়ে গেলেন। জানা গেল বাংলা ভাষা শেখার প্রতি সিন্ড্রির রয়েছে এক অদম্য আগ্রহ। সাধারণত যা হয় এই ধরনের তথ্য আবিষ্কারের পর সিন্ড্রির প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের আরো বেড়ে গেল। মনে মনে ভাবছিলাম যে ফারুকটা সত্যি কতই না ভাগ্যবান। যেখানে বাঙালিরাই আর বাংলা নিয়ে ভাবে না, সেখানে ভীন সংস্কৃতির একটা মেয়ে বাংলা শিখতে চাইছে, বাঙালি হতে চাইছে। এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কি হতে পারে?
ওকলাহোমা থেকে নিউইয়র্ক চলে আসার পর অনেকদিন হয়ে গেল ফারুক আর সিন্ড্রি কারো সাথেই কোনো যোগাযোগ নেই। তবে সেদিন হঠাৎ করেই ওকলাহোমার পুরনো এক দোস্তের সাথে দেখা। তার সাথে হাজার রকম বিসয়ে মত বিনিময় শেষে আমি জানতে চাইলাম, ফারুক আর সিন্ড্রির খবর। আমার কথার উত্তর শুনে মনটা ভেঙে গেল আমার। ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক আগেই। আরো অবাক হই শুনে যে, ফারুক নাকি ওকে বিয়ে করেছিল গ্রিন কার্ড পাওয়ার আশায়।
গ্রিন কার্ড পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিন্ড্রির সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফারুক বাংলাদেশে বিয়ে করে আসে। সে নাকি এখন ওকলাহোমায় বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। হায়রে বাঙালি আর বাঙালির মন! না, সিন্ড্রি কোথায় আছে সে খবর আর কেউ জানে না। কোথায় আছেন সিন্ড্রি? কেমন আছেন আপনি? আপনি ভালো আছেন তো? আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন এই প্রার্থনাই করি। খুব জানতে ইচ্ছে করে, যে আগ্রহ আর ভালোবাসা নিয়ে আপনি বাংলা স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জন বর্ণ শিখেছিলেন তা কি এখনো মনে আছে? আপনি কি আমাদের এই নীচতা ক্ষমা করে দিতে পেরেছেন? সিন্ড্রি, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমরা হয়তো আপনার সুন্দর মনের যথাযথ লালন করতে পারি নি। আমাদের ঘুনে ধরা মানসিকতা আমাদেরকে সেই সৎ সাহস দেয়নি। সিন্ড্রি, আপনাকে খুব মনে পড়ছে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৪